• facebook
  • twitter
Friday, 23 May, 2025

হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক এবং রবীন্দ্রনাথ

আজও আমরা সে দিকেই চেয়ে থাকি কবে হিন্দু-মুসলমান পরস্পরকে সম্পূর্ণ করে জানবে, মিথ্যা রেষারেষি হিংসা বিদ্বেষ দূর হবে। তাঁর দেখানো পথেই হাঁটতে চেষ্টা করি।

ফাইল চিত্র

প্রবীর মজুমদার

রবীন্দ্রনাথ নিজের ধর্ম সম্পর্কে স্পষ্ট করে বলেই দিয়েছিলেন, “কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম আমার ধর্ম নয়।… আমি ব্রাত্য, আমি মন্ত্রহীন, আমি পঙ্ক্তিহারা, আমি তোমাদেরই লোক।” তাই বলে রবীন্দ্রনাথ ঈশ্বরের অস্তিত্বে অবিশ্বাসী হয়ে ‘ধর্মহীন’ও ছিলেন না। উপনিষদে, মহাকাব্যের দর্শনে আপ্লুত হয়ে ভারতের তিন হাজার বছরের জীবন সাধনার সার্থক বাণীবাহক রূপে তাঁর আহ্বান ছিল, “শৃনন্তু বিশ্বে অমৃতস্য পুত্রাঃ”। বিশ্ব মানবের কোনো ধর্মীয় ও স্বতন্ত্র সাম্প্রদায়িক পরিচয় নেই, তাঁর কাছে সকল মানুষ ‘অমৃতের সন্তান’। তাঁর প্রতিষ্ঠিত ‘বিশ্বভারতী’ও মানুষের তৈরি সমস্ত ভেদ এবং ভিন্নতার ঊর্ধ্বে বিশ্ব মানবের একত্রে মিলিত হওয়ার ঠাঁই। “যত্র বিশ্ব ভবত্যেক নীড়ম্”। রবীন্দ্রনাথের ধর্ম ও ঈশ্বর তাই একান্তভাবেই মানবকেন্দ্রিক। রবীন্দ্রনাথের অতলস্পর্শী, অতুলনীয়, গভীর মানবপ্রেমের আধ্যাত্মচিন্তা তাঁর কাব্যে, সংগীতে, সাধনায় এবং তাঁর সৃষ্টির কূলে উপকূলে ছড়িয়ে আছে। তাই দেবতার আলাদা আসন নিয়ে টানাটনিকে তিনি বরদাস্ত করেননি।

আমাদের দেশে হিন্দু-মুসলমানের বিরোধ রবীন্দ্রনাথকে সবসময়েই ব্যথিত করেছে। তিনি এই আত্মঘাতী সাম্প্রদায়িক সমস্যার স্থায়ী সমাধানের পথ খুঁজেছেন জীবনভর। সেই কবে, তাঁর যৌবনকালে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, “যে-দেশে প্রধানত ধর্মের মিলেই মানুষকে মেলায়, অন্য কোনো বাঁধনে তাঁকে বাঁধতে পারে না, সে-দেশ স্বয়ং ধর্মকে দিয়ে যে-বিভেদ সৃষ্টি করে সেইটে সকলের চেয়ে সর্বনেশে বিভেদ।” মনুষ্য-সৃজিত এই হিন্দু-মুসলমান বিভেদকে তিনি অন্যায় এবং পাপ বলে চিহ্নিত করে লিখেছেন, “এ পাপ অনেক দিন হইতে চলিয়া আসিতেছে।” ১৩১৪ বঙ্গাব্দে প্রবাসী পত্রিকায় তাঁর অন্তর্ভেদী নিবেদন, “আমরা এক দেশে এক সুখদুঃখের মধ্যে একত্রে বাস করি, আমরা মানুষ, যদি এক না হই তবে সে লজ্জা, সে অধর্ম।” এই বছরেই পাবনায় ভারতীয় কংগ্রেসের প্রাদেশিক সম্মিলনীতে সভাপতির ভাষণে তিনি আবার হিন্দু মুসলমান সাম্প্রদায়িক বিরোধের উল্লেখ করে সমবেত রাজনীতিকদের বললেন, “এদিকে একটা প্রকাণ্ড বিচ্ছেদের খড়্গ দেশের মাথার উপর ঝুলিতেছে। কত শত বৎসর হইয়া গেল, আমরা হিন্দু ও মুসলমান একই দেশমাতার দুই জানুর উপরে বসিয়া একই স্নেহ ভোগ করিতেছি। তথাপি আজও আমাদের মিলনে বিঘ্ন ঘটিতেছে।” তিনি আক্ষেপ করে বললেন, “আমরা কথায় কথায় শাস্ত্রের দোহাই পাড়ি ,অথচ শাস্ত্রে হিন্দু-মুসলমান সম্বন্ধে পরস্পরকে এমন করিয়া ঘৃণা করিবার তো কোনো বিধান দেখি না।” অতঃপর দেশের রাজনৈতিক স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখাবার জন্য যে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ মিলিত হয়েছেন তাঁদের উদ্দেশ্য করে বললেন, “মানুষকে ঘৃণা করা যে দেশে ধর্মের নিয়ম, প্রতিবেশীর হাতে পানি খাইলে যাহাদের পরকাল নষ্ট হয়,… (সে দেশে) স্বদেশ-জাতি-স্বরাজ্যের প্রতিষ্ঠা কোনোদিন হইবে না।”

