শান্তনু রায়
জোড়াসাঁকোয় রবীন্দ্রনাথকে প্রথম দর্শনের অনুভুতি এভাবেই ব্যক্ত করেছেন রবীন্দ্র-জীবনের অপরাহ্ণ বেলার অন্তরঙ্গ কবি অনুরাগিনী ও শেষ দশ বছরের পত্রমিতা ‘জোনাকি’ ওরফে হেমন্তবালা দেবী।
ব্যক্তিজীবনে ও পারিবারিক পরিসরে রবীন্দ্রনাথ ঘনিষ্ট সংস্পর্শে ছিলেন মেজবৌদি জ্ঞাননন্দিনী দেবী, দিদি স্বর্নকুমারী দেবী, বৌঠান কাদম্বরীদেবী, স্বদেশী মেলায় বীরাষ্টমী ব্রতর উদ্যোগী ভাগ্নী সরলা দেবী (ঘোষাল), ভ্রাতুষ্পুত্রী ইন্দিরা দেবীর মত বিশিষ্ট নারীর। জ্ঞাননন্দিনী দেবী তো বটেই ঠাকুরবাড়ির অপর মহিলারাও সেইসময় বাংলার শিক্ষিত রুচিশীল মেয়েদের সামাজের প্রতিনিধি ছিলেন, অনেকে জাতীয় রাজনীতির স্রোতের সঙ্গেও ছিলেন।
একথাও সত্য যে ১৮৮৩সালের ডিসেম্বরে দশ বছরের মৃণালিনীর সাথে বিয়ের পর রবীন্দ্রনাথ আদরনীয়া স্ত্রী ‘ছুটি’কে লেখাপড়া শিখিয়ে ঠাকুরবাড়ির উপযুক্ত করে তোলার লক্ষ্যে মেজবউদি জ্ঞাননন্দিনীর তত্ত্বাবধানে রেখে লরেটো স্কুলে তাঁকে ভর্তি করে দিয়েছিলেন।পাঁচ সন্তানের জননী মৃণালিনীর মাত্র ত্রিশ বছর বয়সে ১৯০২ এর সেপ্টেম্বরে রোগভোগের পর প্রয়াণে কুড়ি বছরের বিবাহিত জীবনের আকস্মিক সমাপ্তি ঘটে যা কবিকে গভীরভাবে ব্যথিত করেছিল, আরেকবার নিঃসঙ্গও। তবে একথাও অনুমেয় যে মৃণালিনী হয়ত রবীন্দ্রনাথের মানসিক চাহিদা পূর্ন করতে পারেননি।রবীন্দ্রনাথের চিন্তা ভাবনার সম্যক উপলব্ধি বা তাঁর সূক্ষ্ম অনুভূতি স্পর্শ করা হয়ত মৃণালিনীর পক্ষে সম্ভব হত না। সেদিক দিয়ে হয়ত মৃণালিনীর সমবয়সী ভাইঝি ইন্দিরার সাথে রবীন্দ্রনাথের মানসিক আদান প্রধান সহজ হত। ইন্দিরার সঙ্গে আলাপনে হয়ত অধিকতর স্বছন্দ বোধ করতেন, নিজস্ব ভাবনা অনুভূতি প্রকাশে।পরবর্তীতে একসময় বিশ্বভারতীর উপাচার্য পদের দায়িত্বও সামলান ইন্দিরাও সে সময় হয়ত রবিকাকার চিন্তার দোসর হতে পেরেছিলেন। এক তথ্যে দেখা যাচ্ছে ভাইঝি ইন্দিরাকে আশ্বিন ১২৯৪ থেকে অগ্রহায়ন১৩০৮ পর্যন্ত লেখা পত্রের সংখ্যা ১৪৫; মৃণালিনীর সাথে তাঁর পত্র যোগাযোগ হয়েছে মাত্র কয়েকবার।
প্রসঙ্গত বিলেত যাওয়ার পূর্বে মেজদা সত্যেন্দ্রনাথের বন্ধু ডাঃ পান্ডুরঙ্গের বাড়িতে থাকাকালীন ইংরাজি কথোপকথন ও আদবকায়দার পাঠ গ্রহণের সূত্রে সংস্পর্শে আসা পান্ডুরঙ্গের বিলেতফেরত সুন্দরী চৌকশ ইংরাজিতে অসাধারন ব্যুৎপত্তিসম্পন্ন কন্যা বয়সে কিঞ্চিৎ বড় আধুনিকা মারাঠি তরুনী আন্না তনখড়ই বালক রবীন্দ্রনাথের জীবনে প্রথম নারী যিনি অনেকদিন পর্যন্ত কবিহৃদয়কে অধিকার করেছিলেন। তাঁর অনুরোধে রবীন্দ্রনাথ তাঁকে নাম দিয়েছিলেন নলিনী।
