সুপ্রকাশ বন্দ্যেপাধ্যায়
পূর্ণিমা এই একটি কথার মধ্যে আছে এক প্রশান্তি, এক অনাবিল স্নিগ্ধতা। পূর্ণিমা শব্দটির বুৎপত্তি গত অর্থ ‘পূর্ণের ভাব’। যে তিথিতে প্রতিপদের ক্ষীন শশিকলা পূর্ণতা লাভ করে, যার স্নিগ্ধ জ্যোৎস্না দিয়ে এই ধরনি হয় স্নাত, যে সন্ধান দেয় ভূবন ভোলানো মায়াময় এক স্বপ্ন রাজ্যের, তাকেই আমরা ‘পূর্ণিমা’ নামে জানি।
ছয়টি ঋতুর পরিমণ্ডলে আবৃত আমাদের দেশ ভারতবর্ষ। বছরের গ্রীষ্ম প্রথম ঋতু, বৈশাখ ও জ্যৈষ্ঠ মাসকে নিয়ে। দুটি মাসে দুটি পূর্ণিমা, প্রথমটি বৈশাখী পূর্ণিমা, দ্বিতীয়টি জ্যৈষ্ঠের পূর্ণিমা, যে পূর্ণিমাটিতে হয় জগন্নাথ দেবের স্নান যাত্রা।
বর্ষা ঋতুর আষাঢ় ও শ্রাবণ মাসে দুটি পূর্ণিমা। প্রথমটি আষাঢ়ের পূর্ণিমা যা সকলের কাছে প্রসিদ্ধ ‘গুরু পূর্ণিমা’ হিসাবে, এই পূর্ণিমাকে “ব্যাস পূর্ণিমাও” বলা হয়। দ্বিতীয় পূর্ণিমা, “শ্রাবণী পূর্ণিমা” যার পরিচয় ‘ঝুলন পূর্ণিমা’ নামে। এই পূর্ণিমাকে ‘রাখি পূর্ণিমাও’ বলা হয়। এই পূর্ণিমায় রাখি উৎসব পালন করা হয়। অন্তরের প্রেম প্রীতির মধুর বন্ধনের প্রতীক রাখি বা মাঙ্গলিক সূত্র বন্ধন। আবার কথিত যে এই শ্রাবনী পূর্ণিমায় প্রথম মানব গোচর হন ‘অমরনাথজী’ এবং এই পূণ্য তিথিতেই তিনি পূর্নবায়ব প্রাপ্ত হন।
শরতের দুটির মধ্যে ‘কোজাগরী’ পূর্ণিমাই সর্ববিদিত। এই পূণ্যতিথিতে ধনৈশ্বর্যের অধিষ্ঠাত্রী দেবী কমলার অর্চনা করা হয়। ‘কোজাগরী’-অর্থাৎ জাগরনের মন্ত্র বিশ্ব মানবকে শেখায় মোহ, নিদ্রা ত্যাগ করে ‘শ্রী’র আরাধনায় ব্রতী হতে। এছাড়াও মহর্ষি বাল্মীকির আবির্ভাব দিবসও এই তিথিতে। অন্য পূর্ণিমাটি হল ভাদ্রী পূর্ণিমা।
হেমন্তের পূর্ণিমার মধ্যে ‘রাসপূর্ণিমা’র আধিক্ষ লক্ষ্য করা যায়। এই পূর্ণিমাতেই শিখ ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা গুরু নানকের শুভ আবির্ভাব ঘটে।
শীত ঋতুর পৌষ পূর্ণিমার ভারতজুড়ে আরাধনা হয় শ্রী দাত্রী দিব্য শক্তির দক্ষিণ ভারতে ‘পোঙ্গল’, অসমে ‘ভোগালী বিহু’, বঙ্গদেশে লক্ষ্মী পূজার মাধ্যমে, পার্বনের মাধ্যমে মহাশক্তি অর্থাৎ সম্পদের দেবীর আরাধনা করা হয়।
শীত ঋতুর আর এক পূর্ণিমা “মাঘি পূর্ণিমা”। শাস্ত্রে আছে ‘স্নানং মনোমল ত্যাগঃ।’ সব মালিন্যমুক্ত হয়ে সর্বশুচি জ্যোতিময় পরম পূর্ণের স্মরণে, মননে, মানব জীবন সার্থক হোক— স্নিগ্ধজ্জল চন্দ্রকিরণ বিধৌত মাঘী পূর্ণিমায় এই শাশ্বত সত্যের প্রকাশ।
বর্ষের শেষ ঋতু বসন্তের প্রথম পূর্ণিমা হল দোল পূর্ণিমা। শেষ পূর্ণিমা অর্থাৎ চৈত্রের পূর্ণিমার এক বিশেষ উৎসব বলদেবের রাসযাত্রা।
