বর্তমান আর্থিক দুনিয়ায় নয়া সিকান্দার যে রুপি-রুবেলের হরগৌরী মিলনের নব্য রসায়ন। এমন সিকোয়েন্সে মার্কিন ডলার বা ইউরোর অবস্থা যেন এখন ভাগের মা গঙ্গা পায় না। ভারত ও রাশিয়ার দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে আজকের অভিঘাতে সমগ্র জগতের কাছে এটাই তো হলো মূল ক্যাচ লাইন। অন্তত তেমনটাই তো জানালেন কলকাতার রুশ অ্যাম্বাসাডর ম্যাক্সিম কোজলভ
দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ইতিমধ্যেই ফ্রান্স সহ মার্কিন মুলুকের সংশ্লিষ্ট দুই রাষ্ট্রনেতার সঙ্গে পৃথক পৃথক বৈঠক সেরেছেন। ফরাসী প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাক্রোঁ ও আমেরিকান কাউন্টার পার্ট ডোনাল্ড প্রত্যাশিত ভাবেই ভারতের প্রধানমন্ত্রীর জন্য রাজকীয় অভ্যর্থনায় কোনও রকমের খামতি রাখেননি। আসলে বিশ্বমন্দার শরিক ইউরোপীয় বাজারের তুলনায় দক্ষিণ এশিয়ার এই রাষ্ট্রটি যে এখন পুরোপুরি উল্টো স্রোতের আগুয়ান বোল্ড বুল। সুতরাং ধনতান্ত্রিক অর্থনীতির দুনিয়ার এহেন স্বঘোষিত দ্বিজ হোতা যে ভারতের অর্থনৈতিক ভুমিকাকে কিছুটা সমীহ করবেই এতে আর আশ্চর্যের কি আছে। কিন্তু তাই বলে কিছুটা হলেও ভিন্ন ভাবধারার অর্থনৈতিক বিশ্ব অভিভাবকও কিন্তু ভারত সম্পর্কে চুপ করে বসে নেই। সেও যে ভারতীয় বাজারকে নিজস্ব বন্ধুত্বের মোরকে একে আঁকড়ে ধরতে চায় নিপুণতার বৈচিত্র্যময় সংমিশ্রণে। তাই তো ভারতীয় বানিজ্যে নিজেদের অংশীদারিত্ব আরও মজবুত করতে রাশিয়ার ভ্লাদিমির পুতিন প্রশাসন তাঁর আস্থাভাজন রাষ্ট্রদূতকে রীতিমতো ভারতের মাটিতে সরাসরি নামিয়ে দিয়েছেন ইন্দো-রুশ বাণিজ্য প্রসারের ময়দানে স্ট্রাইকার হিসেবে।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইউরোপীয় ইউনিয়নের দুই রাষ্ট্র সদস্যের এহেন দুই রাষ্ট্রনায়কদের সঙ্গে যখন বিভিন্ন বিষয়ক বিজনেস ট্রিটির সাদা কালো দস্তাবেজের সার্থক রূপায়ণে মশগুল, ঠিক তখন মহানগরীর মাটিতে বসে একের পর এক চমকপ্রদ বাণিজ্যিক স্বপ্ন ফেরি করে বসলেন কলকাতার রুশ কনসাল জেনারেল ম্যাক্সিম কোজলভ।
তিলোত্তমা নগরীর বহমান গঙ্গার নিকটবর্তী পাড়ে বসে হয়তো ভারত আত্মার সর্বোত্তম বিশ্বাসের ভিত্তি গঙ্গাকে সাক্ষী রেখেই কি সেই চমকে দেওয়ার মতো দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের একগুচ্ছ স্বপ্ন ফেরি করলেন এই রাশিয়ান অ্যাম্বাসাডর?
