পৈত্রিক বাড়ি গার্নি হাউজের পিছনের জঙ্গলে শৈশব থেকেই হারিয়ে যেত ছেলেটি। একদিন তাঁর হাতে উঠে এলো রাইফেল। পাখি শিকার থেকে একটার পর একটা মানুষখেকো শিকার হয়ে উঠল তাঁর নেশা। পরবর্তীকালে ভারতবর্ষের বন সংরক্ষণের পথিকৃৎ তিনি। জীবনের শেষ অধ্যায় এই দেশ ছাড়ার আগে তার প্রিয় রাইফেল গুলো পুঁতে রাখলেন ওই গার্নি হাউজের পিছনের জঙ্গলেই।
এডওয়ার্ড জিম করবেটের কল্পকাহিনী এখনও গাড়োয়াল এবং কুমায়ুনের মানুষের মনে ও হৃদয়ে টিকে আছে। সারা বিশ্বের মানুষ জিম করবেটকে তাঁর অসাধারণ লেখার জন্য চেনেন। একজন বিখ্যাত শিকারী হিসেবে যিনি পরবর্তীতে অনেক কুখ্যাত মানুষখেকোদের প্রতিপক্ষ হয়ে ওঠেন। তাঁর ওপর চারটি জীবনী এবং তাঁর জীবনের ওপর তিনটি চলচ্চিত্র রয়েছে । যে বইগুলো তাঁর কৃতিত্বের স্পষ্ট বিবরণ তুলে ধরে। এডওয়ার্ড জেমস করবেট ১৮৭৫ সালের ২৫শে জুলাই জন্ম গ্রহণ করেন। আজ তাঁর জন্মের দেড়’ শ বছর পূর্ণ হলো। উত্তরাখণ্ডের নৈনিতাল জেলায় ইংরেজ বংশোদ্ভূত ছিলেন। তিনি তাঁর শৈশবের বেশিরভাগ সময় চারপাশের জঙ্গল অন্বেষণ করে বড় হন। জিম করবেট তাঁর জীবন ঘন জঙ্গলের মধ্যে কাটিয়েছিলেন। স্যার জিম করবেট তাঁর জীবনের বেশিরভাগ সময় নৈনিতালে অবস্থিত গার্নি হাউসে (নৈনিতালে অবস্থিত) তাঁর মা মেরি জেন করবেট এবং তাঁর দিদি মার্গারেট উইনফ্রেড করবেট, যাকে স্নেহের সাথে ম্যাগি বলা হত, তাঁর সাথে কাটান।
Advertisement
জিম করবেটের বয়স যখন চার বছর তখন নৈনিতালে পোস্টমাস্টার বাবা মারা যান। করবেটের মায়ের ওপর বিধবার সামান্য পেনশনে ১২ সন্তানকে লালন-পালন ও শিক্ষাদানের পুরো দায়িত্ব এসে পড়ে। অল্প বয়সের পরপরই জিম করবেটকে তাঁর ছয় সদস্যের পরিবারের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব নিতে হয়, তাই তিনি রেলওয়েতে চাকরি নেন।
Advertisement
বছরের পর বছর ধরে তিনি একজন ভালো শিকারী এবং অসাধারণ প্রকৃতিবিদ হয়ে ওঠেন। চমৎকার পর্যবেক্ষণ, দ্রুতগামী চালিকাশক্তি এবং দুর্দান্ত সহনশীলতার অধিকারী ছিলেন তিনি । এতটাই বুদ্ধিমান এবং সক্রিয় ছিলেন যে বনে চলাফেরা করার সময় তিনি বনের লক্ষণ এবং বন্যপ্রাণীর গতিবিধি (দৃষ্টি, শ্রবণ এবং গন্ধ) পড়তে পারতেন। ১৯টি বাঘ এবং ১৪টি চিতাবাঘ হত্যার রেকর্ড রয়েছে তাঁর। তিনি একজন অগ্রণী সংরক্ষণবাদীও ছিলেন এবং বর্তমান জিম করবেট জাতীয় উদ্যান প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি একটি নিশ্চিত অবিবাহিত জীবনযাপন করেন। অনেক বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ সংস্থার সক্রিয় সদস্য ছিলেন এবং প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণে সহায়তা করেন।
