পুলক মিত্র
পৃথিবীর গভীর গভীরতর অসুখ এখন, জীবনানন্দের এই কবিতার অনুরণন এখন যেন গোটা বিশ্বে দেখা যাচ্ছে। এক অদ্ভূত, অস্থির পরিস্থিতির মুখোমুখি সভ্য মানবসমাজ। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের মাঝেই এবার একেবারে সম্মুখ সমরে ইজরায়েল ও ইরান। গত বৃহস্পতিবার (১২ জুন) রাষ্ট্রসংঘ নিয়ন্ত্রণাধীন আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা (আইএইএ)-র ডিরেক্টর জেনারেল রাফায়েল মারিয়ানো গ্রোসি এক রিপোর্টে আন্তর্জাতিক বিধিনিষেধ ভেঙে ইরানের বিরুদ্ধে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কর্মসূচি চালানোর অভিযোগ তুলেছিলেন। তার কয়েক ঘণ্টা কাটতে না কাটতেই ইরানের বিভিন্ন পরমাণুকেন্দ্র ও গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ঘাঁটিতে হামলা চালাতে শুরু করে ইজরায়েলি বিমানবাহিনী।
ইজরায়েল এই অভিযানের নাম দিয়েছে ‘অপারেশন রাইজিং লায়ন’, যা তছনছ করে দিয়েছে ইরানের অন্তত ছ’টি পরমাণু ও সামরিক কেন্দ্র। দু’শোর বেশি বোমারু ও যু্দ্ধবিমানের হানায় ইরান সেনার একাধিক শীর্ষস্থানীয় কমান্ডার এবং পরমাণু বিজ্ঞানীর মৃত্যু হয়। ইরানও পাল্টা ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়ে যাচ্ছে।
ইরান কি পরমাণু বোমা তৈরি করে ফেলেছে? এই প্রশ্ন নিয়ে গত বেশ কিছুকাল ধরে সন্দেহের মেঘ তৈরি হয়েছে। সাধারণভাবে পরমাণু বোমা তৈরি করতে গেলে ৯০ শতাংশ পরিশুদ্ধ ইউরেনিয়াম প্রয়োজন হয়। এখনও পর্যন্ত ইরান সেই দক্ষতা অর্জন করতে পারেনি বলে আইএইএ-র পর্যবেক্ষকদের ধারণা করছেন। তবে ৪২ কিলোগ্রাম ৬০ শতাংশ সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম ব্যবহার করে কম ক্ষমতাসম্পন্ন পরমাণু বোমা বানানো সম্ভব। কিন্তু তা থেকে পরমাণু তেজস্ক্রিয়তা ছড়ানোর আশঙ্কা থাকে।
চলতি বছরের ৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ইরান প্রায় ২৭৫ কিলোগ্রাম ৬০ শতাংশ পরিশুদ্ধ ইউরেনিয়াম তৈরির কাজে সফল হয়েছে। আইএইএ-র গত নভেম্বরের রিপোর্টে বলা হয়েছিল, তেহরানের হাতে সাড়ে ৯২ কিলোগ্রাম ৬০ শতাংশ পরিশুদ্ধ ইউরেনিয়াম রয়েছে। পশ্চিম এশিয়ার একাধিক সংবাদমাধ্যমের দাবি অনুযায়ী, পরমাণু সেন্ট্রিফিউজ (যা অস্ত্র নির্মাণের কাজে ব্যবহৃত হয়) তৈরির কাজেও সাফল্য পেয়েছে ইরান।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতোল্লা আলি খামেনেই এবং প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেকশিয়ানকে বারবার হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, পরমাণু চুক্তি সই করে ইউরেনিয়াম পরিশোধন কর্মসূচি বন্ধ না করলে আরও ভয়ঙ্কর পরিণতির মুখোমুখি হতে হবে। তবে সেই সঙ্গে ইরান যে এখনও পর্যন্ত পরমাণু বোমা তৈরি করতে পারেনি, তাও স্বীকার করে নিয়েছেন ট্রাম্প। তেহরানও বারংবার জোর দিয়ে বলেছে, শুধুমাত্র বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং অন্যান্য শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যেই ব্যবহারের জন্য তারা পারমাণবিক কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। কিন্তু তাতে যে কাজের কাজ কিছুই হয়নি, তা সংঘাত থেকেই স্পষ্ট।
