শোভনলাল চক্রবর্তী
আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা কৃত্রিম মেধা নিয়ে দুনিয়া জুড়ে বিস্তর শোরগোল। যন্ত্রমেধা আশীর্বাদ না অভিশাপ, সে-প্রশ্নের উত্তর খুঁজছেন তথ্যপ্রযুক্তির বিশেষজ্ঞ থেকে শুরু করে নাগরিক চণ্ডীমণ্ডপের সর্ববিদ্যা বিশারদ কথককুল অবধি সকলেই, প্রতি দিন ‘এআই’ সম্পর্কে নিত্যনতুন চিন্তার খোরাক নিয়ে আসছে নানা বক্তৃতা, রকমারি প্রতিবেদন, বিস্তর প্রবন্ধ এবং বইপত্র। এই অন্তহীন কথাসরিৎসাগরে একটি নতুন কথা যোগ করেছে ভারতের একটি সংস্থা। কথাটি কেবল নতুন নয়, অভিনব। দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ এআই-বিশেষজ্ঞরাও এ পর্যন্ত তেমন কথা ভেবে উঠতে পারেননি। সংস্থাটির নাম: অল ইন্ডিয়া কাউন্সিল ফর টেকনিক্যাল এডুকেশন বা এআইসিটিই। এঞ্জিনিয়ারিং কলেজ-সহ দেশের প্রযুক্তি শিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলিতে যথাযথভাবে পঠনপাঠন চালানোর ব্যাপারে নির্দেশ দেওয়া, সাহায্য করা এবং তদারকি করাই এই সংস্থার প্রধান কর্তব্য। এআইসিটিই নতুন বছর উপলক্ষে প্রযুক্তি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিকে বার্তা পাঠিয়েছে। শুভেচ্ছার বার্তা, অনুপ্রেরণারও। এমন বার্তা পাঠানো নিতান্তই বার্ষিক রীতি। কিন্তু এ বছরের বার্তাটিতে প্রচলিত রীতির গণ্ডি অতিক্রম করে এক অ-সামান্য প্রজ্ঞার বাণী সংযুক্ত করেছেন তদারকি সংস্থার পরিচালকেরা। সেই বাণী কেবল চমৎকৃত করে না, স্তম্ভিত করে দেয়। কী সেই বাণী?নববর্ষের ওই নববার্তায় লেখা হয়েছে যে, এই বছরটি যন্ত্রমেধার কুম্ভমেলায় পরিণত হতে চলেছে। গঙ্গা যমুনা এবং (লুপ্ত বা কল্পিত) সরস্বতীর ত্রিবেণীসঙ্গমে যেমন কুম্ভমেলার সমারোহ বসে, এআই নামক প্রযুক্তিও তেমনই এক মহাসঙ্গমের পরিসর হয়ে উঠবে। তাঁদের বক্তব্য, কৃত্রিম মেধা তিনটি বস্তুর সম্মিলনে সঞ্জাত: ডেটা বা তথ্য, অ্যালগরিদম বা সূত্রমালা এবং কম্পিউটেশনাল পাওয়ার বা গণনাশক্তি। এমন তিনটি রূপকের ত্র্যহস্পর্শ বাস্তবিকই সাহারায় শিহরন জাগাতে পারে। কিন্তু এইটুকু সৃষ্টি করেই এআইসিটিই-র স্রষ্টারা সন্তুষ্ট বা নিরস্ত হননি, ত্রিবেণীর তিনটি ‘বেণী’কেও নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন তাঁরা— তথ্য হল গঙ্গা, সূত্রমালা যমুনা এবং গণনাশক্তি সরস্বতী। কেন, কোন হিসাবে এই পরিচিতিগুলিই নির্ধারিত হল, অন্য রকম হল না, তার কোনও ব্যাখ্যা অবশ্য এখনও পাওয়া যায়নি। হয়তো ক্রমে ক্রমে সেই রহস্যও জানা যাবে। কে বলতে পারে, অচিরেই হয়তো প্রযুক্তিবিদ্যার শিক্ষক বা ছাত্রছাত্রীদের এই বিষয়ে গবেষণা করতে হবে— তথ্য-গঙ্গা, যমুনা-সূত্র এবং সরস্বতী-গণনা নিয়ে ‘ইন্ডিয়ান নলেজ সিস্টেম’ সংক্রান্ত বড় বড় সম্মেলনে লম্বা লম্বা অধিবেশন হবে, সেখানে রাশি রাশি গবেষণাপত্র পঠিত হবে। কষ্টকল্পিত কৌতুক? উদ্ভটরসের রসিকতা? যে দেশে প্রযুক্তিশিক্ষার অধিকর্তারা যন্ত্রমেধাকে অবলীলাক্রমে কুম্ভমেলা বানিয়ে দেন, সেখানে বাস্তবের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার সাধ্য কোনও কল্পনাশক্তি বা উদ্ভটরসের থাকতে পারে না।
