শোভনলাল চক্রবর্তী
ষষ্ঠীর রাতে কি ক্রিকেটই দেখতে বসেছিলাম? না কি অন্যকিছুকে ক্রিকেট ভেবে ভুল করেছি? মনে হচ্ছিল, স্পোর্টসের ‘গো অ্যাজ় ইউ লাইক’ হচ্ছে। ক্রিকেটারেরা দু’দেশের সেনাবাহিনীর উর্দি পরে মাঠে নেমেছে। টিভি-তে সেই যুদ্ধের রিয়্যালিটি শো দেখছি।সেপ্টেম্বরের ৯ থেকে ২৮ তারিখ পর্যন্ত মরুদেশে যে এশিয়া কাপ হল, তা যে আদৌ ক্রিকেট ছিল না, ষষ্ঠীর রাতের পরে তা নিয়ে ধোঁয়াশার বিশেষ কারণ দেখছি না। বিশেষত, যখন পাকিস্তানকে হারানোর অব্যবহিত পরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী টুইট করলেন সেই জয়কে ‘অপারেশন সিঁদুর’-এর সঙ্গে তুলনা করে। মনে হচ্ছিল, টুইটটা তৈরিই ছিল। স্রেফ বোতামটা টিপে দেওয়া হয়েছে। রাজনীতিকেরা অবশ্য এমন করেই থাকেন। কিন্তু একই সঙ্গে শিহরিত হচ্ছিলাম ভেবে যে, কী হত যদি তিলক বর্মা ওই ভয়াবহ চাপের মুখে অমন ডাকাবুকো ইনিংস না খেলতেন? যদি ভারত হেরে যেত? ১৪৬ রান তাড়া করতে গিয়েই পা পিছলে গিয়েছিল প্রায়। যদি পাকিস্তান আরও গোটা চল্লিশেক রান বেশি করত? ক্রিকেট-ঈশ্বর না করুন, তা হলে তো সূর্যকুমার যাদবকে কোতল করা হত! ভারতীয় দলকে ঝোলানো হত ফাঁসিকাঠে!
Advertisement
দিস ইজ নট ক্রিকেট। মনে আছে আমদের স্কুলে ক্লাস নাইনের ফাইনাল পরীক্ষায় ইংরেজি পত্রে এই বিষয় নিয়ে অনূর্ধ্ব একশ শব্দের একটি নিবন্ধ লিখতে বলা হয়েছিল। যা কিছু অশোভনীয়, যা কিছু অন্যায়,যা কিছু স্বভাববিরুদ্ধ তাকেই আমরা এই বাক্যটি দিয়ে বোঝাতে পারি। সাম্প্রতিক কালে এশিয়া কাপে ভারত পাকিস্তান দ্বৈরথের প্রেক্ষিতে বাক্যটি আবার মনে পড়ল। এশিয়া কাপে পাকিস্তানকে তিনবার হারিয়েছে ভারত। ফাইনাল জিতেছেন। সুপার ফোরে ৬ উইকেটে জিতেছেন সূর্যকুমার যাদবেরা। টানা ম্যাচ জিতে ফুরফুরে রয়েছে ভারতীয় শিবির। সাজঘরের সেই ছবি প্রকাশ্যে এসেছে। জয়ের পর সাজঘরে ‘রাম রাম’ ধ্বনিও শোনা গিয়েছে। ‘ইমপ্যাক্ট প্লেয়ার’-এর পদক নিতে গিয়ে সাপোর্ট স্টাফের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতে যান তিলক বর্মা। তা দেখে হেসে গড়িয়ে পড়েন বাকিরা। সমাজমাধ্যমে একটি ভিডিয়ো পোস্ট করে বিসিসিআই। সেখানে ‘ইমপ্যাক্ট প্লেয়ার’ হিসাবে নির্বাচিত করা হয় তিলককে। ম্যাচের সেরার পুরস্কার না পেলেও ভারতের যে ক্রিকেটার উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন তাঁকে এই পুরস্কার দেওয়া হয়। সেটা পান তিলক বর্মা।পদক দেওয়ার আগে গুরুগম্ভীর ভাষণ দেন দলের থ্রোডাউন বিশেষজ্ঞ রাঘবেন্দ্র দিবজি ওরফে রঘু। তিনি বলেন, “সকলকে জানাই, রাম রাম। প্রতিভা ঈশ্বরের দেওয়া, নম্র থাকো। খ্যাতি মানুষের দেওয়া, কৃতজ্ঞ থাকো। মনঃসংযোগ নিজের তৈরি করা, খুব সাবধানে থাকো। অনুপ্রেরণা সাময়িক, শৃঙ্খলা চিরস্থায়ী। এই ম্যাচে কেউ নিখুঁত খেলেনি। সকলকে শিক্ষা নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। খ্যাতি ঈশ্বরের কাছে পৌঁছয়, ঈশ্বর মহান। সাফল্য কখনও শেষ হয় না। ব্যর্থতা কখনও চূড়ান্ত হয় না।”