শান্তনু রায়
শিরোনামটি বার্লিন এ সদ্য প্রয়াত কবি দাউদ হায়দারের ‘আমি ভাল আছি, তুমি?’ (২০০০) কবিতার সমাপ্তি পংক্তি। অর্ধ শতক আগে যাঁকে নির্বাসিত হতে হয়েছিল প্রিয় আজন্মের স্বদেশভুমি বাংলাদেশ থেকে তাঁর একটি কবিতার জন্যই। রাজনৈতিক আশ্রিত হিসেবে প্রায় চার দশক ধরে জার্মানি-বাসী হলেও বাংলা কবিতার তন্নিষ্ঠ পাঠকের সঙ্গে অন্তত কবিতার মাধ্যমে তাঁর পরিচিতি— ব্যক্তিগতভাবেও কারো কারো সঙ্গে একটা যোগসূত্র বজায় ছিল। মাস ছয় অসুস্থতার পর গত ২৬ এপ্রিল অকৃতদার এই কবির সুদূর বার্লিনে প্রয়াণ সংবাদে এ নিবন্ধকারের মতো অনেকেরই হয়ত মনে পড়েছে কবিতা লেখার ‘অপরাধে’ চরম শাস্তি প্রদানের সে প্রেক্ষাপট-চুয়াত্তরের দিনগুলি। আমাদের তখন কলেজ জীবনের (আশুতোষ কলেজ) প্রায় শেষ পর্যায়। কলেজ চত্বরের আড্ডায় একদিন হঠাৎ শোনা গেল বাংলাদেশের এক তরুণ কবির সদ্য লেখা একটি কবিতায় নাকি ঝড় উঠেছে সেদেশে— সে কবিতায় নবীকে ‘অপমান’ করার কারণে। কবিতাটি কি তখনও জানা না গেলেও কবির নাম জানা গেল— বাইশ বছরের তরুণ দাউদ হায়দার। কবিতাটি নিয়ে সেসময় ওপার বাংলায় যেমন ভীষণ উত্তেজনা এপারে এ শহরের নাগরিক সমাজেও কিঞ্চিৎ আলোড়ন। মাত্র বছর দুই আগে বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে দেশগড়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতাপ্রাপ্ত পড়শি রাষ্ট্রের বাইশ বছরের তরুণের কবিতায় কি এমন আছে যাতে তোলপাড় হচ্ছে সে দেশ, তা জানার কৌতুহল তখন একুশ-প্রায় আমার মতো অনেকেরও। বিস্ময়ও হচ্ছিল দু’দশক আগে মাতৃভাষার জন্য রাজপথ নিজের রক্তে রঞ্জিত করা মানুষের স্বাধীন দেশে কবিতা লিখলে আবার জেল ও নিগ্রহ হতে পারে! তবে পারিবারিক পরিসরেও যথেষ্ট রাজনীতি চর্চার আবহে যাপনে একুশের স্পর্ধা মনে মনে কুর্নিশ জানাতে দ্বিধান্বিত হয়নি বাইশের দুঃসাহসকে। উতল হাওয়ায় মাঝে মাঝে কানে ভেসে যেন আসছিল ভিতর তোলপাড় করা ডাক—আয়রে ছুটে, টানতে হবে রশি—
ঘরের কোণে রইলি কোথায় বসি!