১৯৭৩ সালের ১ এপ্রিল, সেই সময়ের সবচেয়ে বড় রক্ষণশীল উদ্যোগ, প্রজেক্ট টাইগার চালু হওয়ার পর করবেট কেবল প্রকৃতির মধ্যেই থেকে যাননি। এই অঞ্চলটিকে ইতিহাস ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের এক সমৃদ্ধ সম্পদ হিসেবেও চিহ্নিত করা হয়েছিল। ১৯ শতকের গোড়ার দিকে বন সংরক্ষণের প্রথম প্রচেষ্টার সময় সংরক্ষণের একটি দীর্ঘ ঐতিহ্য রয়েছে। এশিয়ার প্রাচীনতম জাতীয় উদ্যান এবং ভারতের প্রথম টাইগার রিজার্ভের মর্যাদা ধারণ করে করবেট আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণে অগ্রণী প্রচেষ্টার প্রতীক। কিংবদন্তি শিকারী ও সংরক্ষণবাদী স্যার এডওয়ার্ড জিম করবেটের জাদুকরী ভূমি সংরক্ষণে তাঁর মূল্যবান অবদান এখনও নৈনিতাল এবং সারা বিশ্বের মানুষের মনে এবং হৃদয়ে জীবিত। তাঁর লেখাগুলো বন্যপ্রাণী প্রেমীদের প্রজন্মের পর প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করেছে। করবেট জাতীয় উদ্যানের আশেপাশের এলাকাটি তাঁর কাছে ছিল রহস্যময়। তাই তিনি গভীর জঙ্গল অন্বেষণ শুরু করেছিলেন। জিম করবেট জাতীয় উদ্যান ১৯৩৬ সালে হেইলি জাতীয় উদ্যান নামে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। যখন জিম করবেট জাতীয় উদ্যান প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন বাঘের সংখ্যা ছিল প্রায় ১৫০টি কিন্তু আজ তা ২৬৬টিতে দাঁড়িয়েছে। জিম করবেট জাতীয় উদ্যান বাঘদের জন্য এমন একটি স্থান, যা বন্দীদশা থেকে অনেক ভালো।
জল, বন এবং ভূদৃশ্য সহ উপলব্ধ প্রাকৃতিক সম্পদের স্থায়িত্বের জন্য ঐতিহ্যবাহী জ্ঞান গুরুত্বপূর্ণ। জিম করবেট জাতীয় উদ্যান এবং এর আশেপাশের বর্তমান সীমিত পরিধি একশ বছরেরও বেশি সময় আগে বন্যপ্রাণীর বৈচিত্র্য এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য পরিচিত ছিল।
১৯ শতকে মেজর রামসে-এর নেতৃত্বে যখন বনাঞ্চলের চিহ্নিত অঞ্চলগুলো সংরক্ষণের প্রচেষ্টা শুরু হয়েছিল। সেই সময় তিনিই ছিলেন সেই ব্রিটিশ অফিসার যিনি এই দায়িত্ব পালন করেছিলেন। ওই এলাকার ইনচার্জ নিযুক্ত করেছিলেন। সেই সময়ের ব্রিটিশ বন বিভাগ সীমানা নির্ধারণ করা জমির ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে। চাষাবাদ এবং গবাদি পশু পালন নিষিদ্ধ করে। ১৮৬৮ সালে এই অঞ্চল সংরক্ষণের প্রথম পদক্ষেপ শুরু হয়। এর পরপরই ১৮৭৯ সালে এই বনগুলোকে সংরক্ষিত বনাঞ্চলে রূপান্তরিত করা হয়, যেখানে সীমিতভাবে বন কাটার অনুমতি দেওয়া হয়।
এই জাদুকরী মাটিতে একটি জাতীয় উদ্যান স্থাপনের ধারণাটি ১৯০০ সালের গোড়ার দিকে ইআর স্টিভান্স এবং ইএ স্মিথিসহ বেশ কয়েকজন ব্রিটিশ প্রস্তাব করেছিলেন। এরপর ১৯০৭ সালে ব্রিটিশ প্রশাসন উদ্যোগ নেয় এবং একটি শিকার সংরক্ষণাগার প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা বিবেচনা করে। ১৯৩০ সালে স্যার এডওয়ার্ড জিম করবেটের চমৎকার তত্ত্বাবধানে চিহ্নিত এলাকার সীমানা নির্ধারণের প্রক্রিয়া শুরু হয়, যিনি এই অঞ্চলটি খুব ভালোভাবে জানতেন।
১৯৩৫ সালে স্যার ম্যাকলম হেইলি প্রদেশের গভর্নর থাকাকালীন জাতীয় উদ্যান আইন কার্যকর হয় এবং সেই অনুযায়ী এশিয়ার প্রথম জাতীয় উদ্যানটি হেইলি জাতীয় উদ্যান নামে অস্তিত্ব লাভ করে। স্বাধীনতার পর পার্কটি অল্প সময়ের জন্য (১৯৫২-১৯৫৭) রামগঙ্গা জাতীয় উদ্যান নামে পরিচিত ছিল। ১৯৫৬ সালে কিংবদন্তি স্যার এডওয়ার্ড জিম করবেটের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে ন্যাশনাল পার্কটির নামকরণ করা হয় জিম করবেট জাতীয় উদ্যান। শুধুমাত্র গৃহস্থালির উদ্দেশ্যে কাঠ কাটা নিষিদ্ধ ছিল। এখন তো ওই জঙ্গলে অনুমতি ছাড়া ঢোকাই নিষিদ্ধ।
করবেটের ইতিহাসে আরও একটি সোনালী দিন যোগ হয় যখন ১৯৭৩ সালে করবেট নামক পার্ককে ভারতের বাঘ সুরক্ষা কর্মসূচির লঞ্চ প্যাড হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এর ফলে এটি ভারতের প্রথম বাঘ সংরক্ষণাগারে পরিণত হয়।
পর্বতমালা নিজেই অনেক অনন্য মানব সংস্কৃতির আবাসস্থল যা এই অঞ্চলের স্বতন্ত্র জীবনযাত্রার প্রতিনিধিত্ব করে। যদিও, এটা সত্য যে এই অঞ্চলের জীবন বেশ কঠিন এবং দুর্গম ভূখণ্ডে বসবাসকারী পাহাড়ি জনগণের ওপর এর প্রভাব ব্যাপক। এই কারণেই ধর্ম, উপাসনা, সামাজিক সমাবেশ এবং মেলা এই অঞ্চলে বসবাসকারী মানুষের জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আমরা জানি যে করবেট জাতীয় উদ্যান হিমালয় উপ-বেল্টের পাদদেশে অবস্থিত । তাই এই দুটি পাহাড়ি সংস্কৃতির সংশ্লেষণ প্রকাশ করে, যথা গাড়োয়ালি এবং কুমাওনি। বিশ্বের অন্যান্য অনেক পাহাড়ি অঞ্চলেও একই রকম সংস্কৃতি পাওয়া যায় যেখানে সঙ্গীত এবং নৃত্য গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক উপাদান। কুমাওনি এবং গাড়োয়ালি অঞ্চলে স্বতন্ত্র লোকশিল্পের ধরণ রয়েছে। যা মূলত দৈনন্দিন জীবনের কাঠামোর সাথে বোনা। ধর্মীয় আবেগে পরিপূর্ণ এখানে পরিবেশিত নৃত্যগুলো ধর্মীয় এবং বিনোদনমূলক উভয় ধরণের। ধর্মীয় দিক সম্বলিত নৃত্যগুলো দুর্গা, শিব বা কালীর মতো হিন্দু দেবতা এবং মহাভারতের মতো মহাকাব্যকে ঘিরে ঘুরে বেড়ায়।