রঘুর কথা নাকি মুগ্ধ হয়ে শোনে ভারতীয় দল। শেষ হতেই প্রত্যেকে হাততালি দেন। এর পর তিলককে ডেকে নেন রঘু। তিলক এসেই নিচু হয়ে রঘুকে প্রণাম করতে যান। রঘু করতে দেননি। তবে তিলকের কাণ্ড দেখে হেসে গড়িয়ে পড়েন বাকি ক্রিকেটারেরা।পদক পেয়ে তিলক বলেন, “গত দুটো ম্যাচই শেষ করে আসার কথা ভেবেছিলাম। পারিনি। আজ সুযোগ এসেছিল এবং দলের জন্য নিজের কাজটা করতে পেরেছি। প্রতিযোগিতার শেষ পর্যন্ত এই মানসিকতাই ধরে রাখার চেষ্টা করব। গৌতি স্যর (ইনি সেই স্যার যার নির্দেশে করমর্দন বয়কট করেছে ভারত) বলেছেন, বিশ্বকাপ পর্যন্ত আমাদের শিখতে হবে রোজ। সেই চেষ্টাই করব।” এই সব ঘটনার শেষে অবশেষে অবশ্য কথা বলেছেন ভারত ও পাকিস্তানের ক্রিকেটারেরা। তবে খোশগল্প নয়, ঝামেলা হয়েছে তাঁদের মধ্যে। ভারত-পাকিস্তান ম্যাচে উত্তপ্ত হল মাঠের পরিস্থিতি। এটাও সেই দিস ইজ নট ক্রিকেট।সুপার ফোরে খেলার মাঝে ভারতের দুই ওপেনার শুভমন গিল ও অভিষেক শর্মার সঙ্গে ঝামেলায় জড়ালেন পাকিস্থানের দুই বোলার শাহিন শাহ আফ্রিদি ও হ্যারিস রউফ। ২৯ বছর আগের বিশ্বকাপের স্মৃতি ফিরল এশিয়া কাপে। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ১৭২ রান তাড়া করতে নেমে ঝোড়ো ব্যাটিং শুরু করেন অভিষেক ও শুভমন। শাহিনকে প্রথম বলেই ছক্কা মারেন তিনি। শাহিনও তাঁকে পাল্টা দেওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু তাঁর লাইন-লেংথ ঠিক হচ্ছিল না। পাওয়ার প্লে চলাকালীন বিতণ্ডা বাড়তে থাকে। তাতে ঢুকে পড়েন শুভমন ও রউফও।শাহিনের দ্বিতীয় ওভারে পর পর চার মারেন শুভমন। তার পর শাহিনের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা বলেন তিনি। স্টাম্প মাইকে কথা ধরা পড়েনি। তবে শুভমনের ঠোঁটের নড়াচড়া দেখে বোঝা গিয়েছে শাহিনকে তিনি বলেছেন, “যাও, বাউন্ডারি থেকে বল কুড়িয়ে আনো।”
Advertisement
চতুর্থ ওভারে রউফের বলে বড় শট খেলেন শুভমন ও অভিষেক দু’জনেই। ভারতীয় ব্যাটারদের হাতে মার খেয়ে রউফ উত্তেজিত হয়ে পড়েন। তিনি কিছু একটা বলেন। জবাব দেন শুভমন ও অভিষেকও। পিচের মধ্যেই ঝামেলা বেধে যায়। আম্পায়ার ক্রিকেটারদের সেখান থেকে সরতে বলেন। তা-ও ঝামেলা থামেনি। গ্রুপ পর্বের ম্যাচে এই দৃশ্য দেখা যায়নি। কিন্তু সুপার ফোরে উত্তপ্ত হল পরিস্থিতি।ক্রিকেটকে একদা বলা হত ‘জেন্টলম্যান’স গেম’। এই অভিধার মধ্যে পশ্চিমি সাহেবি শ্রেণিগন্ধ আছে নিশ্চয়ই, কিন্তু এই সত্যটিও রয়েছে: খেলা শুধুই খেলা নয়; জীবনচর্যা, লোকব্যবহারেরও কষ্টিপাথর। দুর্ভাগ্যের কথা, আজকের সময়ে ক্রীড়াক্ষেত্রও হয়ে উঠেছে রাজনৈতিক ও সামাজিক বিভেদের ভূমি। ক্রিকেটাররাও খেলার মাঠে সেই বিভেদ টেনে আনছেন প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে— ম্যাচে হাফ সেঞ্চুরি করে এক পাক ক্রিকেটার ‘গানশট সেলিব্রেশন’ করেছেন, ফিল্ডিংরত এক পাক