যা হোক, ক্রমে জানা গেছিল কবিতাটি ‘কালো সূর্যের কালো জ্যোৎস্নায় কালো বন্যায়’ প্রকাশিত হয়েছিল সে বছরেরই ২৪ ফেব্রুয়ারি সে দেশের দৈনিক সংবাদ পত্রিকায়, যে পত্রিকার সাহিত্য পাতার সম্পাদকের দায়িত্বেও তখন ছিলেন বছর বাইশের দাউদ, যাঁর জন্ম ভাষা আন্দোলনের সেই রক্তাক্ত দিনেই পাবনার দোহারপাড়া গ্রামে। আমাদের প্রায় সমবয়সী তাঁর ১৯৬৭ -তে অর্থাৎ ১৫ বছর বয়সে প্রথম কবিতা প্রকাশ পেয়েছিল ঢাকার একটি পত্রিকায়। ১৯৭৩ এসে কবিরই একটি কবিতা লণ্ডন সোসাইটি ফর পোয়েট্রি ‘দ্য বেস্ট পোয়েম অব এশিয়া’ সম্মানে ভুষিত হয়েছে। ১৯৭২ এ তাঁর সৃজিত ‘জন্মই আমার আজন্ম পাপ…’ কবিতাটিও আলোড়ন ফেলে দিয়েছিল। কবিতা পড়তে, শুনতে ভালো লাগলেও তখন যে সব কবিতা ভালো বুঝতে পারতাম এমনটি নয়। কিন্তু এক্ষেত্রে বাড়তি এক কৌতূহল তাড়িয়ে বেড়াচ্ছিল। তখনও ‘কবির মৃত্যু’ সৃজিত হয়নি। কিন্তু বেহিসেবী একুশের বুকের মাঝে বেজে চলছিল দুন্দুভি— ওই যে চাকা ঘুরছে রে ঝনঝনি, বুকের মাঝে শুনছ কি সেই ধ্বনি? রক্তে তোমার দুলছে না কি প্রাণ?
যাহোক মে মাসের শেষ নাগাদ জানা গেল বিতর্কিত সে তরুণ কবি দাউদ হায়দার ওই কবিতাটি লেখার ‘অপরাধে’ প্রাণরক্ষায় এদেশে আশ্রয় নিয়েছেন। ইতিমধ্যে সেদেশে তাঁর কারাবাস ও নির্যাতনভোগ সবই হয়ে গিয়েছে। বস্তুত ১৯৭৪-এর ২৪ ফেব্রুয়ারি দৈনিক সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘কালো সূর্যের কালো জ্যোৎস্নায় কালো বন্যায়’ কবিতাটি, নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে ওই কবিতার কয়েকটি পংক্তি বাইশ বছরের এক ঝকঝকে তরুন কবির জীবনকে তছনছ করে এক বিপর্যয় নিয়ে এসেছিল। আগের বছর আন্তর্জাতিক সম্মানে ভুষিত হয় ২১ বছরের যে তরুণ কবির কবিতা, বছর ঘুরতে না ঘুরতেই সেই দাউদ হায়দারকে একটি ‘বিতর্কিত’ কবিতা লেখার অপরাধে প্রায় একবস্ত্রে নির্বাসিত হতে হয়েছিল তাঁর প্রিয় স্বদেশভুমি বাংলাদেশ থেকে। ওই কবিতায় ধর্মীয় আবেগে আঘাত দেওয়া হয়েছে এই অজুহাত তুলে বাংলাদেশের উগ্র মৌলবাদী গোষ্ঠী প্রচণ্ড বিক্ষোভ ও জঙ্গি প্রতিবাদে নামে, যদিও ঐ বিতর্কিত কবিতায় অন্য ধর্মের প্রবর্তকদের উল্লেখও ছিল। তাঁর বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ করেন ঢাকার এক কলেজের এক শিক্ষক। পরিণামে ১১ মার্চ গ্রেফতার ও কারাবাস তারপর নির্বাসন। যদিও গ্রেফতার হওয়ার আগে ৯ মার্চই দৈনিক সংবাদে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে দাউদ হায়দার কবিতাটি লেখার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা ও অনুশোচনা প্রকাশ করে বলেছিলেন কারো ধর্মানুভুতিতে আঘাত দেওয়া তাঁর ইচ্ছা ছিল না। তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন কবিতাটি তিনি কোনো কাব্যগ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত করবেন না। কিন্তু আবহ রইলো চরম উত্তপ্তই। হয়ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবও সেদিন বুঝেছিলেন যে সেদেশে থাকলে তরুণ কবির জীবন সুনিশ্চিত নয়। তাই প্রথমে সুরক্ষামূলক গ্রেফতার ও পরে একই সঙ্গে তাঁর জীবন বাঁচাতে ও সহিংস মৌলবাদীদের আপাততুষ্ট করতে আগের সন্ধ্যায় জেলখানা থেকে মুক্তি দিয়ে পরের সকালেই গোপনে ফাঁকা বিমানে কোলকাতায় পাঠাতে হয়েছিল কবিকে। প্রাণ বাঁচাতে সরকারি সে ব্যবস্থাপনায় প্রায় এক বস্ত্রে কাঁধের ব্যাগে খানকতক বই ও টুকিটাকি সামগ্রী নিয়ে কোলকাতাগামী ফ্লাইটের ফাঁকা বিমানে দেশত্যাগী কবির নিজের কথায়, ‘আমার কোন উপায় ছিল না। মৌলবাদীরা আমাকে মেরেই ফেলত। সরকারও হয়ত আমার মৃত্যুকামনা করছিল।’ প্রাণহানির আশঙ্কা যে অমূলক ছিল না পরবর্তী বিভিন্ন ঘটনা বিশেষত ২০০৪-এ সাহিত্যিক হুমায়ুন আজাদের উপর সশস্ত্র আক্রমণ ও পরিনামে মৃত্যুতে তাই প্রমাণিত হয়।
কাকতালীয়ভাবে সেই চুয়াত্তরের ফেব্রুয়ারিরই এক রাতে পৃথিবীর অন্যপ্রান্তেও অনুরূপ একটি ঘটনা ঘটেছিল; রাষ্ট্রের অত্যাচার সত্ত্বেও প্রাথমিকভাবে দেশত্যাগে নারাজ আলেকজাণ্ডার সলজেনিৎসিন-এর নাগরিকত্ব রাতারাতি কেড়ে নিয়ে সেরাতে কেজিবি তাঁকে গ্রেপ্তার করে সকালে বার্লিনগামী প্লেনে তুলে দিয়ে দেশত্যাগ করতে বাধ্য করেছিল। বিমানে ওঠার আগে তিনি নিজের সঙ্গে নিয়েছিলেন দু’টি জিনিস— বন্দীশিবিরে থাকার সময়কার একটি টুপি ও উলের একটি বিবর্ণ কোট। উল্লেখ্য বিতাড়িত সলজেনিৎসিনকে তখন আশ্রয় দিয়েছিলেন জার্মান সাহিত্যিক হাইনরিক বোল। বহু দূরে এবং মাস তিনেকের ব্যবধানের ঘটনাদ্বয়ের মধ্যে অদ্ভুত এক মিল লক্ষ্য করার মতো; ধর্ম হোক বা মতাদর্শ— উভয় ক্ষেত্রেই রেজিমেন্টেশন বা কঠোর নিয়ন্ত্রণের প্রবণতা ও অসহিষ্ণুতা বোধকরি এভাবেই শাস্তি দিয়ে সন্তুষ্ট হয়!
যাহোক, সদ্য স্বদেশ-বিতাড়িত হতভাগ্য দাউদের নির্বান্ধব কোলকাতায় প্রথম সকালের অনুভুতি ছিল এমন— ১৯৭৪ মে’র ২২ তারিখ। দমদম এয়ারপোর্ট। সকাল আটটা। সঙ্গে আমার একটি মাত্র ব্যাগ তাও কাঁধে ঝোলানো। ব্যাগে দুটি শার্ট, দুটি প্যান্ট। একজোড়া স্যাণ্ডেল, টুথপেস্ট, ব্রাশ, তোয়ালে। একটি পায়জামা। দুই কপি ‘জন্মই আমার আজন্ম পাপ’। পকেটে ভারতীয় ষাট পয়সা। কোথায় উঠবো কিচ্ছু ঠিক নেই। গন্তব্যও অজানা। ষাট পয়সা দিয়ে কী করবো? জল ভাসে চোখে। ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে একদিনও কাঁদিনি। মৃতপ্রায় মাকে ছেড়ে এসেছি, শঙ্কায় অস্থির।
জেল থেকে ছাড়া পেয়ে বাসায়, গোটা রাত তাঁর শিয়রে বসে। হাত ধরে ছিলেন আমার। ওই হাত ছাড়িয়ে নিয়ে, তাঁকে কিছুই না বলে, নিরুদ্দেশ যাত্রা।