ইরানের ‘ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিক রাজধানী’ হিসেবে পরিচিত কোম শহরের জামকারান মসজিদের চূড়ায় জুম্মার নমাজের পর লাল পতাকা তুলে কার্যত যুদ্ধ ঘোষণা করে দেওয়া হয়েছে। বোঝাই যাচ্ছে পরিস্থিতি বেশ ঘোরালো। এটি শুধুমাত্র ইরান-ইজরায়েলের সংঘাত নয়, এর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে বিশ্বের বহু দেশের নানা স্বার্থ। পশ্চিম এশিয়ায় থাকা মার্কিন সেনাঘাঁটিগুলির নিরাপত্তা নিয়ে রীতিমতো উদ্বিগ্ন আমেরিকা।
পরমাণু চুক্তি সইয়ের জন্য ট্রাম্প এখন প্রকাশ্যে হুঁশিয়ারি দিলেও, বর্তমান পরিস্থিতির জন্য তিনি কম দায়ী নন। ২০১৫ সালে তদানীন্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার আমলে ইরানের সঙ্গে তিন বছরের পরমাণু নিরস্ত্রীকরণ চুক্তি করেছিল ছয় শক্তিধর দেশ – ব্রিটেন, ফ্রান্স, রাশিয়া, জার্মানি, চিন এবং আমেরিকা। এই চুক্তির নাম দেওয়া হয়েছিল ‘জয়েন্ট কমপ্রিহেনসিভ প্ল্যান অফ অ্যাকশন’ (জেসিপিওএ)। চুক্তিতে বলা হয়েছিল, ইরান পরমাণু অস্ত্র তৈরি বন্ধ রাখলে, সেদেশের উপর থেকে আর্থিক নিষেধাজ্ঞা তুলে নেবে রাষ্ট্রসঙ্ঘ, আমেরিকা এবং অন্য কয়েকটি দেশ। সব পক্ষই তাতে সায় দিয়েয়েছিল। কিন্তু ২০১৮তে সেই চুক্তি ভেঙে বেরিয়ে আসেন ট্রাম্প। সে সময় তিনি বলেছিলেন, “এই পরমাণু চুক্তি ওবামার ভুল পদক্ষেপ। এতে আমেরিকার কোনও সুবিধা হয়নি। বরং লাভ হয়েছে ইরানের।”
এর পর গত বছরের শেষে আইএইএ-র এক রিপোর্টে বলা হয়, ইরান আবার ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কর্মসূচি শুরু করেছে। তাদের কাছে ৬০ শতাংশ বিশুদ্ধ ইউরেনিয়াম রয়েছে। নিরাপত্তা পরিষদে ব্রিটেন, ফ্রান্স ও জার্মানি চিঠি পাঠিয়ে জানিয়ে দেয়, ইরানের পরমাণু অস্ত্রধর দেশ হয়ে ওঠা আটকাতে তারা সব ধরনের আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা ফিরিয়ে আনতে প্রস্তুত। অন্যদিকে, মার্চের শুরুর দিকে খামেনেইকে চিঠি পাঠিয়ে পরমাণু চুক্তির খসড়া চূড়ান্ত করার জন্য দু’মাসের ‘চরম সময়সীমা’ বেঁধে দেন ট্রাম্প।
২০২৪ সালেও ইরান এবং ইজরায়েল পরস্পরের বিরুদ্ধে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছিল। কিন্তু এবারের সংঘাতের অভিঘাত মারাত্মক হতে চলেছে। সামরিক শক্তির নিরিখে অবশ্য শিয়া মুসলিম রাষ্ট্র ইরানের চেয়ে অনেকটাই এগিয়ে রয়েছে ইহুদিদের দেশ ইজরায়েল।
গাজা ভূখণ্ডে ধারাবাহিক হামলা এবং একের পর এক নেতার মৃত্যুর জেরে প্যালেস্টাইনি সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাস এখন অস্তিত্বের সঙ্কটের মুখে। লেবাননের শিয়া সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লা ইজরায়েলি সেনার আগ্রাসনে কোণঠাসা হয়ে সমঝোতার পথে হাঁটতে বাধ্য হয়েছে। আমেরিকা, ইজরায়েল, সৌদি আরবের মিলিত হামলায় ইরানের আর এক সহযোগী, ইয়েমেনের শিয়া বিদ্রোহী গোষ্ঠী হুথিরও একই অবস্থা।
তবে ইরান সবচেয়ে বড় ধাক্কা খেয়েছে গত ডিসেম্বরে। পড়শি দেশ সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধে পরাস্ত হয়ে শিয়া প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের রাশিয়ায় পলায়ন এবং তুরস্কের মদতপুষ্ট সুন্নি কট্টরপন্থী গোষ্ঠী হায়াত তাহরির আল-শাম (এইচটিএস) এবং তাদের সহযোগী ‘জৈশ আল-ইজ্জা’র যৌথবাহিনীর ক্ষমতা দখলের পর।