১৯২২ সালে কালিদাস নাগ বিলেত থেকে চিঠি লিখে জানতে চাইলেন, ‘হিন্দু-মুসলমান সমস্যার সমাধান কি? চিঠির জবাবে কবি লিখলেন: “খিলাফত উপলক্ষে মুসলমান নিজের মসজিদে এবং অন্যত্র হিন্দুকে যত কাছে টেনেছে, হিন্দু মুসলমানকে তত কাছে টানতে পারেনি। আচার হচ্ছে মানুষের সম্বন্ধের সেতু, সেখানেই পদে পদে হিন্দু নিজের বেড়া তুলে রেখেছে।…অন্য আচার অবলম্বীদের অশুচি বলে গণ্য করার মত মানুষের মিলনের এমন ভীষণ বাধা আর কিছুতেই নেই।” চিঠির শেষে রবীন্দ্রনাথ লিখলেন, “আমরাও মানসিক অবরোধ কেটে বেরিয়ে আসবো।”

মুসলমানের বৈশিষ্ট্য ও ভারতবর্ষে তাদের অধিকার হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, “হিন্দু মুসলমানের সম্বন্ধে লইয়া আমাদের দেশে একটা পাপ আছে। এ পাপ অনেক দিন হইতে চলিয়া আসিতেছে। ইহার যা ফল তাহা না ভোগ করিয়া আমাদের কোন মতেই নিস্তার নাই।”

হিন্দুরা মুসলমানদের ব্যাপারে যে মনোভাব পোষণ করতো তা কবিকে ব্যথিত করেছিল। তার জন্য তিনি হিন্দু সম্প্রদায়কেই প্রধানত দায়ী করেন। কিশোর বয়সের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি ‘হিন্দু-মুসলমান’ প্রবন্ধে বলেন, “…আমি হিন্দুর তরফ হইতে বলছি, মুসলমানের ত্রুটি বিচারটা থাক— আমরা মুসলমানকে কাছে টানতে যদি না পেরে থাকি তবে সেজন্যে যেন লজ্জা স্বীকার করি। অল্পবয়সে যখন প্রথম জমিদারি সেরেস্তা দেখতে গিয়েছিলুম তখন দেখলুম, আমাদের ব্রাহ্মণ ম্যানেজার যে-তক্তপোশের গদিতে বসে দরবার করেন সেখানে একধারে জাজিম তোলা, সেটা মুসলমান প্রজাদের বসবার জন্য; আর জাজিমের উপর বসে হিন্দু প্রজারা। এইটা দেখে আমার ধিক্কার জন্মেছিল।”
রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, “তর্ক করিবার বেলায় বলিয়া থাকি কি করা যায়, শাস্ত্র তো মানিতে হইবে। অথচ শাস্ত্রে হিন্দু-মুসলমান সম্বন্ধে পরস্পরকে এমন করিয়া ঘৃণা করি বার তো কোনো বিধান দেখি না। যদি বা শাস্তির বিধানই হয়, তবে সে অস্ত্র লইয়া স্বদেশ-জাতি-স্বরাজ্যের প্রতিষ্ঠা কোনোদিন হইবে না। মানুষকে ঘৃণা করা যে দেশে ধর্মের নিয়ম, প্রতিবেশীর হাতে পানি খাইলে যাহাদের পরকাল নষ্ট হয়, পরকে আপন করিয়া যাহাদের জাতি রক্ষা করিতে হইবে, পরের হাতে চিরদিন অপমানিত না হইয়া তাহাদের গতি সহ্য করিতে হইবে।”

