রতন ভট্টাচার্য
ফাঁকা কলসী, বাজল বেশী। আমেরিকার অন্য একজন রাষ্ট্রপতি বারাক ওবামা আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে নতুন দৃষ্টিভঙ্গির জন্য নোবেল শান্তি পুরস্কার (2009) পেয়েছিলেন। বেচারা ডোনাল্ড ট্রাম্প সাতবার যুদ্ধ থামানোর দাবি পেশ করেও পেলেন না। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের সুপারিশ ছাড়াও নরওয়ে সরকারের কাছে বাইশ দফা দাবি পেশ করা হয়েছিল। শিকে ছিঁড়ল না। এবারের নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী হিসেবে ভেনেজুয়েলার গণতন্ত্রপন্থী নেত্রী মারিয়া কোরিনা মাচাদো-এর নাম ঘোষণা করেছে নরওয়েজিয়ান নোবেল কমিটি। নোবেল শান্তি পুরস্কার ২০২৫ গ্রহণের পর মারিয়া বলেন: এই পুরস্কার ভেনেজুয়েলার সমস্ত মানুষের সংগ্রামের স্বীকৃতি। আমরা বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে এবং আজ, আগের চেয়ে বেশি, আমরা গণতন্ত্রের জন্য বিশ্ববাসীর সহায়তা চাই।”
Advertisement
মারিয়া তাঁর পুরস্কার উৎসর্গ করেছেন ‘ভেনেজুয়েলার নিপীড়িত জনগণকে’। তাঁর ‘‘অবিচল ও নিরলস প্রচেষ্টা, যা ভেনেজুয়েলার জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য এবং এক ন্যায়সঙ্গত ও শান্তিপূর্ণ রূপান্তরের লক্ষ্যে পরিচালিত”— এই কারণেই তাঁকে এই সম্মান প্রদান করা হয়েছে। নোবেল শান্তি পুরস্কার সাধারণত সেইসব ব্যক্তিকে দেওয়া হয়, যাঁরা যুদ্ধ, দমন-পীড়ন, বা মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণভাবে লড়াই করেছেন। মারিয়া কোরিনা মাচাদো এই মানদণ্ডে পুরোপুরি উপযুক্ত।তিনি অস্ত্র নেননি, তিনি শব্দের শক্তি ব্যবহার করেছেন। তাঁর ভাষণ, তাঁর লেখনী, এবং তাঁর সংগঠনের মাধ্যমে তিনি ভেনেজুয়েলার জনগণকে একত্রিত করেছেন।
Advertisement
মারিয়া কোরিনা মাচাদোর জন্ম ১৯৬৭ সালে, কারাকাস, ভেনেজুয়েলাতে। বর্তমান বয়স ৫৮। ভেনেজুয়েলার প্রধান বিরোধী নেত্রী। রাজনীতিবিদ ও গণতন্ত্রকর্মী। ভেনেজুয়েলা বহু বছর ধরে এক স্বৈরাচারী শাসনের অধীনে রয়েছে। প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরো-এর শাসনকালজুড়ে মানবাধিকার লঙ্ঘন, অর্থনৈতিক সংকট এবং রাজনৈতিক দমন-পীড়ন ছিল নিত্যদিনের ঘটনা। এই অন্ধকার সময়েই মারিয়া কোরিনা মাচাদো গণতন্ত্রের পতাকা হাতে তুলে নেন। শান্তির আলোকবর্তিকা হাতে গণতন্ত্রের অগ্নিপথে যাত্রা। তিনি সেই বিরল নেত্রী, যিনি ভয়কে জয় করে জনগণের পাশে দাঁড়িয়েছেন বারবার। ২০২৪ সালের বিতর্কিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পর থেকে তিনি আত্মগোপনে রয়েছেন, কিন্তু তাঁর কণ্ঠ থেমে যায়নি। নোবেল কমিটির ভাষায়, “তিনি সেই নারী, যিনি অন্ধকারের মধ্যে গণতন্ত্রের আলো জ্বালিয়ে রেখেছেন।” তাঁর নেতৃত্বে বিভক্ত বিরোধী দলগুলো একত্রিত হয়ে স্বাধীন নির্বাচন ও প্রতিনিধিত্বমূলক সরকার-এর দাবি তুলেছে।তিনি শুধু একজন রাজনীতিবিদ নন, তিনি লাতিন আমেরিকার সাহসিকতার প্রতীক। তাঁর সংগ্রাম, তাঁর ভাষণ, এবং তাঁর উপস্থিতি ভেনেজুয়েলার জনগণের মধ্যে চিরদিন আশার সঞ্চার করেছে।
