পূর্ব প্রকাশিতের পর
(১৮৫৭, মে)
১লা জ্যৈষ্ঠ দিবসে সিমলাতে সংবাদ আইল যে, সিপাইদের বিদ্রোহে দিল্লী ও মিরাটে একটা ঘোরতর হত্যাকাণ্ড হইয়া গিয়াছে. ২রা জ্যৈষ্ঠতে কমান্ডার-ইন-চীফ্ জেনারেল আন্সন্ দাড়ি কামাইয়া একটা বেতো ঘোড়ায় চড়িয়া সিমলা হইতে নীচে চলিয়া গেলেন। সিমলার অতি নিকটবর্ত্তী স্থানে একদল গুর্খা সৈন্য ছিল, তিনি যাইবার সময় সেই গুর্খা সৈন্যদলের কাপ্তানকে হুকুম দিয়া গেলেন যে, ‘গুর্খা সৈন্যদিগকে নিরস্ত্র করিও।’ গুর্খারা নির্দ্দোষ, তাহাদের সঙ্গে সিপাহিদিগের যোগ নাই, কোন সম্বন্ধ নাই। সাহেবেরা জানেন যে, কালা সিপাই সবই এক। বুদ্ধির দোষে গুর্খাদিগকে নিরস্ত্র করিবার হুকুম হইল। কাপ্তান যেই গুর্খাদিগকে বন্দুক রাখিতে হুকুম দিলেন, অমনি তাহারা আপনাদিগকে অপমানিত ও লাঞ্ছিত মনে করিল। তাহারা ভাবিল যে, প্রথমে তাহাদিগকে নিরস্ত্র করিয়া পরে তাহাদিগকে তোপে উড়াইয়া দিবে। এই ভাবিয়া তাহারা প্রাণের দায়ে সকলে একমত একজোট হইল। তাহারা কাপ্তানের হুকুম মানিল না, বন্দুক রাখিল না; পরন্তু তাহারা ইংরেজ অফিসারদিগকে বাঁধিয়া ফেলিল, এবং ৩রা জ্যৈষ্ঠতে সিমলা আক্রমণ করিতে আসিতে লাগিল।
Advertisement
এই সংবাদে সিমলার বাঙ্গালীরা তাহাদের পরিবার লইয়া উৎকণ্ঠিত ও ভীত হইয়া পলাইতে লাগিল। এখানকার মুসলমানেরা মনে করিল যে, তাহাদের রাজ্য আবার তাহারা ফিরিয়া পাইল। একজন দীর্ঘকায় শ্বেতবর্ণ প্রকাণ্ড দাড়ীওয়ালা ইরাণী কোথা হইতে বাহির হইয়া আমাকে সন্তুষ্ট করিবার জন্য বলিতে লাগিল, ‘মুসলমান্কো হারাম খিলায়া, হিন্দুকো গৌ খিলায়া; অব দেখ্ লেঙ্গে কৈসে ফিরিঙ্গী হ্যায়।’ একজন বাঙ্গালী আসিয়া আমার কাছে বলিল, ‘আপনি নিরুপদ্রবে বেশ বাড়ীতে ছিলেন, এ উপদ্রবে কেন এখানে এলেন? আমরা এ পর্য্যন্ত এমন উপদ্রব দেখি নাই।’ আমি বলিলাম, ‘আমি একলা মানুষ, আমার ভাবনা কি? কিন্তু যাঁহারা পরিবার লইয়া এখানে রহিয়াছেন, আমি তাঁহাদেরই জন্য ভাবিতেছি। তাঁহাদের মহা বিপদ।
Advertisement
তথাকার সাহেবরা সিমলা রক্ষা করিবার জন্য একত্র হইয়া কতকগুলো বন্দুক লইয়া একটা উচ্চ পাহাড়ে চতুর্দ্দিক ঘিরিয়া বিবিদের সঙ্গে বসিয়া রহিল। সিমলা রক্ষা করিবেন কি, সেখানে তাঁহারা মদ্য পানে মত্ত হইয়া আমোদ কোলাহল ও আস্ফালন করিতে লাগিলেন।
তথাকার কমিশনর সুধীর ও কার্য্য-কুশল লর্ড হে সাহেবই সিমলা রক্ষা করিয়াছিলেন। যখন গুর্খা সৈন্যের সিমলাতে আগমন সূচক তোপ পড়িল, তখন তিনি নিজের প্রাণের ভয় ত্যাগ করিয়া, সেই মাহুত-বিহীন প্রমত্ত হস্তীযূথের ন্যায় সৈন্যদলের সম্মুখে মাথার টুপী খুলিয়া সেলাম করিতে করিতে উপস্থিত হইলেন, এবং বিনয়ের সহিত আশ্বাসবাক্যে তাহাদিগকে সান্ত্বনা করিয়া সিমলাতে আসিয়া বিশ্বস্ত চিত্তে ট্রেজারী প্রভৃতি রক্ষণের ভার তাহাদিগকে অর্পণ করিলেন।
ইহাতে সেখানকার সাহেবরা লর্ড হে সাহেবের প্রতি ভারি বিরক্তি প্রকাশ করিতে লাগিল,— ‘লর্ড হে সাহেব কিছুই বিবেচনা করিলেন না; তিনি আমাদের ধন, প্রাণ, মান সকলি বিদ্রোহী শত্রুদিগের হস্তে সমপ:ণ করিলেন; তাহাদিগের নিকট নম্রতা স্বীকার করিয়া ইংরাজ জাতির কলঙ্ক করিলেন। (ক্রমশ)
Advertisement



