• facebook
  • twitter
Monday, 11 August, 2025

হিন্দু, হিন্দুরাষ্ট্র ও হিন্দুত্ব

সংবিধানের প্রস্তাবনা থেকে ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ এবং ‘সমাজতান্ত্রিক’ শব্দ দু’টি বাদ দেওয়ার জন্য এখন আরএসএস উঠে পড়ে লেগেছে।

প্রতিনিধিত্বমূলক চিত্র

ভারতের সংবিধান কোনও একটি ভাষাকে জাতীয় ভাষা বা রাষ্ট্রভাষা বলে স্বীকৃতি দেয়নি। নানা ভাষা, নানা মত, নানা পরিধানের এই দেশে ২২টি গুরুত্বপূর্ণ ভাষাকে স্বীকৃতি দিয়েছে সংবিধান। আর প্রশাসনিক যোগাযোগ ও সমন্বয়ের সুবিধার্থে ইংরেজি ভাষার ব্যবহার গুরুত্ব পেয়েছে। সংখ্যার বিচারে দেশে সর্বাধিক সংখ্যক মানুষ হিন্দি ভাষায় কথা বলে মানে এই নয় যে বাধ্যতামূলকভাবে হিন্দিকে সব ভারতবাসীর উপর চাপিয়ে দিতে হবে। হিন্দি অবশ্যই গোবলয় বা হিন্দি বলয়ের ভাষা। গোবলয়েই ধর্মান্ধতা ও কুসংস্কারের ছড়াছড়ি। আর সেখানেই আরএসএস-বিজেপির প্রভাব প্রতিপত্তি বেশি। হিন্দুত্ববাদের মূল ভিত্তি যেহেতু যুক্তিবাদ ও বিজ্ঞান মনস্কতার বিপরীত মেরুতে তাই ধর্মান্ধতা, কুসংস্কার ও অন্ধ বিশ্বাসের আঁধারেই হিন্দুত্ববাদের রমরমা। স্বাভাবিকভাবেই হিন্দির প্রতি হিন্দুত্ববাদীদের দুর্বলতা প্রকট। হিন্দুত্ববাদীদের ধারণা হিন্দি ভাষাকে আশ্রয় করেই সমগ্র ভারতের সাধারণ মানুষকে হাতের মুঠোয় আনা সহজ হবে। এমন ভাবনার মূলে রয়েছে হিন্দু, হিন্দি, হিন্দু রাষ্ট্র ও হিন্দুত্ব। ভারতের রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বে থাকা আরএসএস-এর আপাতত এটাই প্রধান লক্ষ্য। সেই লক্ষ্যকেই সামনে রেখে কাজ করে চলেছে সঙ্ঘবাহিনী।

জাত-ধর্ম-বর্ণ-ভাষা-সংস্কৃতির অফুরন্ত ভিন্নতা এবং তার মধ্যে সমন্বয়ের ধারাই ভারতের প্রকৃত ঐতিহ্য। ভারত রাষ্ট্র এটাকেই তার সংবিধানের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত করেছে। আরএসএস এই ঐতিহাসিক ও পরম্পরাগত সত্য ও বাস্তবকে অস্বীকার করে। তাই এক দেশ, এক দল, এক ভোট, এক ভাষা, এক ধর্ম, এক সংস্কৃতির মন্ত্রে তারা দীক্ষিত। তারা মনে করে হিন্দু ছাড়া ভারতে অন্য ধর্মের জায়গা নেই। ভাষা হিসাবে একমাত্র হিন্দিই মান্যতা পাবে। আর সংস্কৃতি হিন্দু ধর্মে আধারের বাইরের কিছু গ্রহণ করা যাবে না। মোদী সরকার আরএসএস-এর এই মৌলিক অ্যাজেন্ডাকে সামনে রেখেই হিন্দি, হিন্দু এবং হিন্দু রাষ্ট্রের পথে এগোতে চাইছে।
কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বলেছেন, এমন এক সমাজ তাঁরা গড়ে তুলছেন যেখানে ইংরেজিতে কথা বলা লজ্জার বিষয় হবে। অর্থাৎ ইংরেজি বর্জনের পক্ষে জোরালো মত প্রকাশ করেছেন। আড়ালে আছে হিন্দির আধিপত্য। ইংরেজিকে নস্যাৎ করে তার ব্যবহার যদি কমিয়ে দেওয়া যায় তাহলে হিন্দির জন্য খোলা মাঠ মিলে যাবে। শাহর ইংরেজি বিদ্বেষে প্রবল প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে বিভিন্ন মহলে। মাতৃভাষা হিসেবে কোনও ভাষাই ছোট নয়। ভারতে প্রায় ২০ হাজার ভাষা ও উপভাষা আছে। সব ভাষার আধারে স্বতন্ত্র সংস্কৃতি রয়েছে। ভাষার সঙ্গে ধর্মের কোনও যোগ নেই। তাই সব আঞ্চলিক ভাষাকেই গুরুত্ব দিয়ে বহুত্বের ভারতীয়কে চির ভাস্বর রাখতে হবে।