আবার দাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথের স্ত্রী কাদম্বরী দেবী ওরফে নতুন বউঠানের প্রভাবও তরুন রবীন্দ্রনাথের জীবনে ছিল; হৃদয়ের গভীর সখ্যতাও। তৎপরে বুয়েনআয়ার্সের এক অভিজাত পরিবারের কন্যা ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর স্বতঃপ্রণোদিত আতিথেয়তা,তত্ত্বাবধানে ও সাহচর্যে অসুস্থ কবি মনোরম নিসর্গ পরিবেশে মাসাধিকাল যাপন কালে ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর আন্তরিকতায় পরিশীলিত ব্যবহারে মুগ্ধ কবির হৃদয়ে রনিত হয় অন্তরঙ্গ নির্ভরতার সুর। ওকাম্পোও কবির মননের সংস্পর্শে এসে প্রানিত হন গভীরভাবে, জাগে ‘নিষ্কম্প অনুরাগ’। কবিও এই অনুরাগিনীর সান্নিধ্যের অনুরাগে তাঁর নামকরলেন বিজয়া।
এই বিজয়ার কথা উল্লেখ করে রবীন্দ্রনাথ রানী চন্দকে নাকি বলেছিলেন— “…তাই দেখেছি যে বিদেশি মেয়েরা তাদের ভালোবাসার প্রতিষ্ঠা করে কাজের মধ্য দিয়ে। (ওকাম্পোর রবীন্দ্রনাথ: শঙ্খ ঘোষ)
কবির শেষ জীবনে সাময়িক উপস্থিতি আর এক কৃতী নারীর- রানু অধিকারী। তের বছর শান্তিনিকেতনে থেকে নন্দলাল বসুর কাছে অঙ্কনবিদ্যা শিক্ষার্থী এই রবি-অনুরাগিনী তাঁর প্রিয় কবিকে ভানুদাদা নামে ডাকতেন।
কিন্তু এই নারীবৃত্তের পরিসরে প্রথাগত শিক্ষাবিহীন তুলনায় কিঞ্চিৎ কম পরিশীলিতা শিষ্টাচারে অনভিজ্ঞা এবং ঘরোয়া বিধায় অন্তর্ভুক্ত না হলেও প্রকৃত অর্থে রবীন্দ্রজীবনে শেষ নারী হেমন্তবালা দেবী, কবি যাকে বিভিন্ন ঘরোয়া ও মজার গল্পের সাথে ভিক্টরিয়া ওকাম্পোর গল্পও বলেছেন।যদিও তিনি নিজের জীবনের এক গভীর টানাপোড়েনের সময় কবির স্নেহময় সান্নিধ্য ও সাহচর্যে দিশা লাভ করেছিলেন আবার কবির সাঁজবেলায় আসা তিনিই হয়ত কবিকে ‘দু’দণ্ড শান্তি দিয়েছিলেন’।তিনিই এক মাত্র নারী যার সাথে বিচ্ছেদ ঘটেনি রবীন্দ্রনাথের। রবীন্দ্র-উপন্যাস পাঠে তাঁর উপলব্ধি যে রবীন্দ্রনাথই তাঁর জীবনের একমাত্র আশ্রয় কারণ তিনি তো তার মতো মেয়েদের কথাই বলেছেন উপন্যাসে(যেমন যোগাযোগ)।সেই আগ্রহেই তিনি যোগাযোগ করেন কবির সাথে পত্র মারফৎ। আবার রবীন্দ্রনাথের প্রেরণা ও উৎসাহই তাঁকে প্রাণিত করেছিল সাহিত্যকর্মে আত্মনিয়োগে। তিনি স্বশিক্ষিত— প্রধানত কবিকে কেন্দ্র করে হলেও অনেক কবিতা রচনা করেছিলেন। হয়ত সাধারণ হয়েও অসাধারণ উপস্থিতি রবি-জীবনে। কৌতূহল জাগতেই পারে কে এই হেমন্তবালা যার উদ্দেশ্যে অগ্রজ ‘কবিদাদা’ রবীন্দ্রনাথের লেখনীতে রচিত হয়েছিল সর্বাধিক পত্র, ২৬৪টি এবং কবিও পেয়েছিলেন তাঁর কাছ থেকে প্রায় তিনশ পত্র?
