প্রয়াত প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ ছিলেন আমাদের দেশের ‘খোলা হাওয়ার প্রবক্তা’। মনমোহন সিংহ দেশের অর্থমন্ত্রী (১৯৯১) এবং দেশের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার অনেক আগে থেকেই আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অর্থনীতিবিদ হিসেবে তাঁর পরিচিতি অবশ্যই ছিল। কিন্তু রাজনীতির সাথে তাঁর কোনও সম্পর্ক ছিল না। তথাপি ভারতের রাজনীতিতে তাঁর আগমন অনেকটা কাকতালীয়ভাবেই। ১৯৯১ সালের ২১ মে রাজীব গান্ধির মর্মান্তিক মৃত্যুর পর নরহিংসহ রাও দেশের প্রধানমন্ত্রী হন (২৭২ জন কংগ্রেস-সাংসদ না থাকা সত্ত্বেও), অকংগ্রেসী কয়েকটি দলের সহযোগিতায়। কংগ্রেস সংসদীয় দলের নেতা মনোনীত হওয়ার পর নরসিংহ রাও মন্ত্রিসভার তালিকা তৈরি করার দায়িত্ব দিয়েছিলেন বহু অভিজ্ঞতা সম্পন্ন প্রণব মুখোপাধ্যায়কে। প্রণব মুখোপাধ্যায়ের তৈরি সেই তালিকায় তিনি অর্থমন্ত্রী হিসেবে কারুর নাম দেননি। প্রণববাবু এই পরিপ্রেক্ষিতে পরে সংবাদমাধ্যমে বলেছিলেন, নিজের নাম তো নিজে লিখতে পারি না, তাই অর্থমন্ত্রীর নামের জায়গাটা ফাঁকা রেখেছিলাম। আমি জানতাম, অর্থমন্ত্রী হিসেবে শ্রী রাওয়ের আমকেই পছন্দ হবে। যেহেতু দেশের অর্থমন্ত্রী হিসেবে অতীতে আমি দায়িত্ব পালন করেছিলাম। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কেন্দ্রের মন্ত্রী (ক্রীড়া দপ্তর) হয়েছিলেন ওই প্রণববাবুর সুপারিশেই।
যাই হোক, প্রণব মুখোপাধ্যায় সহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে অবাক করে দিয়ে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অর্থনীতিবিদ, অর্থনৈতিক ব্যাপারে বহু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করা প্রাক্তন আমলা ড. মনমোহন সিংহের উপর নরহিংস রাও দেশের অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব তুলে দিয়েছিলেন। ফলে ভারতের সংসদীয় রাজনীতি ও কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় মনমোহন সিংহের আবির্ভাব ঘটে যায়। মা সরস্বতীর এই বরপুত্রের আবির্ভাব লগ্নেই তিনি প্রমাণ করে দিয়েছিলেন, তিনি ভিনি, ভিডি, ভিসি, অর্থাৎ এলাম, দেখলাম, জয় করলাম। নরহিংস রাও যে সময়ে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়েছিলেন, সে সময়ে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা ছিল বেশ খারাপ (বিশেষ করে উপসাগরীয় যুদ্ধের কারণে)। কিন্তু মুশকিল আসানের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে মনমোহন সিংহ বিশ্বের বৃহত্তম এই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রকে অর্থনৈতিকভাবে কাবু হতে দেননি।
বহুবিধ আর্থিক সংস্কারের মাধ্যমেই তিনি এই অসাধ্য সাধন করেছিলেন। ১৯৯১-এর আগে-পরে বিশ্বের বহুদেশে অর্থনৈতিক মন্দার প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছিল, সে সময়ে ‘ভারত গৌরব মনমোহন সিংহের টোটকাতেই স্বস্তি মিলেছিল সেইসব দেশে। ২০০৪-এর লোকসভা নির্বাচনের পর ভারতবাসী ভেবেছিল, এইবার বুঝি ‘বিদেশিনী’ (রাজীব গান্ধির পত্নী) দেশের প্রধানমন্ত্রী হতে চলেছেন। কিন্তু নির্লোভী ও বুদ্ধিমতি সোনিয়া গান্ধি দেশবাসীকে হতবাক করে দিয়ে ভারতমাতার সর্বকালের অন্যতম শিখ সন্তান ড. মনমোহন সিংহের উপর দেশবাসীর দায়িত্ব তুলে দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী করে। ইউপিএ (১) ও (২)-এর প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মনমোহন সিংহ অসাধারণ ভূমিকা পালন করলেও কয়েকজন নেতা-মন্ত্রীর অপকর্মের জন্য সরকারকে বারে বারে বিব্রত হতে হয়েছিল। তথাপি প্রায় ৫৬টি প্রকল্পের মাধ্যমে দেশের কোটি কোটি মানুষ (বিশেষ করে বিপিএল তালিকাভুক্ত)-এর জন্য বহুবিধ উপকার করতে তিনি সক্ষম হয়েছিলেন। তাঁর সবথেকে বড় উল্লেখযোগ্য কর্মসূচি ‘একশো দিনেরকাজ’, যা আজও চালু রয়েছে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে কয়েক কোটি মানুষ করে খাচ্ছে। ‘খাদ্য সুরক্ষা’ আইনও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ‘ইন্দিরা আবাসন প্রকল্প’ নাম পরিবর্তন করে মোদী সরকার করেছে প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনা।এছাড়া আরও উল্লেখযোগ্য বহু জনমুখী কর্মসূচি।
ভারতীয় রাজনীতির আঙিনায় তাঁর মতো সুভদ্র, নম্র, এবং মৃদুভাষী (যদিও সাহসী ও দৃঢ়তার সঙ্গেই সবকিছুর মোকাবিলা করে গেছেন) দেশনেতা বিরল। দেশের অর্থনৈতিক সংস্কারের জনক হিসেবে ভারতের ইতিহাসের পাতায় তাঁর নামটি স্বর্ণাক্ষরেই লেখা থাকবে। তিনি হচ্ছেন ভারতের ‘প্রকৃত রত্ন’। পৃথিবীতে তঁর আগমন ঘটেছিল ২৬ সেপ্টেম্বর ১৯৩২। আর প্রয়াণ ঘটে ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪-এ।
বাবলু নন্দী, কলকাতা-৭৯