যখনই শহরে বা শহরের উপকণ্ঠে কোনও বড় রকমের দুর্ঘটনা ঘটে, মানুষের প্রাণ যায়, তখনই কর্তাব্যক্তিদের মাথায় বুদ্ধি খেলে। এই যেমন বড়বাজারের একটি বড় হোটেলে অগ্নিকাণ্ডের ফলে ধোঁয়ায় দমবন্ধ হয়ে মারা গেলেন একজন শিশু সহ ১৪ জন মানুষ। যখন আগুন লাগে এবং কালো বিষাক্ত ধোঁয়ায় ভরে যায়, তখন প্রাণ বাঁচানোর জন্য মরিয়া চেষ্টা করেছিলেন এঁরা। কিন্তু ধোঁয়ায় দম বন্ধ হয়ে তাঁরা মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন। অনেক ধকল সহ্য করে এবং আগুন নেভানোর জন্য সব বাধা অতিক্রম করে দমকল কর্মীদের কয়েক ঘণ্টা চেষ্টার পর আগুন আয়ত্তে আসে। হোটেলে আগ্নি নির্বাপণের যন্ত্র বিকল, তাই কাজ করেনি। দমকলের আধিকারিকরা/কর্মীরা এসে দেখলেন হোটেলে চরম অব্যবস্থা— হোটেলের জানালা পাকাপাকিভাবে বন্ধ করে দিয়ে একটি ফ্লোরে নাচের জন্য নির্মাণ কাজ চলছিল, লাইসেন্সও নবীকরণ করা হয়নি। বিপদে হোটেল থেকে বের হওয়ার একটি মাত্র সিঁড়ি— তাও কালো ধোঁয়ার অন্ধকারে ঢাকা পড়েছিল।
সুতরাং হোটেলের আবাসিকরা প্রাণপণে প্রাণ বাঁচার মরিয়া চেষ্টা করেও পারেননি। স্থানীয় আবাসিকদের অভিযোগ আগুন লাগার পর বেশ দেরিতে দমকল বাহিনী ঘটনাস্থলে পৌঁছয়। দমকলের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ নতুন নয়— বহুদিন থেকে চলে আসছে। তবুও দমকলের শীর্ষকর্তারা এই অভিযোগ খণ্ডনের কোনও ব্যবস্থা নেননি। বাম আমলে দমকলমন্ত্রী, যিনি কোমরে রিভলবার গুঁজে মহাকরণে আসতেন, এই অভিযোগের সত্যতা যাচাই করার জন্য হঠাৎ একদিন শহরের একটি দমকল কেন্দ্রে উপস্থিত হয়ে দেখলেন, তখন যাঁরা ডিউটিতে থাকবেন, তাঁরা পোশাক না পরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। তখন তিনি বুঝতে পারলেন আগুন লাগার কোনও খবর এলে কেন দমকল দেরিতে পৌঁছয়। মন্ত্রী সেই সময়ের সব দমকলকর্মীদের দার্জিলিংয়ে বদলি করে দিয়েছিলেন কর্তব্যে গাফিলতির জন্য।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় হোটেলে আগুন লাগার রাতে দিঘায় ছিলেন জগন্নাথ ধামের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের জন্য। তিনি এই ভয়াবহ আগুন লাগার খবর জানতে পেরে ওখান থেকেই প্রয়োজনীয় নির্দেশ দেন— গভীর রাত পর্যন্ত। পরে কলকাতায় এসে তিনি ওই হোটেল পরিদর্শনে যান। অনেক অভিযোগ শুনতে পান এবং তা দূর করার প্রয়োজনীয় নির্দেশ দেন পুলিশ এবং কলকাতা পুরসভাকে। বড় বাজারের বড় হোটেলে আগুন লাগার ঘটনা প্রমাণ করল পার্কস্ট্রিট এবং আমরি হাসপাতালের ভয়াবহ আগুন থেকে কোনও শিক্ষা নেওয়া হয়নি। সরকারি ও বেসরকারি বড় বড় প্রতিষ্ঠানে আগুন নির্বাপণের ব্যবস্থাদি আছে কিনাএবং লাইসেন্স নবীকরণ করাহচ্ছে কিনা। কিন্তু অভিযোগ এই কাজটি যথাযথভাবে করা হয় না। ফলে যখন আগুন লাগে কোনও প্রতিষ্ঠানে, দমকল কর্মীরা সেখানে গিয়ে দেখেন চরম অব্যবস্থা। আগুন নির্বাপণের কোনও ব্যবস্থাই কেন নেওয়া হয়নি, তার জবাব মেলে না। আমরি হাসপাতালে ভয়াবহ আগুন লাগায় অনেক রোগীর প্রাণ যায়। তখন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল দমকলের শীর্ষ আধিকারিকদের একটি টিম শহর ও শহরের বাইরে যেসব জায়গায় হাসপাতাল এবং নার্সিংহোম আছে, সেখানে আগুন লাগলে তা প্রাথমিকভাবে নেভানোর ব্যবস্থাদি আছে কিনা। আধিকারিকদের সর্বশেষ রিপোর্টে জানা গেল বেশির ভাগ হাসপাতাল এবং নার্সিংহোমে আগুন নেভানোর পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই। বেশ কয়েকটি নার্সিংহোমের লাইসেন্স বাতিল করা হয়।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকেও সতর্ক করা হয়। কিন্তু বড় বাজারের হোটেলে আগুন লাগার ঘটনা জানিয়ে দিল দমকল বিধি আইন কেউ না মেনেই ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। উত্তর কলকাতার অসংখ্য বাড়ির ভগ্নদশা— এই সব বাড়িতে কোনও আগুন লাগার ঘটনা ঘটলে তা এই ঘিঞ্জি এলাকায় ভয়াবহ রূপ নেবে। শহরের মহানাগরিক ফিরহাদ হাকিম হোটেল পরিদর্শন করে বলেছেন, এখানে যে বেআইনিভাবে নির্মাণ কাজ চলছিল, সে সম্বন্ধে পুরসভা কোনও অভিযোগ পায়নি। পেলে বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হত। আর হোটেলে এই অনিয়মেরই বলি হল ১৪ জন। দমকলকর্মীরা আটকে পড়া আবাসিকদের উদ্ধার করে। নইলে প্রাণহানির সংখ্যা আরও বাড়ত। হোটেলের মালিককে পরে গ্রেপ্তার করা হয়।
পুরসভা কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নিয়েছে কোনও বাড়ি বা আবাসনের ছাদে রেস্তরাঁ তৈরি করা চলবে না। মহানাগরিক বলেছেন, ছাদ খোলা রাখতে হবে। সেখানে কোনও নির্মাণ কাজের পুরসভা অনুমোদন দেবে না। ছাদে রেস্তরাঁ খুলে ব্যবসা হচ্ছে এমন বহুতল বাড়ি বা আবাসন চিহ্নিত করা হয়েছে। এই কাজ বেআইনি। যারা এই ব্যবসা চালাবে তাদের সাবধান করে দিয়ে বলা হয়েছে রেস্তরাঁ ভেঙে ফেলে ব্যবসা চুকিয়ে নিতে। তারা যদি তা না করে, তাহলে পুরসভা সেইসব রেস্তরাঁ ভেঙে দেবে। ইতিমধ্যেই পার্কস্ট্রিটে ছাদের ওপর একটি রেস্তরাঁ ভেঙে দেওয়া হয়েছে। অন্যান্য রেস্তরাঁও ভেঙে দেওয়া হবে যদি তার মালিকরা তা বন্ধ করে না দেয়। ছাদে রেস্তরাঁর খবর এর আগে শোনা যায়নি।
শহরে এক সপ্তাহের মধ্যে চারটি বড় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটল। সেক্টর ফাইভে একটি রাসায়নিক কারখানায় বড় আগুন লাগার ঘটনা ঘটল। প্রচুর পরিমাণে দাহ্য পদার্থ থাকার জন্য আগুন ভয়াহ রূপ নেয়। আড়াই ঘণ্টা চেষ্টার পর আগুন শেষ পর্যন্ত আয়ত্তে আসে। আগুন লাগার ঘটনার জন্য দায়ী সব পক্ষেরই কমবেশি আছে। পুলিশ, দমকল এবং পুরসভা। দমকল কর্তৃপক্ষের বেশি সক্রিয় হওয়ার প্রয়োজন। এই সংস্থার আধিকারিকদের যদি বড় বড় হোটেল এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে গিয়ে খোঁজ নিয়ে দেখা উচিত, সেখানে আগুন নির্বাপনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা আছে কিনা। পুরসভার দেখা উচিত কোথাও নিয়ম ভেঙে নির্মাণ কাজ হচ্ছে কিনা। হলে তা সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ করে দেওয়া। আর পুলিশ দেখবে হোটেলে কোনও অনৈতিক কাজ চলছে কিনা।