তবে কিনা, এই উদ্ভট এবং উৎকট বার্তাটির প্রকৃত কার্যকারণসূত্র বুঝে নিতে বিশেষ কোনও সমস্যা নেই। মনে রাখতে হবে, এই বছর অনুষ্ঠিত হতে চলেছে মহাকুম্ভ। কুম্ভমেলার এই রাজকীয় তথা মেগা তথা ম্যাগনাম সংস্করণটি বারো বছর অন্তর ইলাহাবাদে গঙ্গা-যমুনার মিলনভূমিতে ফিরে আসে। এ বার তার বিশেষ মহিমা। কারণ, ভারত শাসন করছেন নরেন্দ্র মোদী, উত্তরপ্রদেশের গদিতে অধিষ্ঠিত যোগী আদিত্যনাথ এবং ইলাহাবাদের নাম হয়েছে প্রয়াগরাজ। এ-ও এক ত্র্যহস্পর্শ বইকি। এই ত্রিধারার প্রকৃত উৎস অবশ্যই সঙ্ঘ পরিবারের হিন্দুত্ববাদ। এই বস্তুটি কেবল রাজনীতির পরিসরে তার আধিপত্য বিস্তার করে ক্ষান্ত হয়নি, আপন ধ্যানধারণা চারিয়ে দিয়ে চলেছে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। বিশেষ করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পরিচালকদের চিন্তায় ও মানসিকতায় এক ধরনের যুক্তিহীন অতীতচারী কুসংস্কারের দাপট বেড়ে চলেছে ভয়াবহ ভাবে। এই ভূতগ্রস্ত মানসিক অন্ধকারই গণেশের প্রতিমায় প্রাচীন ভারতে প্লাস্টিক সার্জারির প্রমাণ খুঁজে পায়, এর প্রভাবেই প্রযুক্তিবিদরা যন্ত্রমেধাকে অমৃতকুম্ভে পরিবেশন করতে ব্যস্ত হয়ে ওঠেন। তাঁরা সত্যই এই সব উদ্ভট কথা ভাবেন, না কি মহাকুম্ভের বছরটির সূচনায় ক্ষমতার অধীশ্বরদের খুশি করার জন্য এমন বার্তা উদ্ভাবন করেছেন, সে প্রশ্ন থেকেই যাবে। কিন্তু এই বিষয়ে কোনও প্রশ্ন থাকতে পারে না যে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মুক্তচিন্তার শ্বাস রোধ করে তার বদলে এই ধরনের অবান্তর ও অর্থহীন ধারণার প্রচার যত বাড়বে, প্রকৃত শিক্ষার দুর্দিন তত ঘনিয়ে উঠবে।
সালতামামি লিখতে বসলে অতঃপর যে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা কৃত্রিম মেধাকে উপেক্ষা করার কোনও প্রশ্নই উঠবে না, তা এখন প্রতিষ্ঠিত। এআই এখন সৃষ্টিশীল— জেনারেটিভ; যাকে নির্দেশ দিলে সে সেই মতো ছবি, ভিডিয়ো, গান, লেখা, কথোপকথন তৈরি করে দেবে। এতে কার্যক্ষেত্রে সুবিধা প্রচুর হয়েছে। পাঁচশো পৃষ্ঠার বই থেকে কৃত্রিম মেধা নিমেষে ৫-১০ পৃষ্ঠার সারমর্ম বার করে দেবে; জানিয়ে দেবে যে কোনও বিস্তৃত বিতর্কের সারমর্মটুকু।যাচাই করে দেবে তথ্যের সত্যতা— তবে তার বিশ্লেষণও নিরপেক্ষ না হতে পারে। সেটা নির্ভর করছে সেই এআই মডেলকে কী ধরনের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে, তার উপরে।