সকালে বা একসময় জানতে চাইবেন, কোথায় গেছি। এখনো ফিরছি না কেন। অস্থির হবেন।
আমি যে জেলে গিয়েছিলুম, মা জানতেন না। বলা হয় তাঁকে— হয় পাবনা, না হয় চাটগাঁয় গেছি।
জানতেন তিনি, দুরন্ত খোকন কখন কোথায় উধাও হয়ে যায় ঠিক নেই। এক সময় ঠিকই ফিরে আসে, মায়ের কোলে মুখ গুঁজে পলায়ন-অপরাধে শাস্তির অপেক্ষায় থাকে’। (সুতানুটি সমাচার)
নাহ্, আর ফেরা হয়নি খোকনের; সেই থেকে নির্বাসিতের জীবনযাপনের শুরু—অনেক দেশ ঘুরলেও কোনোদিন এক মুহূর্তের তরেও পা ফেলতে পারেননি তাঁর প্রিয় জন্মভুমিতে। দাউদ হায়দারই স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম নির্বাসিত লেখক যিনি অনেক অভিমান বুকে নিয়ে আমৃত্যু অর্ধশতকের বেশিকাল নির্বাসিতের জীবনযাপনে বাধ্য হয়েছেন— প্রথম তেরো বছর এরাজ্যে— মাসখানেক অধুনা প্রয়াত সাহিত্যিক-সাংবাদিক গৌরকিশোর ঘোষ ও পরে সাহিত্যিক অন্নদাশংকর রায়ের আশ্রয়ে। এ ঘটনা অনেকেরই হয়ত জানা তবুও নাম দু’টি উল্লেখিত হলো এ বোঝাতে যে দুঃসময়ের সেইক্ষণে কতো বড়ো মাপের ব্যক্তিত্বদ্বয় স্বেচ্ছায় এদেশে তাঁর আশ্রয়দাতার ভুমিকা নিয়েছিলেন। কোলকাতায় দাউদ সমাদৃতও হয়েছিলেন। অন্নদাশঙ্কর রায়ের বাড়িতে থাকাকালীন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামুলক ভাষা সাহিত্যে ভরতি হলেন। দ্য স্টেটসম্যান পত্রিকাতেও মাঝে মাঝে লিখতেন। কিন্তু এদেশেও তাঁর ঠাই স্থায়ী হয়নি, সুখ অধরা থেকে গেছে। যদিও ব্যক্তিগত সম্পর্কের উষ্ণতা লাভের সুযোগ এসেছিল। প্রেমও এসেছিল জীবনে। কিন্তু স্থায়ী হতে পারেনি। কোনো এক ‘অরুণা’র নাম করে লিখছেনও একাধিক কবিতা। তবে তাঁর দীর্ঘশ্বাস বুকের মাঝে হাহাকারের স্পন্দন অনুরণিত অনেক সৃজনে, ১৯৭৫-এ রচিত এই কবিতার মতো— ‘তারপরের গল্প কিন্তু রবীন্দ্রনাথ নিজেই বলতে ভুলে গেছেন/ তবু মনে রাখবেন/ একজন প্রেমিকের নিঃসঙ্গ যৌবন হাহাকার কেমন করুন/ ধূসর, পংক্তিময়’। (রবীন্দ্র বিরহ গাথা)
তবে কলকাতাবাসেও একদিন ছেদ ঘটল। তাঁর পাসপোর্ট নবীকরণের সময় জিয়ায়ুর রহমানের সরকার তা বাজেয়াপ্ত করার পর এরসাদ সরকার তাঁর পাসপোর্টের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। তখন (১৯৮৫) তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী প্রয়াত রাজীব গান্ধীকে প্যান আমেরিকান সেন্টারের ২০০০ লেখকের পক্ষ থেকে দাউদ হায়দারকে ভারতের নাগরিকত্ব দেওয়ার অনুরোধ জানালেও ইতিবাচক সাড়া মেলেনি। সেই দুঃসময়ে নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত জার্মান সাহিত্যিক গুণ্টার গ্রাসের সহায়তা ও সক্রিয়তায় (যদিও বিতর্কিত কবিতার একই পংক্তিতে যীশুরও উল্লেখ ছিল) জার্মানিতে তাঁর রাজনৈতিক আশ্রয় অনুমোদন পেলে ১৯৮৭ জুলাইয়ের এক ভোরে তিনি বার্লিন পৌঁছন। সে সময়ে এক কবিতায় লিখেছেন— এক নির্বাসন থেকে আরেক নির্বাসন, হয়তো কবিরই জীবন/ কিংবা আমার—/ …হে দেশ, তোমাকে ছেড়ে যেতে যত দূরেই যাই তুমি আছো/ সর্বাঙ্গে/ জীবনে-সজল-অক্ষিলতায়।