পাহাড়িদের নৃত্যের কিছু আকর্ষণীয় ধরণ বিনোদনমূলক উদ্দেশ্যে পরিবেশিত হয় যা এই অঞ্চলের রোমান্টিক গল্পের প্রতিনিধিত্ব করে। ঝোরা, চাপেলি, ঢোল, চাঁচারি, দেবতালি, কিউঙ্কি, চোলিয়া, চুনফুলা এবং ঝুমাইলা হল সবচেয়ে জনপ্রিয় নৃত্যের কিছু রূপ। সঙ্গীত, মন এবং শরীরকে জ্বালানি দেয় এবং এইভাবে আমাদের সৃজনশীলতাকে পরিপূর্ণ করে তোলে। একইভাবে পাহাড়িদের সঙ্গীতও সমানভাবে মন্ত্রমুগ্ধকর। পাহাড়ি সঙ্গীত গাওয়ার সময় তারা ঐতিহ্যবাহী তূরী, ঢোল, বাঁশি এবং ব্যাগপাইপের মতো বিভিন্ন যন্ত্র ব্যবহার করে। এই ঐতিহ্যবাহী নৃত্যশিল্পীরা ধ্রুপদী ধারার অনেক রাগের জন্ম দিয়েছেন। প্রধান রূপগুলোর মধ্যে রয়েছে: চৈতি, বৈরাস হুরকিয়া বায়োল এবং নেওলি।
নৈনিতাল। নভেম্বরের এক শীতের সকাল। হালকা রোদ উঠেছে। এক শিকারি তাঁর বাড়ির বাগানে চারাগাছ রোপণে ব্যস্ত। চারাগাছ রোপণ শেষে সে গেল জঙ্গলে, আর নিজের বন্দুকগুলো মাটিতে পুঁতে ইতি টানল শিকার জীবনের। বাড়ি ফিরে দিদি ম্যাগিকে সঙ্গে নিয়ে নীরবে চিরদিনের মত ভারত ছাড়ল সে। এই শিকারিকে সারা বিশ্ব একডাকে চেনে ‘জিম করবেট’ নামে। ১৯৪৭-এর অগস্টে ভারত স্বাধীন হয়। আর সেবছর নভেম্বরে জিম ভারত ছাড়েন। জিমের ভারত ত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়ে অবশ্য সবার মতামত ভিন্ন। কেউ মনে করেন জিম ভেবেছিলেন ভারত স্বাধীন হওয়ার ফলে বিদেশি বলে তাঁদের ওপর আক্রমণ আসতে পারে, তো কেউ ভেবেছিলেন জিমের শিকারের প্রতি টান কমে এসেছিল। আবার কেউ বা বলছেন বন ও বন্যপ্রাণী রক্ষার জন্য সারা বিশ্বব্যাপী আন্দোলন গড়ে তুলতে চাইছিলেন জিম। যা ভারতে থেকে সম্ভব ছিল না। তাই জিমকে ভারত ছাড়তে হয়েছিল।
জিম করবেট, যাকে সবাই ‘শিকারি’ হিসেবে একডাকে চেনে তাঁর পশুপ্রেমের কথা কিন্তু খুব কমজনই জানেন। পরাধীন ভারতে বন ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আন্দোলনের নেতা জিম করবেটকেও খুব বেশি মানুষজন চেনেন না। জিম করবেট ছিলেন এক বিরল শিকারি যিনি অকারণে একটি প্রাণীকেও হত্যা করেন নি। উলটে চেষ্টা করেছেন তাদের রক্ষা করার।
নৈনিতালের মানুষজন কষ্ট পাবে ভেবে নীরবে দেশ ছেড়েছিলেন জিম ও তাঁর দিদি। তাঁদের সাধের ‘গার্নি হাউস’ বিক্রি হয়ে যাওয়ার পর নৈনিতাল থেকে প্রথমে লখনউ। সেখান থেকে মুম্বই। তারপর মুম্বই বন্দর থেকে ‘এস এস অ্যারোন্দা’ জাহাজে চড়ে মোম্বাসা। সেখান থেকে নাইরোবি। পরে তারা আস্তানা গাড়েন নিয়েরে। জার্মানদের হাত থেকে মুক্ত হয়ে ওই অঞ্চলটি তখন ব্রিটিশ উপনিবেশ। ইওরোপিয়ানদের সঙ্গে জিমের কোনোকালেই খুব একটা পটত না, নিয়েরেও তাই হল। সেখানে লেখালেখির মধ্য দিয়েই দিন কাটতে লাগল করবেটের। দুর্ধর্ষ সব অভিযানের কাহিনিগুলো একের পর এক লিখতে লাগলেন জিম। বেশ দিন কাটছিল হেসে-খেলে- লিখে। কিন্তু শান্তি বেশিদিন স্থায়ী হল না। হঠাৎ একদিন পেলেন গুলির শব্দ। জিমের শিকারি মন আবার চঞ্চল হয়ে উঠল।