স্টক মার্কেট গণনা থেকে বাণিজ্যেও এআই-এর ভূমিকা এখন চোখে পড়ার মতো। কোনও বিশেষ ক্ষেত্রে একটি বিশেষ স্টার্ট-আপ হয়তো কাজ শুরু করতে চাইছে। এআই জানিয়ে দিতে পারে, গত দশ বছরে ওই বিশেষ ক্ষেত্রে কোন কোন সংস্থা কাজ করেছে; তাদের স্টক মার্কেট, বার্ষিক রিপোর্ট সমস্ত ঘেঁটে হিসাব তৈরি করে জানিয়ে দেবে যে, ওই ক্ষেত্রে ব্যবসা শুরু করা লাভজনক হবে কি না। তা ছাড়া বেশির ভাগ স্টার্ট-আপই এখন এআই-কেন্দ্রিক। ফলে, নতুন প্রজন্মের চাকরির বাজারে এখন এআই শিখে আসা প্রায় বাধ্যতামূলক।
এ সবই ‘অ্যাসিস্টিভ টেকনোলজি’ বা সহায়ক প্রযুক্তি। একা মানুষের পক্ষে অসম্ভব এক সঙ্গে প্রচুর পরিমাণে তথ্য যাচাই করা। সেখানেএই টুল সাহায্য করছে, বেশ কিছু তথ্য ঘেঁটে একটা পরামর্শ বা সিদ্ধান্ত তৈরি করার। সেই পরামর্শ গ্রহণ করা বা না করা মানুষের উপরে। এআই মডেল আদর্শ বা নিরপেক্ষ কখনওই হবে না, কারণ মানুষই যন্ত্রকে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। মানুষের পক্ষপাত দোষ থাকলে, তারও থাকবে। উত্তর পছন্দ না হলেতাকে অনুরোধ করা যেতে পারে, নিরপেক্ষ জবাব দিতে। চেষ্টা সে করবে, কিন্তু সেই চেষ্টাও তার সীমিতই হবে।
তবু পক্ষপাতদুষ্ট জবাব মানুষের পক্ষে যাচাই করা সম্ভব। কিন্তু কৃত্রিম মেধার সৃষ্টিশীলতা কাজে লাগিয়ে ডিপ ফেক ভিডিয়ো ছড়িয়ে পড়ছে। যা দেখে মানুষের পক্ষে কোনও ভাবেই বোঝা সম্ভব না তা আসল না নকল। ‘ভয়েস ক্লোনিং’-এর মাধ্যমে এক জনের নামে অন্য কারও কণ্ঠস্বর বসিয়ে দেওয়া যাচ্ছে। রাজনীতি থেকে পর্নোগ্রাফি, সর্বত্র এর ব্যবহার চলছে। তথ্য যাচাইয়ের প্রযুক্তি ব্যবহার করে বোঝা যেতে পারে, কোন ভিডিয়োটি আসল, আর কোনটি ভুয়ো। কিন্তু তা-ও যে নিরপেক্ষ হবে, সে নিশ্চয়তা নেই। তার উপরে, তথ্য যাচাইকারী প্রতিষ্ঠানের কাছে মানবসম্পদ সীমিত। ফলে, তথ্য যাচাই করার আগেই তা ছড়িয়ে পড়ে, এবং যা ক্ষতি হওয়ার হয়ে যায়।
পড়াশোনার জন্য কৃত্রিম মেধার সাহায্য অন্য মাত্রা এনে দিয়েছে। প্রচলিত সার্চ ইঞ্জিনের কাছে জানতে চাইলে সে কোনও ফর্মুলা বা থিয়োরি জানিয়ে দেবে। কিন্তু কোনও বিষয় পড়তে গেলে কী বিশেষ থিয়োরি দেখা যেতে পারে, কৃত্রিম মেধা সেটাও দেখিয়ে দেবে। অন্য ভাষা শেখাও এর মাধ্যমে সহজ হয়ে গিয়েছে। মুশকিল হচ্ছে, পড়ুয়ারা নিজের মেধার বদলে কৃত্রিম মেধার সাহায্যেই পরীক্ষার প্রশ্নের উত্তর বানাচ্ছে। ফলে সার্বিক ভাবে তাদের বৌদ্ধিক বিকাশ বাধা পাচ্ছে। এমনকি শিক্ষকেরাও কৃত্রিম মেধার ভরসায় প্রশ্ন তৈরি করছেন, পড়াচ্ছেন। তাতে এক মস্ত সমস্যার সম্ভাবনা। ধরা যাক, কোনও শিক্ষক এআইকে কোনও বিষয়ে খুব কঠিন প্রশ্ন বানাতে বললেন। সে তেমন প্রশ্ন, তার উত্তর সবই তৈরি করে দিচ্ছে। কিন্তু এআই