গত সাড়ে তিন বছর ধরে ইউক্রেনে যুদ্ধ চালাচ্ছে ইরানের দীর্ঘদিনের সামরিক সহযোগী রাশিয়াও। তাই এ বার রাশিয়া কতটা সহায়তা করতে পারবে, তা নিয়েও সংশয় রয়েছে। পাশাপাশি প্রতিবেশী দেশ জর্ডন ইরানের উপর হামলা চালাতে ইজরায়েলি যুদ্ধবিমানকে আকাশসীমা ব্যবহার করতে দেওয়ায় ইরান আরও চাপে পড়েছে।
ইরানের পরমাণু কেন্দ্রগুলির কতটা ক্ষতি করতে পেরেছে ইজরায়েল, সে সম্পর্কেও কোনও কোনও মহলে সংশয় তৈরি হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের একাংশের মতে, ইরান তাদের ভূগর্ভস্থ পরমাণু কেন্দ্রগুলির সুরক্ষার জন্য যে বিশেষ ধরনের কংক্রিট ব্যবহার করে, তা কার্যত দুর্ভেদ্য। তাঁদের মতে, ভূপৃষ্ঠের ৫০০ মিটারেরও বেশি গভীরে তৈরি করা ওই কংক্রিটের বহুস্তরীয় সুরক্ষাকবচ পরমাণু হামলা ছাড়া ধ্বংস করা সম্ভব নয়।
যাই হোক, ইজরায়েল-ইরানের এই সংঘাতের আঁচ ভারতের ওপর পড়বে? এ প্রসঙ্গে চাবাহার বন্দরের কথা বলা যেতে পারে। এই বন্দর ব্যবহার করা নিয়ে গত বছর এক চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে ভারত। ইরানের বন্দরটি শুধু একটি ভারত-ইরান দ্বিপাক্ষিক প্রকল্প নয়, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে উত্তর-দক্ষিণ পরিবহণ করিডোর (আইএনএসটিসি)-এর একটি গুরুত্বপূর্ণ সামুদ্রিক যোগাযোগ ব্যবস্থা। ৭,২০০ কিলোমিটার দীর্ঘ মাল্টিমোডাল সংযোগ প্রকল্প ভারতকে ককেশাস, ইরান, রাশিয়া ও মধ্য এশিয়ার মাধ্যমে ইউরোপের সঙ্গে সংযুক্ত করবে।
আইএনএসটিসি ভারত ও ইউরোপের মধ্যে ট্রানজিট সময় ৪০% এবং ট্রানজিট খরচ ৩০% কমিয়ে দেবে বলে মনে করা হয়েছে। কান্ডলা ও মুম্বই বন্দর থেকে চাবাহারের দূরত্ব যথাক্রমে ৮৮৫ কিমি এবং ১,২৬৫ কিলোমিটার। চাবাহার-জাহেদান রেলপথ (২০২৫ সালে চালু হওয়ার কথা) এবং ভারতের তৈরি ডেলারাম-জারঞ্জ হাইওয়ের মাধ্যমে সম্পদসমৃদ্ধ মধ্য এশিয়া ও আফগানিস্তানের সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে উঠবে। এটি হল একটি বিকল্প বাণিজ্যিক পথ, যা পাকিস্তানকে এড়িয়ে মধ্য এশিয়া ও আফগানিস্তানের সাথে বাণিজ্য করতে সাহায্য করবে। এর ফলে ভারতের রপ্তানি সরবরাহ শৃঙ্খলগুলির জন্য নতুন বাজার উন্মুক্ত হবে। ওমান উপসাগরের পাশে অবস্থিত চাবাহার ইরানের একমাত্র গভীর সমুদ্র বন্দর এবং ভারতের কাছে কৌশলগত এবং অর্থনৈতিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ।
উত্তর-দক্ষিণ করিডোরের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, হল চাবাহার বন্দর, যা ভারত, ইরান, রাশিয়া, ইউরোপ ও মধ্য এশিয়ার মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন করেছে। এই বন্দরের মাধ্যমে ভারত রাশিয়া, মধ্য এশিয়া এবং আফগানিস্তানের সাথে বাণিজ্য করতে পারছে।
ভারতের জন্য ইরানে প্রবেশ করার একটি সহজ পথ তৈরি করেছে চাবাহার বন্দর। চাবাহার থেকে আফগানিস্তানের খনিজ সমৃদ্ধ হাজিগাক অঞ্চলে একটি রেলপথ নির্মাণের পরিকল্পনা করছে ভারত। এই বন্দর ব্যবহার করে রাশিয়া থেকে কয়লাও আমদানি করছে ভারত। ইজরায়েল ভারতের দীর্ঘদিনের বন্ধু। অন্যদিকে, ইরানের সঙ্গেও ভারতের সুসম্পর্ক রয়েছে। তাই কূটনৈতিকভাবে ভারতকে অত্যন্ত সতর্ক হয়ে পা ফেলতে হবে। কারণ, ভারতের প্রয়োজন রয়েছে দুই দেশকেই।