কবির ৩৩ বছরের অনুজ এই হেমন্তবালার পরিচয়-তিনি ময়মনসিংহের গৌরীপুরের জমিদার ব্রজেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর জেষ্ঠ্যা কন্যা এবং অন্যদিকে নাটোরের জমিদার জগদীন্দ্র নাথ রায়ের ভাগ্নে ব্রজেন্দ্রকান্ত রায়চৌধুরীর স্ত্রী।
তাঁর বাল্যকাল কেটেছে বেচু চ্যাটার্জী স্ট্রিটে। সে আমলের মেয়েদের মত পর্দানশীন জীবন কাটেনি হেমন্তবালার। বাগান করা ,ব্যাটবল ,উইকেট, পায়ে বাঁধা প্যাড নিয়ে বাড়ির ছেলেদের সঙ্গে নিঃসঙ্কোচে খেলায় মেতে যাওয়া তাঁর স্বাভাবিক জীবনের অংশ ছিল। নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে বিয়ে করতে বাধ্য হয়েছিলেন মাত্র ১৩ বছর বয়সে।স্বামী ব্রজেন্দ্রকান্ত রায়চৌধুরী নাটোরের জমিদার জগদীন্দ্র নারায়ণ রায়ের ভাগ্নে। সে পরিবারও অভিজাত ও বৈভবের অধিকারী হলেও চিন্তা ভাবনায় ছিল রক্ষণশীল- হেমন্তবালা সে পরিবেশ মানিয়ে নিতে পারলেন না। দুই সন্তানের মা হলেও হেমন্তবালার বিবাহিত জীবন অবশ্য সুখের হয়নি। নিজের জীবনের কঠিন সঙ্কটে যখন তিনি দিশেহারা তখন তিনি রবীন্দ্র- উপন্যাসের সংস্পর্শে এলেন এবং তা পাঠ করেই তাঁর জীবনের মোড় ঘুরে গেল। তাঁর নিজে কথায়- আমি যখন কলিকাতায় পতিগৃহে , তখন পারিবারিক ও অন্যবিধ অশান্তিতে কাতর হয়ে সাহিত্যের আশ্রয় নিই। আমি বৈষ্ণব ধর্ম গ্রহণ করেছিলাম পরিবারের মতের বিরুদ্ধে। এক সময়ে শ্রীবৃন্দাবন -দর্শনে যাবার অনুমতি পাবার জন্য বহু চেষ্টা করেও অনুমতি পেলাম না। সেই উপলক্ষ্যে একটা দারুণ বিক্ষোভ ও অশান্তি চলছিল। বিক্ষুব্ধ মনকে শান্ত করবার জন্য আমি অন্য পথ ধরলাম। রবীন্দ্রনাথের যোগাযোগ শেষের কবিতা ও সঞ্চয় পড়ি, তাঁর কবিতা ও গান কিছু কিছু পড়া ছিল- অকস্মাৎ তার একট নূতন পরিচয় আমার কাছে উদ্ঘাটিত হয় , এবং আমার মানসিক অশান্তির সময় আমি তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতায় উদ্বেল হয়ে তাঁকে একখানি পোস্টকার্ড লিখি-‘যোগাযোগের গ্রন্থকারকে অজস্র নমস্কার ‘ নিজের নাম ঠিকানাবিহীন প্ত্র। তারপর তাঁর আশীর্বাদ প্রার্থনা করি , নিজের ছদ্মনাম ‘জোনাকি ‘ নামে, অন্য একটা ঠিকানা দিই। পারিবারিক কারণে নিজের নাম গোপন করে রবীন্দ্রনাথেকে চিঠি দিতে আরম্ভ করলেন। প্রথম কয়েকটি পত্রের কোন উত্তর না পেলেও , অবশেষে জোনাকী ছদ্মনামে লেখা চিঠির উত্তর এল কবির লেখনীতে যেন ভবিষ্যতের দিশা হয়ে। সেটা ফেব্রুয়ারী ১৯৩১।হেমন্তবালার নিজের কথায় –‘আমার প্রয়োজন ছিল একটা দৃঢ় অবলম্বন লাভ করবার। আমি তখন হাল-পাল-বিহীন নৌকার অবস্থায় আছি’।