সেই থেকেই তিনি জার্মানির বাসিন্দা। রাষ্ট্রসংঘের বিশেষ ‘ভ্রমণপাশ’ নিয়ে ঘুরেছেন অনেক দেশ— এদেশেও। কিন্তু কোনওদিন পা ফেলতে পারেননি তাঁর প্রিয় জন্মভুমি বাংলাদেশে কিংবা জন্মস্থান পাবনায়। ১৯৮৯ সালে তিনি জার্মানির ‘ডয়েচে ভেলে’ রেডিও চ্যানেলের সাংবাদিক হিসেবে চাকরি শুরু করেন। ক্রমে প্রতিষ্ঠা। বিভিন্ন ভাষায় লিখেছেন প্রায় ত্রিশটির মতো বই। এতদিন জার্মান-বাস সত্ত্বেও জার্মান-নাগরিকত্ব গ্রহণ করেননি, বাঙালি হয়েই থাকতে চেয়েছেন বরাবর। জীবন যতই উথাল পাতাল হোক না কেন বাংলা কবিতা থেকে কিন্তু ছুটি মেলেনি কখনো। লিখেছেন প্রচুর, যখন যেখানে গেছেন সেদেশ থেকেই।
যেমন ১৯৯২-এ এথেন্স থেকে লিখছেন- আমরা পাঁচজন, পাঁচটি মহাদেশ/ অতিক্রম করে/ বৈতরনির দিকে এগুলাম।/ -বৈতরনির ছলছল শব্দে/ দুই কান বধির হয়ে যায়, আমরা/ পূর্বপুরুষেরই উদ্দেশে আমাদের তর্পণ, যে যার মাতৃভাষায় ছড়িয়ে দিলাম ব্যাপ্তির গভীরে/ ইতিহাস। (বিশ্বভূগোল, মানচিত্রে) আবার ২০১৭-য় হেগ-এ রচিত একটি কবিতায় এক দুঃসাহসী উচ্চারণ— গোধুলিগগনে মেঘে ঢেকে যায় তারা/ দেশব্যাপী কোথায় মুক্তিযোদ্ধারা/ আমার ধর্মীয় অনুভুতিতে আঘাত দিচ্ছে।/ প্রিয়তমা সুন্দরী ঘরনী/ যৌনসঙ্গমে শয্যায় বোরখা পরোনি/ আমার ধর্মীয় অনুভুতিতে আঘাত দিচ্ছো। (আঘাত দিচ্ছো)
প্রসঙ্গত, দাউদ হায়দারের দেশত্যাগের ঠিক দু’দশক পরে একই অভিযোগে অভিযুক্ত সেদেশেরই আরেক সাহিত্যিক তসলিমা নাসরিনকেও প্রাণ রক্ষার্থে স্বদেশভুমি ত্যাগ করতে হয় এবং তিনি এদেশে আশ্রয় নিলেও মৌলবাদীরা এখানেও তাঁর মাথার মূল্য ধার্য করে প্রাণহানির চেষ্টা করে। তবু তদানীন্তন রাজ্য সরকারের ইচ্ছায় তাঁকে একদিন এ রাজ্যও ত্যাগ করতে হয় এবং আজও তিনি ব্রাত্য এ রাজ্যে। আবার একই অভিযোগে উপন্যাসে মৌলবাদীদের সমালোচনা করার কারণে ২০০৪ সালে একুশে বইমেলায় গ্রন্থাকারে উপন্যাসটি প্রকাশিত হলে ক্ষিপ্ত মৌলবাদীদের হামলার শিকার হন হুমায়ূন আজাদও, পরিণামে মৃত্যু।
পড়শি দেশের বারংবার এবিধ ঘটনার প্রেক্ষিতে প্রশ্ন জাগতে পারে স্বাভাবিকভাবে, দেশের গর্ব এক তরুণ কবির সদ্য প্রকাশিত একটি কবিতায় কতিপয়ের অপছন্দের কিছু শব্দবন্ধ বা কয়েকটি পঙক্তি কিংবা শব্দচয়নে আপত্তি কিংবা বিশিষ্ট সাহিত্যিকের সৃজনের কোন বক্তব্যে আপত্তির কারণে কেন নিদান হয় নিগ্রহ নির্বাসনের মতো কঠোর শাস্তি? কেন এতো অসহিষ্ণুতা-নিষ্ঠুরতা?