সমস্ত পূর্ণিমাগুলির মধ্যে ভারতবর্ষের সুপ্রাচীন সনাতন সংস্কৃতির নির্যাসরূপ ‘গুরু পূর্ণিমা’ আমাদের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উত্তরাধিকার। গুরু পূর্ণিমা কি? সনাতন ধর্মের প্রদীপ্ত মহর্ষি বেদব্যাস, যিনি সত্যবতীর গর্ভে এসেছিলেন, পিতা পরাসর, তার জন্ম তিথিই ‘গুরু পূর্ণিমা হিসাবে পালন করা হয়। অন্ধকার বা অজ্ঞানকে যিনি নিরুদ্ধ বা বিনাশ করেন তাঁকে ‘গুরু’ বলা হয়। ‘গু’ শব্দের অর্থ হল অন্ধকার, ‘রু’ শব্দের অর্থ নিরোধক অর্থাৎ যিনি আমাদের মনের অন্ধকারকে দূর করে আলোর পথে নিয়ে যান, তিনিই প্রকৃত গুরু। কারণ অন্ধকার নিজে কখনো আলো নিয়ে আসে না। আলোই অন্ধকার দূর করে। সেই জন্য বলা ‘গুরু পূর্ণিমা’ অর্থাৎ গুরু অন্তর থেকে ‘জ্ঞান পূর্ণিমা’ প্রজ্জ্বলিত করে মানব জাতির মন হতে অজ্ঞান ও আঁধারকে দূর করেন।
আদি, অনন্ত মহাবিষ্ণু অনন্ত শয্যায় শায়িত হয়ে চিন্তা করলেন। ‘একো হহং বহুস্যাম্ প্রজায়েম’। অর্থাৎ আমি এক থেকে বহু হব। ফলত তার নাভি কমলে সৃষ্ট হল ব্রহ্মার। শ্রী বিষ্ণু ভাবলেন তিনি জীবকে মুক্তিমন্ত্র দেবেন, সৃষ্টি হল বেদের। এই বেদজ্ঞানের বা ব্রহ্মজ্ঞানের প্রথম অধিকারী ব্রহ্মা। তাই আদি গুরু পরব্রহ্মাই, আদি শিষ্য ব্রহ্মা। পরব্রহ্ম এই বেদজ্ঞান দেন ব্রহ্মাকে আষাঢ় পূর্ণিমাতে। তাই আষাঢ় মাসের পূর্ণিমা গুরু পূর্ণিমা নামে খ্যাত।
পরবর্তী কালে ব্রহ্মা এই বেদজ্ঞান দিলেন চার ঋষি- সনক, সনন্দন, সনৎ কুমার ও সনাতনকে। আবার এই ঋষি চতুষ্ঠয় বেদজ্ঞান দিলেন, অত্রি, মরীচি, আঙ্গীরা, পুলস্ত্য ত্রুতু, বশিষ্ঠ, পুলহ, এই সপ্তর্ষিকে। পরে গুরু ও শিষ্য পরম্পরায় এই জ্ঞান এলো সকলাচার্যের কাছে। এই সকলাচাৰ্য্য কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন ব্যাস দেবের গুরু।
ব্যাস দেৱ এই জ্ঞান বা মহাজ্ঞান চার ভাগে ভাগ করেন। নামকরন হয় ঋক, সাম, যজুঃ, অথর্ব। তার চার শিষ্য পৈল, জৈমিনী, বৈশম্পায়ন ও সুমন্তকে এই চারটি বেদের ভার দিলেন। তাঁরা ভূ-ভারতের চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে বেদের অভূতপূর্ব বিস্তার ঘটালেন। সেই থেকে ব্যাসদেবের নাম হলো বেদব্যাস।
‘বেদ’ অর্থে ‘জ্ঞান’ ও ‘ব্যাস’ অর্থে উপাধিকেই ধরতে হবে বেদব্যাস হলেন “জ্ঞানময় বিগ্রহ”। আষাঢ় পূর্ণিমায় ব্যসদেব জন্মগ্রহন করেন এবং এই দিনেই বেদ বিভাগ করেন, তাই এই দিনটি ব্যাস পূর্ণিমা নামেও সমাদৃত।
সেদিন বেদব্যাস প্রতিষ্ঠা করলেন শান্তি ও সংহতির বটবৃক্ষ যার স্নিগ্ধ ছায়ায় উৎপাটিত হ’ল হিংসা নামক বৃষবৃক্ষ। তিনি রক্ষা করেছিলেন বিশ্ব মানবতাকে।
গুরু পূর্ণিমার মত দেবাঞ্জলির আজকের দিনেও বড় প্রয়োজন। এই অঞ্জলির মাধ্যমে, গুরুবন্দনার মাধ্যমে এই ধরিত্রীকে হিংসা মুক্ত করে শান্তির, ভালবাসার এক জ্যোৎস্নালোকিত মায়াময় স্বপ্নরাজ্যে প্রতিষ্ঠা করার দিন। গুরুপূর্ণিমার দিনটিতে তাই আজ প্রকৃত গুরুর প্রয়োজন। যিনি মানব জাতিকে দেবেন, জ্ঞান, বিবেক, বোধ। আর এই জ্ঞান, বিবেক, বোধ শক্তিই গড়ে তুলবে এক সুন্দর হিংসামুক্ত পৃথিবী। তাই ‘গুরু পূর্ণিমা’ কোন ধর্মের নয়, সৎপথে জীবন প্রবাহিত করার স্বার্থেই ‘গুরু পূর্ণিমা’ আজ “সার্বজনীন”। জীবন পথে সঠিক ভাবে চলার জন্য ‘গুরুপূর্ণিমার’ দিনটিই হল আমাদের শপথ নেবার দিন। এই দিনের গুরুত্ব অপরিসীম।