কলকাতার রুশ কনসাল জেনারেল চলমান ইন্দো রুশ বাণিজ্যিক সম্পর্ককে আরও বুনিয়াদী ভিত্তি স্থাপনের উদ্দেশ্যে কোন কোন বিষয়ে আলোকপাত করতে চেয়েছেন তা অবশ্যই আলোচিত হতে বাধ্য। কিন্তু তার আগে বিগত কয়েকদিনের প্রেক্ষাপটে এই রুশ কূটনৈতিকের অর্থনৈতিক নির্ভর গতিবিধি বিশ্লেষণ করলে একটা কথা পরিষ্কার হয়ে যায়, ভারতের পূর্বাঞ্চলের বাজারের ফাঁকা মাঠে গোল করতে চরম উৎসুক ভ্লাদিমির পুতিনের দেশ।
কেন এমন প্রসঙ্গ উঠে এলো? একটা সাম্প্রতিকতম বহমান পরিসংখ্যান উল্লেখ করলেই বোঝা যায় এই রাষ্ট্রদূতের কলকাতা কেন্দ্রিক বাণিজ্যিক সম্পর্কিত তৎপরতা কতটা উচ্চ পর্যায়ের অগ্রাধিকার প্রাপ্ত। মাত্র বিগত আড়াই মাসের মধ্যে তিনি নিজে পৌঁছে গিয়েছিলেন তিনবার দুটি বণিকসভার দফতরে। দেখা করেছেন সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা সেরেছেন স্থানীয় বণিক কর্তাদের সঙ্গে একাধিকবার। কখনও তুখোড় ইংরেজি ভাষায় সংযোগ রক্ষা করছেন তো আবার চোস্ত হিন্দিতে কথা সারছেন। লিয়াজোর মাত্রা চড়া গ্রামে পৌঁছে দিতে টানা আলাপপর্ব চালাচ্ছেন একেবারে ঝরঝরে বাংলাতে। ফলও মিলছে হাতেনাতে। পাক্কা বাণিজ্যিক মনোভাবাপন্ন এহেন বৈদেশিক রাষ্ট্রদূতের কথার ফাঁকে ফাঁকে তাই তুমুল হাততালিও পড়ছে সমানতালে। প্রত্যাশিত ভাবেই সকলের মধ্যে তাঁর উপস্থিতি উপরেই যেন একশো শতাংশ ফোকাস নিবদ্ধ হয়ে যাচ্ছিল বারেবারে। এমনকি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আহ্বানে সারা দিয়ে তিনি সটান হাজির হয়ে যান সদ্য সমাপ্ত বিশ্ব বঙ্গ বাণিজ্য সম্মেলনে। এবিষয়ে তাঁর বক্তব্য, ‘আমাকে আমন্ত্রণ জানানো হলে আমি ওই সামিটে হাজির হয়েছি। এটা একটা সফল উদ্যোগ। আমরাও এই রাজ্যের বাণিজ্যিক অবস্থান সম্পর্কে উৎসাহের বাতাবরণ গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করছি।’ সুতরাং সহজেই অনুমেয়, কলকাতা স্থিত এই কূটনীতিকের সাম্প্রতিক কালের এহেন মহানগর ঘেঁষা ব্যাপক বাণিজ্যিক উদ্দীপনা আসলে ভারতের পূর্বাঞ্চলকেই তাঁর টার্গেট করার মূল প্রতিপাদ্য।
এই অভিনব প্রধান প্রতিপাদ্যের কথাটা অবশ্য নিজের মুখেই স্বীকার করেছেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ঠিক যখন ওয়াশিংটনে সফররত সেই মুহূর্তে ম্যাক্সিম কোজলভ আবার একটি আলোচনা পর্ব সারলেন কলকাতার বিশিষ্ট কিছু ব্যবসায়ীদের সঙ্গে। ‘বাণিজ্য এবং বিনিয়োগের প্রেক্ষাপটে ইন্দো রুশের আর্থিক অংশীদারিত্ব’ শীর্ষক আলোচনায় রাখঢাক না করেই সরাসরি বলে বসলেন, ‘আমাদের ভিশন হলো ভারতের মধ্যে লুক অ্যাট ফার ইস্ট।’ এটা একবাক্যে বোধ হয় এবার মেনে নেওয়ার সময় এসেছে, মস্কো কর্তাব্যক্তিদের পরিকল্পিত ‘ভারতের মধ্যে লুক অ্যাট ফার ইস্ট’ মিশন সম্পর্কে তিনি যে উপরিউক্ত কার্যক্রমের মাধ্যমে যথেষ্টই যোগ্য, দক্ষ ও পারদর্শী সেবিষয়ে পুতিনের রাষ্ট্র এক প্রকার নিশ্চিত।
এমন আলোচনায় বক্তব্য রাখতে গিয়ে পুতিন প্রশাসনের এই রুশ কূটনীতিক বলেন, ‘ভারতের রাজনৈতিক রাজধানী দিল্লি এবং অর্থনৈতিক রাজধানী মুম্বাইয়ের দিকে বিশ্বের তাবড় তাবড় দেশের শ্যেন দৃষ্টি সর্বক্ষণ নিবদ্ধ। কারণ ভারত এখন বিশ্বের অর্থনৈতিক মানদন্ডে প্রথম পাঁচের মধ্যে ঘোরাফেরা করছে। সেই কারণে আমাদের দেশও এতকাল দিল্লি ও মুম্বাইকে অতি গুরুত্ব দিয়ে এসেছি। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রগত চাহিদায় প্রচুর পরিবর্তন এসেছে। রাশিয়া এখন সারা ভারতের প্রতিটি প্রান্তরে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য প্রসারিত করতে ভীষণ আগ্রহী। সেকারণেই ভারতের পূর্বাঞ্চল বর্তমানে রাশিয়ার কাছে নয়া বিজনেস ডেস্টিনেশন।’