নিজের রাইফেলগুলো নৈনিতালের জঙ্গলে পুঁতে এলে কী হবে, আফ্রিকার জঙ্গলে গুলিগোলার শব্দ শুনে নিজেকে আর স্থির রাখতে পারলেন না জিম। ছুটে গেলেন দেখতে।
আর জঙ্গলে গিয়ে যখন দেখলেন নির্বিচারে পশুহত্যা চলছে তখন তা জিমকে বিচলিত করে তুলল। ‘শিকারি জিম’ ততদিনে পুরোপুরিভাবে ‘পশুপ্রেমিক জিম’ হয়ে গেছেন।কেনিয়ায় নির্মম পশুহত্যা রুখতে ‘বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ’ আন্দোলন শুরু করলেন জিম। বহুমানুষ তাতে সামিল হল। তার নেতৃত্বে বন ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আন্দোলন সারা আফ্রিকা জুড়ে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করল। জিমের নাম ছড়িয়ে পড়ল সারা আফ্রিকা জুড়ে। তিনি তখন ‘ট্রি টপস’নামে একটি বই লিখছিলেন। সেটি সবে শেষ হয়েছে। ১৯৫৫ র ১৯ এপ্রিল না ফেরার দেশে চলে গেলেন জিম। হার্ট অ্যাটাকে মারা গেলেন জিম। তাকে সমাধি দেওয়া হল কেনিয়ার সেন্ট পিটার্স অ্যাঙ্কলিন চার্চ সিমেট্রিতে।
জিম করবেট মানে আজও চোখের সামনে ভেসে ওঠে এক সফল শিকারির ছবি। সবাই যখন শিকারে ব্যর্থ হত তখনই জিম করবেটের ডাক পড়ত। আর জিম অনায়াসে শিকারে সফল হয়ে দেখিয়ে দিতেন তিনিই সেরা। শিকারি হিসেবে অসম্ভব সাহসী ছিলেন জিম। তিনি বরাবর শিকারে চ্যালেঞ্জ নিতে ভালোবাসতেন। তাঁর সঙ্গীসাথীদের কথায়, “জিম কেবল এলাকাবাসী বা সরকারের অনুরোধেই শিকারে যেতেন, আর তিনি কখনো শিকারে ব্যর্থ হননি। দিনের শেষে জিম একজন ছিল পশুপ্রেমিক।”শুধু তাই নয় ভারতের সমস্ত জঙ্গল, এমন কি সংরক্ষিত বনাঞ্চল যেখানে ঢোকার আগে সরকারের অনুমতি নিতে হত, সেখানেও ছিল জিমের অবাধ প্রবেশাধিকার। কেন না সবাই জানত জিমের মত শিকারি জঙ্গলে প্রবেশ করলে পশুপাখির ক্ষতি হবে না উলটে সেখানকার পশুপাখি, মানুষজন উভয়েই উপকৃত হবে।জিমকে অনেকেই ‘মানবতাবাদী শিকারি’ বলেন। কারণ, অদ্বিতীয় শিকারি হওয়া সত্ত্বেও করবেট মনেপ্রাণে ছিলেন একজন ‘পশুপ্রেমী’। জিম করবেটকে পাহাড়ি মানুষজন ডাকত ‘কার্পেট সাহেব’ বলে।