সবার অংশগ্রহণে গঠিত যে মহান সভ্যতার উল্লেখ রবীন্দ্রনাথ করেছেন তার দেহ ও আত্মায় হিন্দু ও মুসলমান এই দু’টি জাতিসত্ত্বার গুরুত্ব ও ভূমিকাই মুখ্য । তিনি মুসলমানের মর্যাদা, অধিকার ও প্রকৃত মূল্যায়নকে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন এবং এই দু’টি জাতিসত্ত্বার মিলনকে এত গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করে জাতির অস্তিত্বের স্বার্থে হিন্দু সমাজকে তা বোঝাতে চেয়েছেন। এখানেও তাঁর ভাষাতেই বলা যায়, “এ দিকে একটা প্রকাণ্ড বিচ্ছেদের খড়্গ মাথার উপর ঝুলিতেছে। এই দুর্বলতার কারণ যতদিন আছে ততদিন আমাদের দেশের কোন মহৎ আশাকে সম্পূর্ণ সফল করা সম্ভব হইবে না …আমরা (হিন্দু) গোড়া হইতে ইংরেজদের স্কুলে বেশি মনোযোগের সাথে পড়া মুখস্ত করিয়াছি বলিয়া গভর্নমেন্টের চাকরি ও সম্মানের ভাগ মুসলমান ভ্রাতাদের চেয়ে আমাদের অংশে বেশি পড়িয়াছে সন্দেহ নেই। এই টুকু (‘পার্থক্য’) কোন মতে না মিটিয়া গেলে আমাদের মনের মিলন হইবে না।”

রবীন্দ্রনাথ আরও জানালেন: “আমরা যে মুসলমানদের অথবা আমাদের দেশের জনসাধারণের যথার্থ হিতৈষী তাহার কোন প্রমাণ দিই নাই। অতএব তাহারা আমাদের হিতৈষিতায় সন্দেহ করলে তাহাদিগকে দোষী করা যায় না। …আমরা যে দেশের সাধারণ লোকের ভাই তাহা দেশের সাধারণ লোকে জানে না এবং আমাদের মনের মধ্যেও সে যে তাহাদের প্রতি ভ্রাতৃত্ব ভাব অত্যন্ত জাগরুক— আমাদের ব্যবহারে এখনো তাহার কোনো প্রমাণ নাই।”

মুসলমানদের বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ তাঁর অনুভব ব্যক্ত করেছেন এ ভাবে, “স্বদেশীযুগে আমরা দেশের মুসলমানদের কিছু অস্বাভাবিক উচ্চস্বরে আত্মীয় বলিয়া, ভাই বলিয়া ডাকাডাকি শুরু করিয়াছিলাম। সেই স্নেহের ডাকে যখন তারা অশ্রু গদগদ কন্ঠে সাড়া দিল না তখন আমরা তাহাদের উপর ভারী রাগ করিয়াছিলাম। ভাবিয়াছিলাম এটা নিতান্তই ওদের শয়তানি। একদিনের জন্যও ভাবি নাই, আমাদের ডাকের মধ্যে গরজ ছিল কিন্তু সত্য ছিল না…। বাংলার মুসলমান যে এই বেদনায় আমাদের সাথে সাথে এক হয় নাই তাহার কারণ তাদের সাথে আমরা কোনোদিন হৃদয়কে এক হইতে দিই নাই।”
তাঁর মুসলমানকে কাছ থেকে দেখা এবং তাঁদের জানা পূর্ববঙ্গে জমিদারি সামলাতে গিয়ে। উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত জমিদারি দেখাশোনা করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথকে মুসলমান প্রজাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ভাবে মিশতে হয়েছে। তিনি সেই অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন, ‘হিন্দু-মুসলমান’ প্রবন্ধে, “আমার অধিকাংশ প্রজাই মুসলমান। কুরবানি নিয়ে দেশে যখন একটা উত্তেজনা প্রবল তখন হিন্দু যারা আমাদের এলাকায় সেটা সম্পূর্ণ রহিত করার জন্য আমার কাছে নালিশ করেছিল। সে নালিশ আমি সংগত মনে করিনি, কিন্তু মুসলমান প্রজাদের ডেকে যখন বলে দিলুম কাজটা যেন এমনভাবে সম্পন্ন করা হয় যাতে হিন্দুদের মনে অকারণে আঘাত না লাগে তারা তখনই তা মেনে নিল। আমাদের সেখানে এ পর্যন্ত কোনো উপদ্রব ঘটেনি। আমার বিশ্বাস তার প্রধান কারণ, আমার সঙ্গে আমার মুসলমান প্রজার সম্বন্ধ সহজ ও বাধাহীন। একথা আশা করাই চলে না যে, আমাদের দেশের ভিন্ন ভিন্ন সমাজের মধ্যে ধর্মকর্মের মতবিশ্বাসের ভেদ একেবারেই ঘুচতে পারে। মনুষ্যত্বের খাতিরে আশা করতেই হবে, আমাদের মধ্যেমিল হবে।”