ভারতের নব্য ব্যবসায়িক প্রসার ক্ষেত্রের কথা উল্লেখ করতে গিয়ে তিনি উল্লেখ করেন বিগত শতাব্দীতে জওহরলাল নেহরু ও ইন্দিরা গান্ধীর জমানার সঙ্গে সাবেক সোভিয়েত রাশিয়ার সুসম্পর্কের কথা। একইসঙ্গে মনে করিয়ে দেন চলতি শতাব্দীতে অটলবিহারী বাজপেয়ী থেকে মনমোহন সিং তথা নরেন্দ্র মোদীর ভারতের সঙ্গে অধুনা রাশিয়ার এ দোস্তি হাম নেহি তোড়েঙ্গে। সুতরাং এখন আমাদের লক্ষ্য সমগ্র ভারতের দিকে। আমরা বেঙ্গালুরুতে শিল্প সহায়ক পুনর্গঠনের জন্য সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছি। ভারতের বিভিন্ন স্মার্ট সিটিতেও আমরা উন্নয়ন খাতে সহযোগী হবো। ভারতের পূর্বাঞ্চলে প্রচুর প্রাকৃতিক সম্পদ রয়েছে। বৃহৎ অঞ্চল জুড়ে কয়লা খনি আছে। বিশ্বমানের চায়ের উৎপাদন হয় এখানে। উন্নতমানের শ্রমের অভাব নেই এখানকার রাজ্যগুলোতে। ট্যুরিজম তো পর্যটকদের কাছে অপরূপ নয়নাভিরাম। অতএব ভারতের পূর্বাঞ্চলে রাশিয়ার দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য তরান্বিত করাটাও আমাদের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারের মধ্যে রয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
আলোচনার সময় যত গড়াতে থাকে ততই যেন ম্যাক্সিম কোজলভ উপস্থিত ব্যবসায়ীদের জন্য একের পর এক অবাক করা নতুন নতুন বাণিজ্যিক উপহার ঘোষণা করতে থাকেন। ইতিমধ্যেই আমেরিকা, ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি সহ গোটা ইউরোপীয় ইউনিয়ন রাশিয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে আর্থিক ও বাণিজ্যিক দৃষ্টিকোণ থেকে। ফলে আমেরিকান ডলার ও ইউরো ক্রমেই পুতিনের দেশের কাছে একটা অনমনীয় দেওয়াল হয়ে দাঁড়িয়েছে। পাল্টা রাশিয়াও তার মুদ্রা বৈদেশিক বাণিজ্যের লেনদেনের সূচক হিসেবে রুবেলকে একমাত্র হাতিয়ার করে সামনের দিকে এগোতে চাইছে। দুই তরফের রণংদেহী এমন আবহের মধ্যে ম্যাক্সিম কোজলভ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণাটি করে আমি ফেললেন কলকাতার বণিকমহলের সামনে। তিনি বললেন, ‘এবার থেকে ভারত ও রাশিয়ার মধ্যে আন্তর্জাতিক সমস্ত বাণিজ্যিক লেনদেনের জন্য নব্বই শতাংশ ক্ষেত্রেই রুপি ও রুবেল ব্যবহার করা সম্ভবপর হবে। ভারতের বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর ও রাশিয়ার ডেপুটি প্রাইম মিনিস্টার ডেনিস মান্টুরভ একযোগে লাগাতার প্রয়াস করে এই অসাধ্যসাধন করেছেন।’ জ্বালানি তেল নিয়েও দুই দেশের মধ্যে জয়েন্ট ভেঞ্চার প্রজেক্ট অতিরিক্ত মাত্রায় প্রসারিত করাও এখন সময়ের অপেক্ষা মাত্র। ভারতের মোবাইল ফোন তো রাশিয়ার বাজারে দারুণ চাহিদা সৃষ্টি করেছে। দুই রাষ্ট্রের মধ্যে আমদানি ও রপ্তানির পরিমাণ আরও বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে রাশিয়া তরফে সরকারি নিয়ম কানুনে অধিক মাত্রায় সরলীকরণের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এইসব মন্তব্য করার পাশাপাশি কলকাতা স্থিত এই বৈদেশিক কূটনীতিক আরও রোমাঞ্চকর তথ্যটি শেষে প্রকাশ করলেন। তাঁর বক্তব্য, ‘ভারতীয়দের জন্য ভিসা প্রদানেও গতি বৃদ্ধি করা সম্ভবপর হয়েছে। এতদিন ভিসা দিতে নূন্যতম দুই সপ্তাহ সময় লেগে যেত। সেই নিয়মেও পরিবর্তন আনা হয়েছে। ভারতীয়েরা যদি সঠিক কারণ দেখিয়ে সুষ্ঠু ভাবে আবেদন করেন তবে এবার থেকে মাত্র চার দিনের মধ্যে আমরা ভিসা প্রদান করবো। এরজন্য রাশিয়ার দূতাবাস সর্বস্তরের সহযোগিতার জন্য সদা জাগ্রত রয়েছে।’