ক্রিকেটার দর্শক-গ্যালারির উদ্দেশে হাতের মুদ্রায় দেখিয়েছেন ভারতের সামরিক বিমান ধ্বংসের ভঙ্গিমা। অর্থাৎ রাজনীতিকরা বছরভর উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে যে বিদ্বেষ-বিভাজনের বয়ান চারিয়ে দেন, সমাজে ও সমাজমাধ্যমে সাধারণ নাগরিকেরা যে বিষকুম্ভ রোজ চালাচালি করেন, ক্রিকেটাররাও সে কাজ করে যাচ্ছেন খেলার মাঠে। করমর্দন বয়কটেও তারই প্রতিচ্ছবি। উপমহাদেশের জনপ্রিয়তম খেলাটি এ ভাবেই বর্তমানের অনুদার রাজনীতির সঙ্গে হাত মেলাল— জেনেবুঝেই।
খেলা আর শুধু খেলা নেই, হয়ে উঠেছে রাজনীতির শিকার— এ-ই কি তবে সত্য? দুই দেশের রাজনীতির বিভাজন কি ক্রিকেটকেও চালিত করবে? আগের ম্যাচের জয় ভারতীয় অধিনায়ক উৎসর্গ করেছিলেন ‘পহেলগামের শিকার’ মানুষকে, সঙ্গে ভারতীয় সেনাকেও। উৎসর্গে দোষ নেই, খেলার মাঠের বাইরে বৃহত্তর জীবনের প্রতি তা শ্রদ্ধা প্রদর্শন। সেই শ্রদ্ধা আরও আন্তরিক হত, প্রকৃত খেলোয়াড়সুলভ মনোভাবে প্রতিদ্বন্দ্বী দলের সঙ্গে করমর্দনের শ্রদ্ধাও দেখানো গেলে। তাতে এই স্পষ্ট বার্তা দেওয়া যেত: আমরা ক্রিকেটের ‘স্পিরিট’ বজায় রেখে, বিপক্ষের ক্রীড়াদক্ষতাকে শ্রদ্ধা জানিয়ে করমর্দন করলাম, তেমনই পহেলগাম মনে রেখে দেশের প্রতি দায়বদ্ধতার প্রমাণ রাখলাম। হাত না মেলানো যদি প্রতিপক্ষ দেশের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হয়, তা হলে তাদের সঙ্গে ক্রিকেট না খেলাই তো হতে পারত সবচেয়ে বড় প্রতিবাদ। মাঠে নামা গেল, অথচ হাত মেলানোর ভদ্রতাটুকু দেখানো গেল না— এ কি এক ধরনের সুবিধাবাদ, দ্বিচারিতা নয়?লোকব্যবহারের অঙ্গ অনেক কিছুরই রয়েছে বৃহত্তর অর্থ। যেমন করমর্দন— রাজনীতি-কূটনীতি আর খেলায় তার সবিশেষ প্রয়োগ দেখা যায়— দুই ‘চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী’ দেশের নেতা বা খেলোয়াড়রাও বৈঠক বা ম্যাচ শেষে হাত মেলান। তা এই বার্তা দিতেই যে, মতান্তর যতই থাক, মনান্তর যেন না থাকে; রাজনৈতিক বা সামরিক দ্বন্দ্ব ও খেলার জয়-পরাজয় পিছনে ফেলে মানবিক শিষ্টতা ও সৌজন্য যেন অক্ষুণ্ণ থাকে। কিন্তু এশিয়া কাপে ভারত-পাকিস্তানের তিনটি ম্যাচে সেই ভব্যতা প্রশ্নের মুখে পড়ল। গ্রুপ পর্বে ম্যাচ শুরু হওয়ার আগে টসের পর ভারতীয় দলের অধিনাক পাক অধিনায়কের সঙ্গে হাত মেলাননি, এমনকি ম্যাচে জয়ের পর যে দলবদ্ধ করমর্দনের প্রথাটি প্রচলিত, তা-ও হয়নি। ম্যাচের পর ভারতীয় দলের সাজঘরের দরজাও ছিল বন্ধ, খাঁটি ক্রিকেটপ্রেমীদের তার অর্থটি বিলক্ষণ জানা। ক্রিকেটমহলে এই নিয়ে ব্যাপক তোলপাড় হলেও ছবিটা যে পাল্টায়নি, বোঝা গেল সুপার ফোর পর্বেও এবং ফাইনালে: টসের পরে বা ম্যাচ শেষেও ভারতীয় অধিনায়ক ও তাঁর দল বিপক্ষের সঙ্গে হাত মেলালেন না। আর ভারত জেতার পর ট্রফি নিয়ে যা হল,সেটা পাড়া ক্রিকেটেও হয় না। সে নিয়ে লিখব না কারণ সেটা ক্রিকেট নয়। ভারত জিতল ঠিকই কিন্তু হারল ক্রিকেট।
Advertisement



