উৎসবের মাঝেই কাঁটার মতো বিঁধছে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের ক্রমাগত মূল্যবৃদ্ধি। রাজ্যের বেশ কিছু অংশে বন্যা হওয়াতে শাকসবজির দাম বেশ কিছুটা চড়া। নিম্ন মধ্যবিত্ত বা সাধারণ ও গরিব মানুষের কালঘাম ছুটে যায় ব্যাগ হাতে বাজারে গেলে। সবজির দামবৃদ্ধি রুখতে টাস্কফোর্স ও পুলিশকে কড়া নজরদারির নির্দেশ দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সাধারণ মানুষকে ন্যায্য দামে সবজি সরবরাহ করার জন্য তিনি ‘সুফল বাংলা’র আরও স্টল খোলার জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীকে বলেছেন। সজাগ ও সতর্ক রয়েছে নবান্ন। বন্যার অজুহাতে কলকাতার খুচরো বাজারে দাম বৃদ্ধি হওয়া উচিত নয়। পরিস্থিতি মোকাবিলায় পথে নেমেছে রাজ্য সরকার। একদিকে পণ্যের জোগান স্বাভাবিক রাখা, অন্যদিকে দাম নিয়ন্ত্রণে আনা— এই দ্বিমুখী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করাই এখন রাজ্য সরকারের লক্ষ্য।
বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, রাজ্যে এখন গরমের সবজির উৎপাদন শেষের মুখে, চাষিদের জোগানেও ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। আবার লঙ্কা, টম্যাটো, ফুলকপি ও বাঁধাকপি, পেঁয়াজ সহ একাধিক পণ্য আাসছে ভিন রাজ্য থেকে। ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দামের বিষয়টি চিন্তা বাড়াচ্ছে। যদিও পাইকারির সঙ্গে খুচরো বাজারের সবজির দামের ফারাক কমাতে নিয়মিত নজরদারি চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে রাজ্য সরকারের তৈরি টাস্ক ফোর্স, যা আশার কথা। রাজ্য সরকারের এই সদিচ্ছা ও তৎপরতা সত্ত্বেও কাজ কতটা হবে, সাধারণ মানুষ রিলিফ কতটা পাবে— তা নিয়ে সংশয়ের অবকাশ আছে।
Advertisement
সবজির দাম বৃদ্ধির গুণাগার দিতে হচ্ছে আমজনতাকে। আমজনতার এই সর্বনাশে কৃষক সমাজের কিন্তু পেষৈ মাস আসছে না। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের সমীক্ষা রিপোর্ট বলছে, খুচরো বাজারে যে দামে পণ্য কিনছে ক্রেতারা, চাষিরা গড়ে তার ৪০ শতাংশ দামও পাচ্ছে না। যেমন আলুতে ১০০ টাকার মধ্যে কৃষকের প্রাপ্তি ৩৬.৭ শতাংশ, পেঁয়াজে ৩৬.২ শতাংশ, টম্যাটোয় ৩৩.৫ শতাংশ। আবার কলায় প্রাপ্তি ৩০.৮ শতাংশ, আমে ৪২ শতাংশ ইত্যাদি। এর অর্থ, পণ্যের বাজার-দরের সিংহভাগ লুঠ করে নিচ্ছে মধ্যস্বত্বভোগীরা, যারা কৃষক ও ক্রেতাদের মধ্যে যোগসূত্র হিসেবে কাজ করছে। অথচ কৃষক যাতে ফসলের ন্যায্য দাম পায়, ক্রেতা যাতে স্থানীয় বাজার থেকে সঠিক মূল্যে পণ্য কিনতে পারে— তা নিশ্চিত করতে যোগসূত্রকারীর ভূমিকা পালন করার কথা প্রশাসনের। কেন্দ্র-রাজ্য দু’পক্ষই যথাযথভাবে এই দায়িত্ব পালন করলে দাম অনেকটা নিয়ন্ত্রণে থাকতে পারতো। কিন্তু এই মধ্যস্বত্বভোগী দালালরাজ একটা প্রাতিষ্ঠানিক চেহারা নেওয়ায় তার ফল ভুগতে হচ্ছে ক্রেতা-বিক্রেতা সকলকে।
Advertisement
যদিও ভোট এলে ‘কৃষক দরদি’ সাজতে প্রতিশ্রুতির কোনও ফাঁক রাখে না মোদী সরকার। ২০১৯ সালে লোকসভা ভোটের সময় বিজেপির ঘোষণা ছিল, ক্ষমতায় এলে তিন বছরের মধ্যে কৃষকের আয় দ্বিগুণ হবে। ঘটনা হল, ২০১৫-১৬ অর্থবর্ষে একজন কৃষকের মাথাপিছু আয় ছিল ৯৬ হাজার ৭০৩ টাকা। ২০২২-২৩ সালে তা বেড়ে হয় বছরে ২ লক্ষ ৭১ হাজার ৩৭৮ টাকা। এই সময়কালে মূল্যবৃদ্ধির হার যোগ করলেও আয় দ্বিগুণ হয় না। রিপোর্ট বলছে, মনমোহন সিংয়ের আমলে দশ বছরে কৃষকদের আয় বৃদ্ধির বার্ষিক হার ছিল ৩ শতাংশ। মোদী জমানায় তা কমে হয়েছে ২.৮ শতাংশ (২০২১ সালে)। এর অর্থ, প্রতিশ্রুতি ও বাস্তবে বিরাট ফারাক।
প্রতিমাসে খাবারের দাম বাড়া-কমা নিয়ে সমীক্ষা চালায় ক্রেডিট রেটিং সংস্থা ক্রিসিল। তাদের সাম্প্রতিক রিপোর্ট বলছে, গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে এক থালা নিরামিষ খাবারের দাম ছিল গড়ে ২৮ টাকা ১০ পয়সা। ২০২৪-এর সেপ্টেম্বরে তা বেড়ে হয়েছে ৩১ টাকা ৩০ পয়সা। এই নিরামিষ থালির মধ্যে ধরা হয়েছে রুটি, ভাত, আলু-টম্যাটো ও পেঁয়াজের তরকারি, ডাল, দই ও স্যালাড। দাম বৃদ্ধির কারণ হল, গত এক বছরে পেঁয়াজ, আলু ও টম্যাটোর দাম বেড়েছে যথাক্রমে ৫৩, ৫০ ও ১৮ শতাংশ। রবি ফসল হিসেবে পেঁয়াজের উৎপাদন হ্রাস, পাঁচ মাসে অসময়ে বৃষ্টির কারণে আলু চাষে ক্ষতি এবং অতিবৃষ্টির কারণে টম্যাটোর উৎপাদন কমে যাওয়ায় দাম বেড়েছে নিরামিষ থালির।
কাঁচা বাজার থেকে রান্না করা খাবার— আগুনে দামের হাত থেকে রেহাই নেই আমজনতার। এই আগুন সহজে নেভার নয়। প্রতিশ্রুতি আর কঠিন বাস্তবের ফারাকটা এখন বুঝতে পারছেন সাধারণ মানুষ।
Advertisement



