• facebook
  • twitter
Saturday, 6 December, 2025

মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আত্মজীবনী’ থেকে

তাহাতে বনের শোভা আরো দীপ্তি পাইতেছে। যাইতে যাইতে দেখি যে, বনের স্থানে স্থানে বহুকালের বৃহৎ বৃক্ষসকল মূল হইতে উৎপাটিত হইয়া ভূমিষ্ঠ প্রণত রহিয়াছে।

মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। ফাইল চিত্র

পূর্ব প্রকাশিতের পর

নিকটেই গ্রাম, সেই গ্রাম হইতে বাঘের মত কতকগুলো কুকুর ঘেউ ঘেউ করিয়া ছুটিয়া আসিল। সোজা খাড়া পর্ব্বত, নীচে বিষম খদ, উপরে কুকুরের তাড়া। ভয়ে ভয়ে এ সঙ্কট পথটা ছাড়াইলাম। দুই প্রহরের পর একটা শূন্য পান্থ-শালা পাইয়া সে দিনের জন্য সেইখানেই অবস্থিতি করিলাম।

Advertisement

আমার সঙ্গে রন্ধন করিবার কোন লোক নাই। ঝাঁপানীরা বলিল, ‘হম্ লোগ্কা রোটি বড়া মিঠা হ্যায়।’ আমি তাহাদের নিকট হইতে তাহাদের মক্কা-যব মিশ্রিত একখানা রুটি লইয়া তাহারই একটু খাইয়া সে দিন কাটাইলাম। তাহাই আমার যথেষ্ট হইল। ‘রুখা সুখা গ’ম্কা টুকড়া, লোনা অওর্ আলোনা ক্য? সির্ দিয়া তো রোনা ক্যা?’ খানিক পরে কতকগুলা পাহাড়ীয়া নিকটস্থ গ্রাম হইতে আমার নিকটে আসিল, এবং নানাপ্রকার অঙ্গভঙ্গী করিয়া আমোদে নৃত্য করিতে লাগিল। ইহাদের একজনের দিকে চাহিয়া দেখি যে, তাহরে নাক নাই, মুখখানা একেবারে চেপ্টা। জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘তুম্হারে মুখমেঁ ইয়ে ক্যা হুয়া?’ সে পলিল, ‘আমার মুখে একটা ভালুকে থাবা মারিয়াছিল।’ আমার সম্মুখের একটি পথ দেখাইয়া বলিল, ‘ঐ পথে ভালুক আসিয়াছিল, তাহাকে তাড়াইতে গিয়া সে থাবা মারিয়া আমার নাকটা উঠাইয়া লইয়াছে।’ সেই ভাঙ্গা মুখ লইয়া তাহার কতই নৃত্য, কতই তাহার আমোদ! আমি সেই পাহাড়ীদের সরল প্রকৃতি দেখিয়া বড়ই প্রীত হইলাম।

Advertisement

পরদিন প্রাতঃকালে সে স্থান পরিত্যাগ করিয়া অপরাহ্নে একটা পর্ব্বতের চূড়ায় যাইয়া অবস্থান করিলাম। সেখানে গ্রামের অনেকগুলো লোক আসিয়া আমাকে ঘিরিয়া বসিল। তাহারা বলিল, ‘আমাদের এখানে বড় ক্লেশে থাকিতে হয়। বরফের সময়ে এক হাঁটু বরফ ভাঙ্গায়া সর্ব্বদাই চলিতে হয়। ক্ষেতের সময় শূকর ও ভালুক আসিয়া সব ক্ষেত নষ্ট করে। রাত্রিতে মাচার উপর থাকিয়া আমরা ক্ষেত রক্ষা করি।’ সেই পর্ব্বতের খদেই তাহাদের গ্রাম। তাহারা আমাকে বলিল, ‘আপনি আমাদের গ্রামে চলুন, সেখানে আমাদের বাড়ীতে সুখে থাকিতে পারিবেন, এখানে থাকিলে আপনার কষ্ট হইবে।’ আমি কিন্তু সেই সন্ধ্যার সময়ে তাহাদের গ্রামে গেলাম না। সে পাকদণ্ডীর পথ, বড় কষ্টে উঠিতে নামিতে হয়; আমার যাইবার উৎসাহ সত্ত্বেও দুর্গম পথ বলিয়া গেলাম না।