জিম শিকার করলেও বুঝতেন বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের গুরুত্ব। বন এবং বন্যপ্রাণ উভয়কেই বাঁচাতে হবে তা জিম বুঝেছিলেন মনেপ্রাণে। প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় বন্যপ্রাণীর গুরুত্ব অপরিসীম আর সে বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে তাই তিনি বহু জায়গায় বক্তৃতা দিতে যেতেন। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কিম্বা গ্রামের উৎসব অনুষ্ঠান যেখানেই তিনি যেতেন সেখানেই শিকারের বিচিত্র সব গল্প শোনাতেন। বলতেন, বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের কথা। তিনি ব্যক্তিগতভাবে রাজাদের অনুরোধ করেন, তাঁরা যেন অকারণে শিকার না করেন । মোকামাঘাটে থাকার সময় স্থানীয় কুলিদের সঙ্গে মিশতেন দুবেলা। তাঁদের দুঃখ দুর্দশার কথা শুনতেন। পরে তাঁদের বাচ্চাদের পড়ার জন্য একটি স্কুল করে দেন জিম।
জিম করবেটের পোষা কুকুরের নাম রবীন, যার কথা ‘ম্যান ইটার অফ কুমায়ুনে’ অনেকবার লেখা হয়েছে, সেই কুকুরকে তিনি কিনেছিলেন এক পাহাড়ীর কাছ থেকে মাত্র ১৫ টাকায়। রবীনকে নানাভাবে প্রশিক্ষণ দিয়ে তাকে শিকারসঙ্গী করেছিলেন জিম। ১৯৩০ সালে এক অজানা রোগে মারা যায় কুকুরটি।জিম করবেটের পূর্বপুরুষ আয়ারল্যান্ডের অধিবাসী হলেও করবেটের বাবা ও করবেটের জন্ম কিন্তু হয়েছিল ভারতবর্ষে। জিম ছিলেন বাবার মতই দুঃসাহসী। পাহাড়ি শহর নৈনিতালে ছিল তাঁদের স্বপ্নের সুন্দর বাড়ি, ‘গার্নি হাউস’। একদিন নীরবে জিম ও দিদি ম্যাগি ‘গার্নি হাউস’ বিক্রি করে দেন স্থানীয় মিসেস কলাবতী ভার্মাকে। তারপর কেনিয়া চলে যান। পরে সেখান থেকে যান লন্ডন। ভারতবর্ষ ছাড়ার পর শিকারি জিম হয়ে ওঠেন জনপ্রিয় শিকারকাহিনি লেখক জিম করবেট। এর পাশাপাশি জিমের মাথায় তখন ফটোগ্রাফির নেশা মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। অল্প সময়ের মধ্যে তিনি হয়ে ওঠেন একজন দক্ষ ফটোগ্রাফার। সেসময় ব্রিটেনের রাজকুমারী এলিজাবেথ ও তাঁর স্বামী প্রিন্স ফিলিপেরও ছবি তোলেন তিনি। শিকারি জিম করবেট কখন যে দেখতে দেখতে বন ও বন্যপ্রাণী আন্দোলনের নেতা, জনপ্রিয় শিকারকাহিনি লেখক এবং ফটোগ্রাফার হয়ে উঠেছিলেন তা তিনি নিজেও হয়ত জানেন না।
শিকারি জিম করবেটের থেকে পশুপ্রেমিক মানবিক জিম করবেট তাই আজও প্রাসঙ্গিক। বিদেশী হলেও যিনি মনেপ্রাণে ছিলেন ভারতীয়। এককথায়, ‘ম্যান লাভার অফ কুমায়ুন’।