এর উত্তর হয়ত খানিকটা মেলে সেসময় অর্থাৎ কবি দাউদ হায়দার যখন কারারুদ্ধ, কোলকাতার এক বহুল প্রচারিত বাংলা দৈনিকে (১৬ মে ১৯৭৪, ১ জৈষ্ঠ) বাংলাদেশের বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক ও ‘আমার ভায়ের রক্তে রাঙ্গানো একুশে ফেব্রুয়ারী’ অমর সঙ্গীতের রচয়িতা সাহিত্যিক সাংবাদিক জনপ্রিয় কলামলেখক আব্দুল গাফফার চৌধুরীর এক সুদীর্ঘ প্রবন্ধে উচ্চারিত দ্বিধাহীন ও সাহসী উচ্চারণে। তাঁর বক্তব্যের নির্যাস— বাংলাদেশে আধুনিকতা ও ধর্মনিরপেক্ষতার দিকে কবিতা যতটা এগিয়েছে, সমাজ ততটা এগোয়নি। শুধু ধর্ম বিষয়ে নয়, যে কোন বিষয়েই জনসমাজে সহিষ্ণুতা ও ব্যক্তির অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধা বড় কম। সে ভূখণ্ডের এই সমাজবাস্তবতার কারণ শ্রী গাফফারের মতে, ব্রিটিশ আমলের গোড়ার দিকে ইংরেজি শিক্ষা তথা আধুনিক শিক্ষার সঙ্গে অসহযোগিতার ফলে জনমানসে প্রগতির গতির বড় মন্থরতা এবং তাঁদের সমাজের প্রতি কখনো পুরোপুরি দায়িত্ব পালন না করা বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের জনসমাজের অশিক্ষা, অসহিষ্ণুতা বা কুসংস্কারকে কখনো আঘাত দেওয়ার সাহস না দেখানো। প্রাতস্মরণীয় ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের কথা উল্লেখ করে তিনি লিখেছিলেন— বাঙ্গালি মুসলমান সমাজের মধ্যে এমন প্রবল পৌরুষ নিয়ে কোনো ‘কালচারাল পার্সোনালিটি’ বা সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বের আবির্ভাব ঘটেনি।
এ প্রসঙ্গে অনেকের হয়তো স্মরণে আসবে অনেকদিন আগে শ্রদ্ধেয় রেজাউল করীমও লিখেছিলেন— ‘হিন্দু সাম্প্রদায়িকতা দেশের অন্য বিষয়ে ক্ষতি করিলেও, হিন্দুদের জাগরনের পথে বাধা সৃষ্টি করে নাই। কিন্তু মুসলমান সাম্প্রদায়িকতা মুসলমানকে পশ্চাতে ফেলিয়া রাখিয়াছে— তাহাদের মধ্যে প্রগতিশীল রাজনৈতিক চেতনা সঞ্চারের পথে প্রধান বিঘ্ন উৎপাদন করিয়াছে।’
শ্রী গাফফার ঐ প্রবন্ধে উদাহরণ হিসেবে কাজি আবদুল ওদুদ সৈয়দ মুজতবা আলী প্রমুখের সেদেশে নিগ্রহের মতো পূর্বেকার কতিপয় ঘটনার উল্লেখ করে মন্তব্য করেছিলেন— বাংলাদেশের তরুণ কবির ক্ষমা প্রার্থনার মত ঘটনা ঢাকায় আজ নতুন নয়।
দীর্ঘকাল লণ্ডনপ্রবাসী আব্দুল গাফফার শেখ মুজিবের জীবৎকালেই যে শঙ্কা ব্যক্ত করেছিলেন সেটিও উল্লেখযোগ্য। সেই ১৯৭৪-এ তিনি লিখেছিলেন— আধুনিক জনসমাজ তৈরির কাজে শিক্ষিত ও বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর আগ্রহের অভাব, ধর্মনিরপেক্ষ ও আধুনিক রাজনৈতিক আন্দোলনের সাফল্যকে স্থিতিশীল করার পাশাপাশি সাংস্কৃতিক ও সামাজিক সংস্কার আন্দোলনের অনুপস্থিতি বাংলাদেশে আবার ঘড়ির কাঁটা পেছনের দিকে হটিয়ে দিতে পারে।
তাঁর আশঙ্কাকে সত্য করে সেদেশে বাস্তবেও ঘটেছে ও ঘটছেও তদ্রূপ।
ফিরে আসি হতভাগ্য কবি দাউদ হায়দারের নির্বাসন জীবনপর্বে। একদিন প্রায় কপর্দকশূন্য অবস্থায় স্বদেশ ত্যাগে বাধ্য হয়েছিলেন তিনি প্রতিকুল অবস্থার প্রেক্ষিতে। তারপর বাধাবিঘ্ন কাটিয়ে সুপ্রতিষ্ঠিত— আমেরিকার দু’টি বিশ্ববিদ্যালয়ে, ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের ১৭টি বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং ইজরায়েলের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচীতে তাঁর কবিতা। কিন্তু নিজের জন্মভূমিতে তিনি থেকে গেছেন ব্রাত্য। আবার এ বঙ্গেও যথোচিত চর্চিত হয় না তাঁর কবিকৃতি এত প্রতিকূলতার মাঝেও এমন সাফল্য— হয়ত কোনো এক বিশেষ কারণে। যদিও কোলকাতা এসে যাবার আগের অনুভুতি প্রকাশ পেয়েছে এভাবে— চলে যাচ্ছি, ভারতবর্ষ ছেড়ে চলে যাচ্ছি/ চলে যাচ্ছি, কোলকাতা ছেড়ে চলে যাচ্ছি।/ -চলে যাচ্ছি, যেখানে আমিই আমার, একাকী বেদনা। (চলে যাচ্ছি ২০১৯)
সেই সাতের দশকে দেশ থেকে নির্বাসিত হয়ে স্বদেশে ফিরতে না পারার যন্ত্রণা কিভাবে কুরে কুরে খাচ্ছিল দাউদ হায়দারকে তারই আকুতি প্রকাশ পেয়েছে ‘তোমার কথা’ শীর্ষক কবিতায় এভাবে—
মাঝে মাঝে মনে হয়/ অসীম শূণ্যের ভেতর উড়ে যাই।/ মেঘের মতন ভেসে ভেসে, একবার/ বাংলাদেশে ঘুরে আসি ।
৭৩ বছরের অকৃতদার দাউদ হায়দারের নির্বাসন থেকেও চিরমুক্তি হল অতিসম্প্রতি বার্লিনের এক চিকিৎসালয়ে প্রয়াণে।
কবির প্রয়াণ হলেও কবিতার মৃত্যু হয় না, সত্য। কিন্তু ভাবছিলাম এমন হতভাগ্য কবির এফিটাফ লেখা হলে তার শিরোনাম যদি হয়— ‘তুমি যে চেয়ে আছ আকাশ ভ’রে’ কিংবা ‘মোর নাম এই বলে খ্যাত হোক, আমি তোমাদেরই লোক আর কিছু নয়’ তবে কেমন হয়।