হিন্দু মুসলমানের বিরোধ তাঁকে সবসময়েই ব্যথিত করেছে। ওই সাম্প্রদায়িক সমস্যার স্থায়ী সমাধানের পথ খুঁজেছেন জীবনভর। ১৯৩১ সালে কবি বলছেন, “যতদিন পর্যন্ত হিন্দু কিংবা মুসলমানের মধ্যে কোন একটি সম্প্রদায় অথবা উভয় সম্প্রদায়ের দীর্ঘ ভ্রাতৃবিরোধী সংগ্রামে সম্পূর্ণরূপে ক্লান্ত হইয়া পড়িবে, কিংবা শিক্ষার ফলে তাহাদের মধ্যযুগীয় মনোবৃত্তি সম্পন্ন পরিবর্তন সাধিত না হইবে, ততদিন পর্যন্ত আমি ঐ সমস্যার স্থায়ী সমাধানের কোন লক্ষণ দেখি না।”

রবীন্দ্রনাথ যথার্থই মনে করতেন হিন্দু-মুসলমানের বিরোধ দূর হতে পারে মেলামেশা চেনাজানার মধ্যে দিয়ে। সেটাই একমাত্র পথ। এই পাঠ শেষ করব কবির বিশ্বভারতী পরিষদে ১৩৩২ সনে বক্তৃতার একটি উক্তি দিয়ে, “যে অন্ধকারে ভারতবর্ষে আমরা পরস্পরকে ভালো দেখতে পাইনে সেইটাই আমাদের সকলের চেয়ে দুর্বলতার কারণ। …ভারতবর্ষের সেই রাত্রি চিরন্তন হয়ে রয়েছে। মুসলমান বলতে কী বোঝায় তা সম্পূর্ণ করে আপনার করে অর্থাৎ রামমোহন রায় যেমন করে জানতেন, তা খুব অল্প হিন্দুই জানেন। হিন্দু বলতে কী বোঝায় তাও বড়ো করে আপনার করে, দারাশিকো একদিন যেমন করে বুঝেছিলেন, অল্প মুসলমানই জানেন। অথচ এই রকম গভীর ভাবে জানার ভিতরেই পরস্পরের ভেদ ঘোছে।”