উল্লেখযোগ্য, শান্তি নোবেল বিজয়ীরা মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র (1964): মাদার তেরেসা (1979): নেলসন ম্যান্ডেলা ও ফ্রেডেরিক ডি ক্লার্ক (1993): মালালা ইউসুফজাই (2014) ও বারাক ওবামা (2009)।সেই তালিকায় যুক্ত হলেন মারিয়া কোরিনা মাচাদো । তিনি বিশ্বাস করেন: গণতন্ত্র কোনো বিলাসিতা নয়, এটি মানুষের মৌলিক অধিকার ।তিনি বোঝাতে চেয়েছেন স্বাধীন নির্বাচন ছাড়া কোনো সরকার বৈধ নয়।মানবাধিকার রক্ষা করা রাষ্ট্রের প্রধান দায়িত্ব। তিনি দ্ব্যর্থহীন ভাবে বারবার বলেছেন, “ভেনেজুয়েলার জনগণ ভয় পায় না। আমরা জানি, আমাদের ভবিষ্যৎ আমাদের হাতেই।” বিশ্বজুড়ে তাঁর পুরস্কারকে স্বাগত জানানো হয়েছে। টাইম ম্যাগাজিন তাকে “Most Influential People of 2025” তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে। মার্কো রুবিও, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র সচিব, তাঁকে “Venezuelan Iron Lady” বলে অভিহিত করেছেন। রাজনীতি শুধু ক্ষমতার খেলা নয়, এটি আদর্শ, নৈতিকতা এবং জনগণের কল্যাণের জন্য পরিচালিত একটি গভীর চিন্তন ও কর্মপ্রক্রিয়া। রাজনৈতিক দর্শন সেই চিন্তাধারার ভিত্তি, যা একটি সমাজের কাঠামো, নীতি, এবং ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করে। আর রাজনৈতিক সংগ্রাম হলো সেই বাস্তব প্রয়াস, যার মাধ্যমে এই দর্শন বাস্তবায়িত হয়।রাজনৈতিক দর্শন বলতে বোঝায় সেই চিন্তাধারা, যা রাষ্ট্র, সরকার, আইন, স্বাধীনতা, ন্যায়, এবং ক্ষমতার প্রকৃতি ও উদ্দেশ্য নিয়ে আলোচনা করে। এটি একটি সমাজে কিভাবে শাসন চলবে, জনগণের অধিকার কী হবে, এবং ন্যায়বিচার কিভাবে প্রতিষ্ঠিত হবে—এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজে।রাজনৈতিক দর্শনের মূল উপাদান: ব্যক্তি ও সমাজের স্বাধীন চিন্তা ও কর্মের অধিকার ,সমতা ও সুযোগ, নাগরিকের এবং মৌলিক অধিকার ও স্বাধীনতা।
তার রাজনৈতিক দর্শন বিভিন্ন ধারায় বিভক্ত, প্রথমটি হল, গণতন্ত্রে যাতে জনগণই শাসনের উৎস। এখানে মত প্রকাশের স্বাধীনতা, ভোটাধিকার এবং প্রতিনিধিত্বমূলক সরকার থাকে। এটি জনগণের অংশগ্রহণকে উৎসাহিত করে। দ্বিতীয়ত, সমাজতন্ত্রে সম্পদের সমবন্টন, সামাজিক ন্যায় এবং রাষ্ট্রের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। এটি ধনী-গরিব বৈষম্য কমাতে চায়। পুঁজিবাদে ব্যক্তি উদ্যোগ, বাজার অর্থনীতি এবং ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকারকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। এটি উদ্ভাবন ও প্রতিযোগিতাকে উৎসাহিত করে। সাম্যবাদে শ্রেণীহীন সমাজের কথা বলা হয়, যেখানে সম্পদ ও ক্ষমতা সমভাবে ভাগ হবে। এটি একটি আদর্শিক অবস্থান, যা বাস্তবে প্রয়োগে নানা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে।রাজনৈতিক সংগ্রাম হলো সেই প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে একটি আদর্শ বাস্তবায়নের চেষ্টা করা হয়। এটি কখনো শান্তিপূর্ণ, কখনো সহিংস, কখনো সাংবিধানিক, আবার কখনো বিপ্লবী হতে পারে। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন, দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবৈষম্য বিরোধী আন্দোলন, বা আমেরিকার নাগরিক অধিকার আন্দোলন— সবই রাজনৈতিক সংগ্রামের উদাহরণ। গণআন্দোলন হলো জনগণের সম্মিলিত প্রতিবাদ, যা কোনো রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, আইন, বা শাসনের বিরুদ্ধে পরিচালিত হয়। এটি গণতন্ত্রের প্রাণ।মারিয়া কোরিনা এই গণ আন্দোলনের দুরন্ত এক সর্বজনবিদিত নেত্রী।তার বিপ্লব হলো একটি মৌলিক পরিবর্তনের জন্য পরিচালিত সংগ্রাম। এটি বিদ্যমান শাসনব্যবস্থাকে উল্টে দিয়ে নতুন কাঠামো প্রতিষ্ঠা করার জন্যই ।
বিশ্বজুড়ে রাজনৈতিক সংগ্রাম বিভিন্ন রূপে দেখা যায়: মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন আজীবন। আবার নোবেল শান্তি পুরস্কার জয়ী নেলসন ম্যান্ডেলা: দক্ষিণ আফ্রিকায় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম চালিয়েছেন। অন্য এক নোবেল শান্তি পুরস্কার জয়ী মালালা ইউসুফজাই: নারী শিক্ষার অধিকারের জন্য সংগ্রাম আজও চালাচ্ছেন। অন্যদিকে আং সান সু চি মিয়ানমারে গণতন্ত্রের জন্য জনগণকে উদ্বুদ্ধ করেছেন সংগ্রামে। মারিয়া একজন নারী, একা, এক দেশকে বদলে দিতে পারেন। ভেনেজুয়েলার রাজনৈতিক ইতিহাসে মারিয়া কোরিনা মাচাদো একটি ব্যতিক্রমী নাম। তিনি শুধু একজন রাজনীতিবিদ নন, তিনি জনগণের পাশে দাঁড়িয়ে গণতন্ত্রের দাবি তোলেন, এবং একক নেতৃত্বে বিরোধী দলগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করেন আবার তিনি মানবাধিকারের সপক্ষে লড়াই করে যান। ভেনেজুয়েলা বহু বছর ধরে রাজনৈতিক অস্থিরতা, অর্থনৈতিক সংকট এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার। প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরো-র শাসনকাল জুড়ে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল হয়ে পড়ে, বিরোধীদের দমন করা হয় এবং সাধারণ মানুষ চরম দুর্ভোগে পড়ে। এই সময়েই মারিয়া কোরিনা মাচাদো দৃঢ় কণ্ঠে বলে দেন, “আমরা ভয় পাই না। আমরা জানি, আমাদের ভবিষ্যৎ আমাদের হাতেই।”
মারিয়ার রাজনৈতিক দর্শন তিনটি মূল স্তম্ভে দাঁড়িয়ে: গণতন্ত্র: জনগণের মতামত ও ভোটাধিকারকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া মানবাধিকার: প্রতিটি নাগরিকের স্বাধীনতা, নিরাপত্তা, এবং মর্যাদা রক্ষা ও ন্যায়বিচার: রাষ্ট্রের প্রতিটি স্তরে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি তা তিনি বিশ্বাস করেন, “রাজনীতি যদি মানুষের কল্যাণ না করে, তবে তা ক্ষমতার অপব্যবহার।” মারিয়ার সংগ্রাম ছিল সহজ নয়। তাঁকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ থেকে বাধা দেওয়া হয়, তাঁর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ আনা হয়, এবং তিনি আত্মগোপনে যেতে বাধ্য হন। কিন্তু তাঁর কণ্ঠ থেমে যায়নি। তিনি ভার্চুয়াল মাধ্যমে, আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্মে এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাঁর বার্তা ছড়িয়ে দেন—“ভেনেজুয়েলা গণতন্ত্র চাই।” মারিয়া কখনো সহিংসতার পথ নেননি। তাঁর আন্দোলন ছিল শান্তিপূর্ণ, নৈতিক এবং জনগণনির্ভর। তিনি বলেন, “আমরা অস্ত্র নেব না, আমরা শব্দের শক্তি ব্যবহার করব।” এই শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদই আজ তাঁকে নোবেল শান্তি পুরস্কার এনে দেয়।
মারিয়া কোরিনা মাচাদো নারীদের জন্য এক অনুপ্রেরণা। তিনি প্রমাণ করেছেন, নারী নেতৃত্ব শুধু সম্ভব নয়, তা প্রভাবশালী হতে পারে। তাঁর নেতৃত্বে হাজার হাজার নারী রাস্তায় নেমেছেন, প্রতিবাদ করেছেন, এবং গণতন্ত্রের দাবিতে সোচ্চার হয়েছেন। তিনি বলেন, “নারীরা শুধু ঘর নয়, দেশও গড়তে পারে।” মারিয়ার সংগ্রাম আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। টাইম ম্যাগাজিন তাঁকে “Most Influential People of 2025” তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে। Human Rights Watch, Amnesty International এবং United Nations তাঁর নেতৃত্বকে প্রশংসা করেছে। তিনি বিশ্ববাসীর কাছে আবেদন করেছেন— “ভেনেজুয়েলার জনগণের পাশে দাঁড়ান।” নরওয়েজিয়ান নোবেল কমিটি তাঁর নাম ঘোষণা করে বলেন: “মারিয়া কোরিনা মাচাদো সেই সাহসী নারী, যিনি শান্তিপূর্ণভাবে গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করেছেন। তাঁর সংগ্রাম একটি জাতিকে পরিবর্তনের পথে নিয়ে গেছে।” মারিয়া কোরিনা মাচাদো এখন শুধু একজন নেত্রী নন, তিনি ভবিষ্যতের প্রতীক। তাঁর সংগ্রাম দেখিয়ে দিয়েছে, সত্য, সাহস এবং শান্তি মিলেই পরিবর্তন সম্ভব।তিনি বলেন, “আমরা হেরে যাব না। কারণ আমরা ন্যায়ের পক্ষে।” তাঁর সংগ্রাম, তাঁর আদর্শ, এবং তাঁর সাহস আমাদের অনুপ্রেরণা। তিনি প্রমাণ করেছেন, রাজনীতি যদি নৈতিক হয়, নেতৃত্ব যদি সাহসী হয়, এবং জনগণ যদি ঐক্যবদ্ধ হয়— তবে কোনো স্বৈরাচার টিকে থাকতে পারে না। আজ তিনি শুধু ভেনেজুয়েলার নয়, বিশ্বের শান্তির প্রতীক। নোবেল শান্তি পুরস্কার বিশ্বের অন্যতম মর্যাদাপূর্ণ সম্মান, যা প্রতিবছর সেই ব্যক্তি বা সংস্থাকে প্রদান করা হয়, যারা জাতিগত, রাজনৈতিক বা আন্তর্জাতিক সংঘাতের অবসান, মানবাধিকার রক্ষা এবং শান্তি প্রতিষ্ঠায় অসাধারণ অবদান রেখেছেন। এই পুরস্কারটি ১৯০১ সাল থেকে নরওয়েজিয়ান নোবেল কমিটি দ্বারা প্রদান করা হচ্ছে, আলফ্রেড নোবেলের ইচ্ছা অনুযায়ী। অন্যান্য নোবেল পুরস্কার সুইডেনে প্রদান করা হলেও শান্তি পুরস্কার নরওয়েতে দেওয়া হয়। এই পুরস্কার শুধু ব্যক্তিগত সম্মান নয়, এটি আন্তর্জাতিক শান্তি ও ন্যায়ের প্রতীক। “মারিয়া কোরিনা মাচাদো একজন সাহসী নারী, যিনি গণতন্ত্রের আলো জ্বালিয়ে রেখেছেন ক্রমবর্ধমান অন্ধকারের মধ্যে।”
Advertisement