১৯৩১ ৮ই ফেব্রুয়ারী রবীন্দ্রনাথের চিঠি পেলেন হেমন্তবালা এই মর্মে –‘কল্যাণীয়া জোনাকী , তুমি আমার অন্তরের আশীর্বাদ গ্রহণ করো’। ডাকঘরের অমলের মতো দীর্ঘ প্রতীক্ষায় থাকা হেমন্তবালা অন্তরের সেরা ধন হয়ে রইলো সে পত্র। সেই থেকে শূরু পত্রমিতালীর। চলেছিল টানা প্রায় ১০বছর। ক্রমে অসমবয়সী দু’জনের মধ্যে মানসিক সখ্যতা গড়ে উঠল। রবীন্দ্রনাথ তখন প্রায় ৭০। তাঁর পত্রবন্ধু হেমন্তবালা ৩৭।
অপূর্ণ নামে একটী কবিতাটি লিখে পাঠিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ পত্রমিতা ‘জোনাকী’র আবদারে,তাঁর জন্মদিন উপলক্ষ্যে।কবিতা পেয়ে প্রথমে বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না হেমন্তবালা। তারপর যখন অনুধাবন করতে পারলেন কবির স্বহস্তে লিখে পাঠানো বুঝতে পেরে আপ্লূত। প্রথাগত শিক্ষা না থাকলেও হেমন্তবালা নিজের চেষ্টায় নিজেকে শিক্ষিতা আধুনিকা করে তুলেছিলেন। সাংসারিক টানাপড়েনে ক্ষত-বিক্ষত ও ক্রমে নিঃসঙ্গ একাকী হয়ে যাওয়া হেমন্তবালা অনুভব করতে পারছিলেন রবীন্দ্র-দর্শনই এনে দেবে তাঁর জীবনে প্রশান্তি। কিন্তু তখনও তাঁর রবীন্দ্রনাথকে দর্শনের সুযোগ ঘটেনি। কবিকে সেই প্রথম দর্শনে তাঁর সুগভীর উপলব্ধির স্বতঃস্ফুর্ত উচ্চারণই এ নিবন্ধের শিরোনাম।
সে দর্শনের বিবরন তাঁর স্ববাচ্যে-কবি আষাঢ় মাসে কলকাতায় এলেন। আমার ভাই গিয়েছিলেন দেখা করতে। কবি বললেন বীরেন্দ্রকিশোর, তোমার দিদি ইস্কুল-কলেজে পড়েননি , কিন্তু লেখা দেখে তা বোঝা যায় না’। আমাকে একবার দেখতে চাইলেন। আমার ছেলে , বাড়ীর অন্য সকলের প্রতিকূলতায় পাছে বিঘ্নঘটে এ জন্য সকলের অগোচরে আমাকে নিয়ে জোড়াসাঁকোয় যায়, সেই প্রথম দর্শন। সেই মুহূর্ত থেকেই আমার জীবনে একটি স্মরণীয় পরিবর্তন আসে।… মনে হয়েছিল, আমি তীর্থস্নান করে উঠলাম।
বয়সের অনেক পার্থক্য থাকলেও হেমন্তবালা ক্রমে হয়ে উঠেছিলেন রবীন্দ্রনাথের শেষ বয়সের অনুভুতির শরিক -ঘটনার অভিঘাতে বিক্ষুব্ধ চিত্তের অনুভুতি প্রকাশের নির্ভরযোগ্য আশ্রয়। অনেক গুরুতর বিষয় নিয়েও রবীন্দ্রনাথ শেষ বয়সে তাঁর এই অনুরাগিনী এবং সমঝদারের কাছে নিজের মতামত অকুণ্ঠচিত্তে ব্যক্ত করে নিজেকে মেলে ধরেছেন।
হেমন্তবালাও বলেছেন সহজ সারল্যে- আমি তো শিক্ষিত নই ,আদব-কায়দা জানি না, আমার কথাবার্তায়, চিন্তায়-আচরণে যথেষ্ট মূঢ়তা প্রকাশ পেয়েছে, সন্দেহ নাই। তবু আমি তাঁকে ছাড়তে বা ভুলতে পারিনি। সে এক অনিবার্য আকর্ষণে। অন্যদিকে হেমন্তবালার প্রথাগত শিক্ষার অভাব থাকলেও তিনি অনেক জটিল বিষয়ে কৌতুহল প্রকাশ করে রবীন্দ্রনাথকে পত্র দিতেন নিয়মিত। তাঁর বিচিত্র প্রশ্নেভরা পত্রগুলি হয়ত কবির বিরক্তি উৎপাদন করে হেমন্তবালার এমন সংশয় দূর আশ্বস্ত করতে কবি লিখছেন- তুমি নিজেকে অকারণ পরিতাপে কেন পীড়িত করচ আমি কিছুই বুঝতে পারচি নে।…তোমার চিঠি পড়তে আমার বিশেষ ভালো লাগে… নিজের পথ তোমার থেকে পৃ্থক বলেই তোমার অভিজ্ঞতার বিবরণ শুনতে আমি এত ঔৎসুক্য অনুভব করি’।