যে-হেতু ‘হ্যালুসিনেশন’-প্রবণ, ফলে সে অবিকল ঠিক দেখতে ভুল উত্তর তৈরি করতে পারে। শিক্ষক সতর্ক না হলে ঘোর বিপদ। এমনকি স্বাস্থ্যক্ষেত্রেও দেখা যাচ্ছে ‘চ্যাটজিপিটি’কে জিজ্ঞাসা করে চিকিৎসা করছেন হয়তো হাতুড়েরা। এ বার, চ্যাটজিপিটির উত্তর অত্যন্ত বিশ্বাসযোগ্য হয়। বিষয়ের প্রতি গভীর জ্ঞান না থাকলে তার ভুল ধরা প্রায় অসম্ভব। যাঁরা বিশেষজ্ঞ, চ্যাটজিপিটি তাঁদের জন্য খুব উপকারী। কিন্তু অল্পবিদ্যা সম্বল করে এর প্রয়োগ করতে গেলে ব্যবহারকারীকে এআই বোকা বানিয়ে রেখে দেবে। অনেক গবেষকও দেখা গিয়েছে অনেক সময়ে এআইয়ের অনেক ভুল ধরতে সক্ষম হননি।
কৃষির প্রগতিতেও এআই অপরিহার্য হয়ে উঠছে। নতুন সার তৈরি, আবহাওয়ার পূর্বাভাস, কৃষকদের কখন কোথায় কোন বীজ বোনা প্রয়োজন সে ব্যাপারে অবগত করা— এ সবই অনেক যথাযথ ভাবে সম্ভব এআইয়ের সাহায্যে। কৃষক শুধুমাত্র মাটির ছবি তুলে আপলোড করে দিলেই অ্যাপ বলে দেবে সেখানে চাষ সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য।
সাধারণ মানুষের একাকিত্ব কাটাতেও কৃত্রিম মেধা পাশে দাঁড়াচ্ছে। পছন্দমতো মানুষের এআই ‘অবতার’ তৈরি করে মানুষ তার সঙ্গে মন খুলে কথোপকথন চালাচ্ছে নীতি পুলিশি বা সালিশির ভয় ছাড়াই। সেটা এক রকম ভাবে মানসিক থেরাপির কাজও করছে। আবার সেই চ্যাটবটের উপরে মানুষের নির্ভরতা এমন বেড়ে যাচ্ছে যে, কোনও সমস্যার অলীক সমাধানকেও সে গ্রাহ্য করছে না। ধরা যাক, চ্যাটবট কখনও পরামর্শ দিচ্ছে, এক তলার ছাদ থেকে ঝাঁপ মেরে দিতে, তা হলে হয়তো বড় জোর পা ভাঙবে, কিন্তু তোমার সমস্যার গুরুত্ব বাকিরা বুঝবে। বা চ্যাটবটের পরামর্শে মাদক চক্রে জড়িয়ে পড়েছে ব্যবহারকারী, এমন দৃষ্টান্তও পাওয়া গিয়েছে। ফলে এর কথোপকথনের মানও এখনও যথেষ্ট নৈতিক বা গঠনমূলক নয়।
এআই ব্যবহার করে নতুন ওষুধ, রোগ নির্ধারণ পদ্ধতি, নতুন অণু-পরমাণু বানানো হচ্ছে। ফলে সমস্ত কাজেই এআই প্রযুক্তিকে এখন গ্রহণ করতে হবে। কিন্তু অ-আ শেখানোর মতো করে এআই ব্যবহার করার সঠিক পদ্ধতি শেখাতে হবে। ইতিমধ্যে এআই নির্ভর ভবিষ্যৎ গড়ার নিরিখে গ্লোবাল ইন্ডেক্সে ভারত চতুর্থ স্থানে রয়েছে। এআই ব্যবহারের নীতি নির্ধারণ করতে পারলে, ক্ষেত্র ভেদে তার আলাদা নির্দেশিকা বানাতে পারলে তবেই এ দেশে শুধু এর ব্যাপক নয়, সুষ্ঠু অতএব ইতিবাচক প্রয়োগ আশা করা যায়।
নতুন প্রযুক্তিকে গ্রহণ করতেই হবে, কারণ সেটাই ভবিষ্যৎ। কৃত্রিম মেধার ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। কিন্তু, তার সঠিক ব্যবহার বা প্রতি ক্ষেত্রে তার স্বীকারোক্তি উল্লেখ করা বাঞ্ছনীয়। নৈতিক উপায়ে এআই ব্যবহার করারও নির্দিষ্ট নির্দেশিকা তৈরি প্রয়োজন শিক্ষায়, প্রশাসনিক কর্মসূচিতে, শিল্পে, আইনে, সংবাদমাধ্যমে।