সংবিধানের প্রস্তাবনা থেকে ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ এবং ‘সমাজতান্ত্রিক’ শব্দ দু’টি বাদ দেওয়ার জন্য এখন আরএসএস উঠে পড়ে লেগেছে। আসরে নেমে পড়েছেন বিজেপি কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ও মুখ্যমন্ত্রীরা। তবে সব থেকে আগে আছেন উপরাষ্ট্রপতি জগদীপ ধনকড়। রাষ্ট্রপতি, উপরাষ্ট্রপতি পদগুলি এতদিন দলীয় রাজনীতির বৃত্তের বাইরে থাকতো, অন্তত প্রকাশ্যে একটা নিরপেক্ষ ভাবমূর্তি বজায় রাখতেন পদাধিকারীরা। কিন্তু ধনকড় যে কোনও রাজনৈতিক বিষয়ে সঙ্ঘের স্বেচ্ছাসেবকদের মতো আচরণ করেন। এক্ষেত্রেও তার অন্যথা হয়নি। ধনকড় আরএসএস-এর সাধারণ সম্পাদক দত্তাত্রেয় হোসাবালের সুরে সুর মিলিয়ে বলেছেন, সংবিধানের প্রস্তাবনা পবিত্র এবং অপরিবর্তনীয়। কিন্তু সেই কাজ করা হয়েছিল জরুরি অবস্থার সময়ে। ওই সময় যে দু’টি শব্দ সংবিধানে যুক্ত করা হয়েছিল, তা সনাতন ধারণার প্রতি অবমাননা।

অসমের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা বলেছেন, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা হলো পশ্চিমী ধারণা। সংবিধান থেকে এই দু’টি শব্দকে বাদ দিতে হবে। ভারতীয় সভ্যতায় এই দু’টি শব্দের কোনও জায়গা নেই। কৃষি ও গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রী শিবরাজ সিং চৌহান বলেছেন, ভারতীয় সংস্কৃতির মর্মবস্তুতে সমাজতন্ত্র নেই। এনসিপি (এসপি) নেত্রী সুপ্রিয়া সুলে অবশ্য বলেছেন, দীর্ঘ আলাপ-আলোচনার পরে সংবিধান গ্রহণ করা হয়েছিল। এটাকে বদলে ফেলার অধিকার কারোকে দেওয়া যাবে না।

যে সংবিধানে হাত রেখে শপথ নিয়ে মন্ত্রী হয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ প্রমুখ তাঁরাই পদে পদে সংবিধানকে অশ্রদ্ধা ও অবহেলা করছেন হিন্দুত্ববাদী আত্ম পরিচিতি সত্তার প্রাবল্যে। তাই আরএসএস-বিজেপি সত্তার আড়ালে চাপা পড়ে যায় মন্ত্রীদের পরিচয়। আরএসএস-এর সুরে সঙ্গত দিতে আসরে নেমে পড়েন উপরাষ্ট্রপতি, কেন্দ্রীয় মন্ত্রীরা এবং বিজেপি শাসিত রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীরা।