• facebook
  • twitter
Wednesday, 4 December, 2024

মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আত্মজীবনী’ থেকে

আমি একটা মোটা চাদর গায়ে দিয়া পাড়ে দাঁড়াইয়া গঙ্গার সেই প্রমত্ত ভীষণ মূর্ত্তির মধ্যে সেই ‘মহদ্ভয়ং বজ্রমুদ্যতং’ পরমেশ্বরের মহিমা অনুভব করিতে লাগিলাম। আমাদের সঙ্গের পান্সীখানা সকল আহরীয় সামগ্রী লইয়া গঙ্গার গর্তে ডুবিয়া গেল।

মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। ফাইল চিত্র

পূর্ব প্রকাশিতের পর

আমি বসিলে তিনি বলিলেন, ‘আদা’, অমনি তাহাদের মধ্যে একটি মেয়ে আসিয়া আমার হাতে একটি গোলাকৃতি পানের ডিবা দিল। আমি খুলে দেখি যে, তাহাতের পানের মশলা। বৌদ্ধ গৃহীদিগের এই অতিথি সৎকার। তিনি তাঁহাদের দেশের উৎকৃষ্ট অশোক জাতীয় কতকগুলা ফুলের চারা আমাকে উপহার দিলেন। আমি তাহা বাড়ী আনিয়া বাগানে রোপণ করিয়াছিলাম, কিন্তু এদেশে অনেক যত্নেও তাহা রক্ষা করিতে পারিলাম না। এই গাছের যে ফল হয়, বর্ম্মাদিগের তাহা অত্যন্ত প্রিয় খাদ্য। যদি ১৬ টাকা কাছে থাকে, তবে তাহা দিয়াও সেই ফল খরিদ করিবে। তাহাদের এই উপাদেয় খাদ্য কিন্তু আমাদের ঘ্রাণেরও অসহ্য।
(১৮৫৬-১৮৫৭)

আমি যে আশ্বিন মাসের জন্য প্রতীক্ষা করিতেছিলাম, তাহা এক্ষণে উপস্থিত হইল। কাশী পর্য্যন্ত এক শত টাকায় একটি বোট ভাড়া করিলাম। ১৭৭৮ শকের ১৯শে আশ্বিন বেলা ১১টার সময় গঙ্গায় জোয়ার আইল, আমার মনেও নব উৎসাহের উৎস ছুটিল। আমি গিয়া সেই নৌকাতে আরোহণ করিলাম। নোঙ্গর উঠিল, বোট চলিল, আমি ঈশ্বরের দিকে তাকাইয়া বলিলাম,—
‘আমরা এখন নৌকাতে বসিয়াছি; হে অনুকূল বায়ু, তুমি উঠ। হয়তো আবার আমাদের সেই দর্শনীয় বন্ধুকে দেখিতে পাইব।’
আশ্বিন মাসের গঙ্গার প্রতিকূল স্রোতে নবদ্বীপে পঁহুছিতে ছয় দিন লাগিল। গঙ্গার মধ্যে একটা চড়াতে রাত্রিতে থাকিলাম। চারিদিকে গঙ্গা, মধ্যে এই দ্বীপটি ভাসিতেছে। প্রবল বাতাস ও বৃষ্টির জন্য দুই দিন এখান হইতে আর নড়িতে পারিলাম না। ১৬ই কার্ত্তিকে মুঙ্গেরে পঁহুছিলাম।

ভোর ৪টার সময়ে এখান হইতে সীতাকুণ্ড দেখিতে চলিলাম। নৌকা হইতে তিন ক্রোশ হাঁটিয়া সূর্য্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে সেখানে পঁহুছিলাম। সেই কুণ্ডের জল এত তপ্ত যে, তাহাতে হাত দেওয়া যায় না। তাহার চারিদিকে রেল দেওয়া। জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘ইহাতে রেল দেওয়া কেন?’ সেখানকার লোকেরা বলিল, ‘যাত্রীরা আসিয়া মধ্যে মধ্যে ইহাতে ঝাঁপ দিয়া পড়ে, তাই হাকিমের হুকুমে রেল দেওয়া হইয়াছে।’ আমি তাহা দেখিয়া আবার সেই তিন ক্রোশ হাঁটিয়া, ক্ষুধিত তৃষিত পরিশ্রান্ত হইয়া বোটে ফিরিয়া আইলাম; ‘পারিশ্রান্তেস্রিয়াত্মাহহং ত্ট্পরীতো বুভুক্ষিতঃ’।

তাহার পরে ফতুয়ার বিস্তীর্ণ গঙ্গার মধ্যস্থান দিয়া চলিতেছি; এমন সময়ে প্রবল ঝড় উঠিল। তাড়াতাড়ি বোট ডাঙ্গার দিকে লইয়া গেল। ডাঙ্গায় তো আসিল , কিন্তু প্রতিকূল ঝড় গঙ্গার উচ্চ পাড়ে নৌকাকে আছড়াইতে লাগিল। নৌকা ভাঙ্গে, আর কিছুতেই রক্ষা করা যায় না। আমি সেই দোলায়মান বোট হইতে উঠিয়া পাড়ের উপর দাঁড়াইলাম। সেখানে ভূমিতে যদিও আমার প্রতিষ্ঠা হইল, কিন্তু ঝড়ে আমি অস্থির; চড়ার বালু যেন ছিটা-গুলির মত আমার শরীরে বিদ্ধ হইতে লাগিল। আমি একটা মোটা চাদর গায়ে দিয়া পাড়ে দাঁড়াইয়া গঙ্গার সেই প্রমত্ত ভীষণ মূর্ত্তির মধ্যে সেই ‘মহদ্ভয়ং বজ্রমুদ্যতং’ পরমেশ্বরের মহিমা অনুভব করিতে লাগিলাম। আমাদের সঙ্গের পান্সীখানা সকল আহরীয় সামগ্রী লইয়া গঙ্গার গর্তে ডুবিয়া গেল।

পরে আমরা পাটনায় আসিয়া নূতন আহারের সামগ্রী লইলাম। সেখানে গঙ্গার স্রোত অত্যন্ত প্রবল, নৌকা আর চলিতে পারে না। সেই দুর্জ্জয় স্রোতের প্রতিকূলে পাটনা ছড়াইয়া ৬ই অগ্রহায়ণে কাশীতে পঁহুছিলাম। কলিকাতা হইতে কাশী আসিতে প্রায় দেড় মাস লাগিল।

প্রাতঃকালেই সেই বোট হইতে সমস্ত দ্রব্যাদি লইয়া, কোথায় থাকি, কোথায় বাসা পাই, তাহা দেকিতে দেখিতে সিকরোলের দিকে চলিলাম। খানিক দূর গিয়া দেখি, একটা বাগানের মধ্যে একটা ভাঙ্গা শূন্য বাড়ী পড়িয়া রহিয়াছে; সেখানে একটা কূপের ধারে কতকগুলা সন্ন্যাসী বসিয়া জল্পনা করিতেছে।
(ক্রমশ)