ব্রিটিশ আমলে শিকার একই সঙ্গে শৌর্য আর আমোদের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছিল। করবেট সাহেব কোনওদিন আমোদের শিকারে যোগ দেননি। কিন্তু এদেশের জঙ্গলে বুনো জন্তু নিকেশ করার কাজে মেতে ওঠা ব্রিটিশ পুরুষদের সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তার কথা বুঝিয়েছিলেন এক শিকারিই। যিনি ভারতের গ্রামে-গঞ্জে থাকা মানুষজনকে ভালবাসতেন। আবার এদেশে জমিদারতন্ত্র, রাজতন্ত্রের সময়ে আনন্দের খোরাক হিসেবে শিকার উৎসব হত। বনের ভেতর ফাঁকা জায়গায় তাঁবু ফেলে সকলে জড়ো হতেন। জমিদারের লোকজন যেমন থাকতেন তেমনই দক্ষ শিকারি, স্থানীয় যুবকেরাও থাকতেন। ঢাক-ঢোল পিটিয়ে নানান শব্দ করে বন্য জন্তুদের ভয় দেখিয়ে এক জায়গায় তাড়িয়ে নিয়ে গিয়ে শিকার করতেন তাঁরা।
শিকার কখনও লোকাচারও। ফাগুন থেকে জৈষ্ঠ প্রায় চার মাসের নির্দিষ্ট কোনও দিনে, পূজা-পার্বণ বা লোকাচারকে কেন্দ্র করেই এই শিকার উৎসব পালিত হত। দিন বদলেছে। সেই জমিদারতন্ত্র নেই। রাজতন্ত্রও নেই। নেই বনের সেই আদিম গভীরতা, বন্য জন্তু, বনভূমি এবং বনজ সম্পদ। পুরুলিয়ার একসময়ের গর্ব ছিল ভালুক, লেপার্ড,গাধা, বাঘ, নেকড়ে, হরিণ। এখন আর দেখা যায় না। অথচ সতেরো-আঠেরো বছর আগেও বুনো ভালুক অযোধ্যার শিরকাবাদ গ্রামের আখ বাগানে আখ খেতে আসত। বর্তমানে প্রাণীগুলো প্রায় নিশ্চিহ্নের পথে।
জলপাইগুড়ির বৈকুণ্ঠপুর বনাঞ্চলে দেখা মিলত হরিণ, শূকর-সহ নানান বন্য জন্তু এমনকি বাঘও। পশ্চিম মেদিনীপুর, বাঁকুড়া এবং ঝাড়গ্রাম জেলার বনভূমিতেও প্রায়ই দেখা মিলত হরিণ, গাধা, বাঘ, হায়না, নেকড়ে, বুনো শূকর, বনরুই অর্থাৎ পিপীলিকাভুক, শেয়াল, আরও কত কি। এখন এই প্রাণীদের বেশির ভাগই নিশ্চিহ্ন হওয়ার পথে। এখন আর দেখা যায় না। ঠিক একই রকম ভাবে পশ্চিমবঙ্গের সর্বত্র বন্য জন্তু হয় নিজেদের সংকটের সঙ্গে লড়াই করছে; না হয় নিশ্চিহ্নের পথে।
এক সময় বনে বন্যজন্তু শিকার বেআইনি ছিল না। বরং উল্টে শিকারিদের বুনো হাতি, বাঘ, নেকড়ে, হরিণ বা এই ধরনের প্রাণী শিকারে শিকারিদের প্রশাসন ব্যবহার করত। তখন বন্য জন্তুদের বেঁচে থাকার জন্য সংরক্ষণের প্রয়োজন হয়নি। কারণ বনে তাদের দেখা মিলত। সংখ্যায় বেশি ছিল। তাদের বেঁচে থাকার, বংশ রক্ষা করার পরিবেশ ছিল উপযুক্ত। কিন্তু বর্তমানে বন্যপ্রাণীদের রক্ষা জরুরি হয়ে পড়েছে।জিম করবেট, যাঁকে দেহাতি মানুষগুলো কার্পেট সাহেব বলতেন, তিনি শিকার করতেন বটে। কিন্তু সংরক্ষণের মহিমাও বুঝেছিলেন। বন এবং বন্যপ্রাণ, দুয়েরই।
ভারতীয় উপমহাদেশের ঘন জঙ্গলগুলোর আনাচে কানাচে ছড়িয়ে আছে নানা কিংবদন্তি ও উপকথা। যার অধিকাংশই হয়তো মানব মনের কল্পনাপ্রসূত। কিন্তু জিম করবেটের জীবন ছিল এমনই এক প্রকৃত কিংবদন্তি। যার কোনো অংশই কল্পনাপ্রসূত নয়। তাঁর পদচারণার ধ্বনি আজও ভারতের ঘন শ্বাপদসংকুল জঙ্গলগুলোতে প্রতিধ্বনিত হতে শোনা যায়।
Advertisement