তাহাদের দেশে স্ত্রীলোকের সংখ্যা অতি অল্প। পাণ্ডবদের মত তাহারা সকল ভাই মিলে একজন স্ত্রীকে বিবাহ করে। সেই স্ত্রীর সন্তানেরা সকল ভাইকেই বাপ বলে।

আমি সে দিন সেই চূড়াতেই থাকিয়া প্রভাতে সেখান হইতে চলিয়া গেলাম। এই দিন, দুই প্রহর পর্য্যন্ত চলিয়া ঝাঁপানীরা ঝাঁপান রাখিল। বলিল, ‘পথ ভাঙ্গিয়া গিয়াছে, আর ঝাঁপান চলে না।’ এখন কি করি? পথটা চড়াইয়ের পথ, কোন পাকদণ্ডীও নাই। ভাঙ্গা পথ, ঊর্ধ্বের দিকে কেবল পাথরের উপরে পাথরের ঢিবি পড়িয়া রহিয়াছে। এই পথ-সঙ্কট দেখিয়াও কিন্তু আমি ফিরিতে পারিলাম না। আমি সেই ভাঙ্গা পথে পাথরের উপর দিয়া হাঁটিয়া হাঁটিয়া উঠিতে লাগিলাম। একজন পিছনের দিকে আমার কোমরটার অবলম্বন হইয়া ধরিয়া রহিল। তিন ঘণ্টা এইরূপ করিয়া চলিয়া চলিয়া সেই ভাঙ্গা পথ অতিক্রম করিলাম। শিখরে উঠিয়া একটা ঘর পাইলাম। সে ঘরে একখানা কৌচ ছিল, আমি আসিয়াই তাহাতে শুইয়া পড়িলাম। ঝাঁপানীরা গ্রামে যাইয়া আমার জন্য এক বাটী দুগ্ধ আনিল। কিন্তু অতি পরিশ্রমে আমার ক্ষুধা চলিয়া গিয়াছে, আমি সে দুগ্ধ খাইতে পারিলাম না। সেই যে কৌচে পড়িয়া রহিলাম, সমস্ত রত্রি চলিয়া গেল, একবারও উঠিলাম না।

প্রাতে শরীরে একটু বল আইল, ঝাঁপানীরা এক বাটী দুগ্ধ আনিয়া দিল, আমি তাহা পান করিয়া সে স্থান হইতে প্রস্থান করিলাম। আরো উপরে উঠিয়া সেই দিন নারকাণ্ডাতে উপস্থিত হইলাম। এ অতি উচ্চ শিখর। এখানে শীতের অতিশয় আধিক্য বোধ হইল।

পর দিন প্রাতঃকালে দুগ্ধ পান করিয়া পদব্রজেই চলিলাম। অদূরেই নিবিড় বনে প্রবিষ্ট হইলাম, যেহেতু সে পথ বনের মধ্য দিয়া গিয়াছে। মধ্যে মধ্যে সেই বন ভেদ করিয়া রৌদ্রের কিরণ ভগ্ন হইয়া পথে পড়িয়াছে; তাহাতে বনের শোভা আরো দীপ্তি পাইতেছে। যাইতে যাইতে দেখি যে, বনের স্থানে স্থানে বহুকালের বৃহৎ বৃক্ষসকল মূল হইতে উৎপাটিত হইয়া ভূমিষ্ঠ প্রণত রহিয়াছে। অনেক তরুণবয়স্ক বৃক্ষও দাবানলে দগ্ধ হইয়া অসময়ে দুর্দ্দশাগ্রস্ত হইয়াছে।
অনেক পথ চলিয়া পরে যানারোহণ করিলাম। ঝাঁপানে চড়িয়া ক্রমে আরও নিবিড় বনে প্রবিষ্ট হইলাম। পর্ব্বতের উপরে আরোহণ করিতে করিতে তাহার মধ্যে দৃষ্টিপাত করিয়া কেবল হরিদ্বর্ণ ঘন-পল্লবাবৃত বৃহৎ বৃক্ষসকল দেখিতে পাই। তাহাতে একটি পুষ্প কি একটি ফলও নাই।
(ক্রমশ)

Advertisement