প্রসঙ্গত রবীন্দ্রনাথ-হেমন্তবালার এই দশবছর যাবৎ পত্রচর্চায় আসলে লাভবান ও ঋদ্ধ হয়েছে বৃহত্তর সমাজ।কবির মতের অনুসারী না হওয়া হেমন্তবালা্র বিবিধ জটিল প্রশ্নের উত্তর যেভাবে কবি দিয়েছেন নিজের মতো করে তাতে তাঁর মনোজগৎ উন্মোচিত হওয়ায় তাঁকে বুঝতে সুবিধা হয়েছে পাঠককুলের।
উল্লেখ্য, ঘরে বাইরে ১৯১৬ সালে(১৩২২বঙ্গাব্দ) গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হোয়ার আগেই সবুজ পত্রে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ কালেই পাঠক মহলের একাংশের মধ্যে তীব্র উত্তেজনার স্রিষ্টি হয় যে সবুজ পত্রের অগ্রহায়ন ১৩২২ সংখ্যায় রবীন্দ্রনাথকে একটি কৈফিয়ত প্রকাশ করতে হয়। উপনাস্যিকের বিরুদ্ধে প্রধানত অভিযোগ ছিল সন্দীপের বয়ানে সীতাকে অসম্মান করার। কিন্তু গ্রন্থ প্রকাশের অনেকদিন পর পর্যন্ত যে আক্রমণের প্রশমন হয়নি তার নিদর্শন অর্চনা পত্রিকার ফাল্গুন ১৩২৬ প্রকাশিত দীনবন্ধু মিত্রের পুত্র বঙ্কিম চন্দ্র মিত্রের একটি ব্যঙ্গাত্মক কবিতা যার উত্তর অবশ্য ছাপা হোয়েছিল পাল্টা একটি কবিতার মাধ্যমে যেই প্রকাশিত হয় ভারতী পত্রিকার চৈত্র সঙ্খ্যায়।
তবু উত্তেজনা স্তিমিত হয়নি দেখে রবীন্দ্রনাথ ১৩২৬ প্রবাসীর চৈত্র সঙ্খ্যায় ‘সাহিত্য বিচার ‘ নামে একটি দীরঘ কৈফিয়ত লিখলেন। যেটা উল্লেখ করার কথা এরও ১৫ বছর পরে ১৩৪১ এরআষাঢ়ে রবীন্দ্রনাথ হেমন্তবালা দেবীকে লিখছেন- তোমার কোন একতি পত্রে জনশ্রুতির কথা লিখেছ যে, আমি সীতার নিন্দা করেচি। এমন অদ্ভুত অপবাদ বাংলাদেশেই সম্ভব। সীতার সম্বন্ধে সে(সন্দীপ) যদি এমন কিছু বলে থাকে যা সীতার পক্ষে সম্মানকর নয় তাহলে সেটাকে রবীন্দ্রনাথের মূঢ়তা। দ্রৌপদীকে কীচক নিঃসন্দেহ অপমান করেছিল, দুঃশাসন সভাস্থলে তাঁর বস্ত্রহরণের চেষ্টা করেছিল এ কথাও মহাভারতে পড়েছি, বেদব্যাস্কে সেজন্যে বাঙালি সমালোচকঅও নিন্দা করেনি , আমার বেলাতেই তাদের বুদ্ধি যে যায় বিগড়ে তার কারণ তুমি জিজ্ঞাসা করো আমার জন্মনক্ষত্রকে। আমার বাঙালি জন্ম প্রায় সেষ করে এনেচি , আজ আমার ক্লান্ত আয়ুর অন্তিম নিবেদন এই যে, যদি জন্মান্তর থাকে তবে যেন বাংলা দেশে আমার জন্ম না হয়।