আমাদের দেশে হিন্দুরা সংখ্যাগরিষ্ঠ, মুসলমান সংখ্যায় লঘু, শিক্ষায় পশ্চাৎপদ ও সুযোগে বঞ্চিত। এ অবস্থায়, হিন্দুর সামাজিক কর্তব্য ছিল তাদের আগলে রাখা এবং এগিয়ে দেওয়া, এ ভাবনা রবীন্দ্রনাথের। তিনিই লিখেছেন, “আমরা যে মুসলমানদের… যথার্থ হিতৈষী তাহার কোন প্রমাণ দিই নাই। অতএব তাহারা আমাদের হিতৈষিতায় সন্দেহ করিলে তাহাদিগকে দোষী করা যায় না।… আমাদের মনের মধ্যেও যে তাহাদের প্রতি ভ্রাতৃত্ব ভাব অত্যন্ত জাগরূক – আমাদের ব্যবহারে এখনো তাহার কোনো প্রমাণ নাই।’’ খুব খোলাখুলি তিনি নির্মম বাস্তব চিত্র তুলে ধরেছেন এই বলে যে, স্বদেশের আন্দোলনে আমরা মুসলমানদের ডাক পাঠিয়েছিলাম প্রয়োজনের তাগিদে, অন্তরের আবেগে নয়। “স্বদেশীযুগে আমরা দেশের মুসলমানদের…ভাই বলিয়া ডাকাডাকি শুরু করিয়াছিলাম।… একদিনের জন্যও ভাবি নাই, আমাদের ডাকের মধ্যে গরজ ছিল কিন্তু সত্য ছিল না…। বাংলার মুসলমান যে এই বেদনায় আমাদের সাথে সাথে এক হয় নাই তাহার কারণ তাদের সাথে আমরা কোনোদিন হৃদয়কে এক হইতে দিই নাই ।’’

আজও আমরা সে দিকেই চেয়ে থাকি কবে হিন্দু-মুসলমান পরস্পরকে সম্পূর্ণ করে জানবে, মিথ্যা রেষারেষি হিংসা বিদ্বেষ দূর হবে। তাঁর দেখানো পথেই হাঁটতে চেষ্টা করি। আশায় থাকি, শান্তিকল্যাণ হবে সমাজ সংসার।

রবীন্দ্রনাথ আজীবন বিশ্বাস করেছেন, বলেছেন এবং লিখেওছেন, হিন্দু-মুসলমানের বিরোধ, বিতর্ক ও বিবাদ দূর হতে পারে শিক্ষার প্রসার এবং সামাজিক মেলামেশা, চেনাজানা ও সম্পর্ক স্থাপনের মধ্যে দিয়ে। কুসংস্কার, জাতিভেদ, ধর্মানুশাসনে ক্ষত বিক্ষত রবীন্দ্রনাথের ‘গোরা’ উপন্যাসের গোরা কঠিন দুঃখের মধ্যে দিয়েই একদিন পরম সত্য আবিষ্কার করেছিল, হিন্দুয়ানির গোঁড়ামির বাঁধ ভেঙে সে ভাসতে পেরেছিল ভারতীয়ত্ব ও বিশ্বমানবতার প্লাবনে। পরেশবাবুর পদতলে বিনত নম্রতায় গোরার স্বীকারোক্তিঃ “…আজ আমি মুক্ত, পরেশবাবু… আমি যা দিনরাত্রি হতে চাচ্ছিলুম অথচ হতে পারছিলুম না, আজ আমি তাই হয়েছি।” তারপর… “আজ আমি ভারতবর্ষীয়। আমার মধ্যে হিন্দু, মুসলমান, খ্রিস্টান কোনো সমাজের কোনো বিরোধ নেই। আজ ভারতবর্ষের সকলের জাতই আমার জাত, সকলের অন্নই আমার অন্ন।… সেই দেবতার মন্ত্র দিন যিনি কেবল হিন্দুর দেবতা নন, তিনি ভারতবর্ষীয়ের দেবতা… ”।

কবির দেখানো পথের দিকেই তাকিয়ে আছি আমরা, কবে হিন্দু মুসলমান পরস্পরকে সম্পূর্ণ করে জানবে, অকারণ হিংসা বিদ্বেষ মুছে গিয়ে সকলের পরিচয় হবে ভারতীয়, সকলের দেবতা হবে “ভারতবর্ষীয়ের দেবতা’’…। আজ আমাদের দেশে এবং বিশেষত রাজ্যে যে সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তা যথেষ্ট উদ্বেগের। বারবার কেন ঘুরে ফিরে আসে এই দুঃসময়? গত কয়েক বছরে এ রাজ্যে যুযুধান রাজনৈতিক মত প্রতিষ্ঠার তাগিদে তারা ধর্ম নিয়ে যে খেলা শুরু করেছে তারই পরিণতিতে এই পরিস্থিতি। সাধারণ মানুষকে তার যে কি ফল ভুগতে হয়, তা রাজ্যবাসীর থেকে ভালো আর কে জানে!