আবার চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের পর বিপ্লবীদের শায়েস্তা করার জন্য ব্রিটিশ সরকার মুসল্মান্দের মনে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ বাড়িয়ে তোলার কৌশল অব্লম্বনের ফলে প্রধানত চট্টগ্রামে এবং অন্যান্য অংশেও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হয়। এরই মধ্যে নৃশংস অত্যাচারী পুলিশ অফিসার আসানুল্লাকে বিপ্লবী হরিপদ ভট্টাচার্য গুলি করে হত্যা করলে সে ঘটনাকেও সাম্প্রদায়িক রঙ দিয়ে বীভৎস দাঙ্গা শুরু করা হয়। সেই দেবীকে লিখলেন- এই রকম ব্যাপারের দ্বারা দুটো গুরুতর অনিষ্ট হচ্চে। প্রথম এই- সমস্ত মুসলমান্ জাতের উপর হিন্দুর ঘৃণা জন্মে যাচ্…। যারা আমাদের আপন লোকদের এরকম সাংঘাতিকভাবে পর করে দিচ্চে তারা করচে স্বারথের জন্য ……। কিন্তু আপনার লোকদের ক্রিত অন্ধ অন্যায় তাদের নিজেরই স্বারথের বিরুদ্ধে। তারা চিরদিনের জন্যে দেশের চিত্তে যে অবিশ্বাস যে ঘৃণা আবিল করে তুলচে তাতে চিরদিনের মতোই তাদের নিজের ক্ষতি।
হেমন্তবালার সঙ্গে কবির এক অন্তরঙ্গ ও ঘরোয়া সম্পর্কের সূত্রে তাঁর দেখার সুযোগ হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের সাজপোশাকের বিষয়টি জানার। তিনি দেখেছিলেন কবির পরিধেয় কত উজ্জ্বল রঙের জোব্বা। একবার নিজের মেয়ের জন্য কবির স্মৃতি হিসেবে একটি জোব্বা চেয়েছিলেন,সঙ্গে কবি-ব্যবহৃত একটি কলম ও পোর্টফলিও। হঠাৎ করে এমন চাওয়ায় কবি হেসে জিজ্ঞেস করেছিলেন -আজ সকালে তুমি কার মুখ দেখে উঠেছিলে?
যাহোক হেমন্তবালাকে তার আকাঙ্খিত সামগ্রী তুলে দিয়ে কবি বলেছিলেন-হেমন্তবালার কন্যাটিকে অত্যন্ত স্নেহ করেন বলেই এত কিছু দিলেন।অন্য কেঊ হলে দিতেন না।
রবীন্দ্রনাথ হেমন্তবালাকে যে শেষ চিঠি লিখেছেন মৃত্যুর তিন মাস আগে ১০ মে ১৯৪১ সেটি এরকম— কল্যাণীয়াসু, জরার প্রান্তসীমায় আমি আজ শয্যাগত। তোমরা যে অর্ঘ আজ আমাকে পাঠিয়েছ মুখে উপযুক্ত সমাদর প্রকাশ করতে পারলেম না। আনন্দ অন্তরে অব্যক্ত রইল। নিশ্চিত জানি এ বৃত্তে কখনও উল্লেখিত হয় না। অভিনন্দন গ্রহণ করো।
ইতি—শুভাকাঙ্ক্ষী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ১০/০৫/৪১।
এর মাস তিন পরে ২২শে শ্রাবণ দ্বিপ্রহরে রবির মহাপ্রয়াণ ঘটে।আগের দিন থেকেই অবস্থা খারাপ হতে থাকায় সবাই আশঙ্কিত। এরই মাঝে খবর পেয়ে দুপুরের একটু আগে সন্ন্যাসিনী বেশে এলেন রবির জোনাকি হেমন্তবালা দেবী; প্রিয় কবিদাদার মাথায় কপালে তুলসীর মালা গঙ্গামাটি ছুঁইয়ে দিয়ে চলে গেলেন কবির জীবনে শেষ নারী।
রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণের পর শোকাভুতা আবেগে লিখে ছিলেন-উহার সংস্পর্শে আমি মুক্তির আনন্দ পাইতাম। আবেগাচ্ছন্ন হয়ে স্মরণ করেছেন-আমার মত ঘোর বিরুদ্ধপক্ষীয়া ,অশিক্ষিতা, শিষ্টাচারে অনভিজ্ঞা। মূর্খ স্ত্রীলোককে দীর্ঘ দিন ধরিয়া যাবতীয় দোষত্রুটি-সমেত সহ্য করিয়াছিলেন, আজ সেকথা ভাবিলে আশ্চর্যান্বিত হই।
রবি অনুরাগিনী এই অসামান্যা নারী প্রয়াত হন ৮২ বছর বয়সে ১৯৭৬ সালে।