চরম দারিদ্র-মুক্ত ভারতের প্রথম রাজ্য হল কেরালা। চরম দারিদ্র-মুক্ত বলতে বোঝায় এমন একটি অবস্থা, যেখানে মানুষ জীবনর ন্যূনতম চাহিদা খাদ্য, বাসস্থান, স্বাস্থ্য পরিষেবা এবং শিক্ষার ব্যয়ভার বহন করতে পারে না। বিশ্বব্যাঙ্কের সংজ্ঞা অনুযায়ী, চরম দারিদ্র হলো এমন অবস্থা, যেখানে একজন ব্যক্তি প্রতিদিন ১৮০ টাকার কম আয়ে বেঁচে থাকে। তবে ভারতের বহুমাত্রিক দারিদ্রসূচক (এমপিআই) শুধুমাত্র আয়ের দিকে নয়, বরং পুষ্টি, বাসস্থান, পয়ঃনিষ্কাশন, শিক্ষা এবং মৌলিক পরিষেবার প্রাপ্যতার মতো সূচকগুলিকেও বিবেচনা করে।
নীতি আয়োগের ২০২৩ সালের এমপিআই অনুযায়ী, কেরালায় মাত্র ০.৫৫ শতাংশ মানুষ বহুমাত্রিকভাবে দরিদ্র, যা দেশের মধ্যে সর্বনিম্ন হার। ২০২১ সালে কেরালার বাম গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট (এলডিএফ) শুরু করেছিল চরম দারিদ্র্য নির্মূল প্রকল্প (ইপিইপি)। প্রথম ধাপেই কুদুম্বশ্রীর নেতৃত্বে এক বিশাল পর্যায়ের সমীক্ষা চালানো হয়। এই কাজে মহিলা স্বনির্ভর গোষ্ঠীর সদস্যরা (যেমন আশা ও অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীরা) এবং স্থানীয় পঞ্চায়েতগুলি অংশ নেয়। এই উদ্যোগে ৬৪,০০৬টি পরিবারকে চিহ্নিত করা হয়, যারা চরম বঞ্চনার মধ্যে বসবাস করছিল, যা রাজ্যের মোট জনসংখ্যার প্রায় ০.২ শতাংশ।
এরপর সবচেয়ে কঠিন ধাপ ছিল প্রতিটি পরিবারের জন্য পৃথক মাইক্রো-পরিকল্পনা তৈরি করা। বঞ্চনার ধরন ছিল বহুমাত্রিক—কারও বাসস্থান নেই, কারও জমি ও বাড়ি দুটোই নেই, কারও জীবিকার উৎস নেই, আবার কেউ দীর্ঘমেয়াদি অসুস্থতায় ভুগছে বা প্রয়োজনীয় কাগজপত্র না থাকার কারণে সরকারি সুবিধা পায়নি। ইপিইপি প্রকল্পের আওতায় প্রতিটি পরিবারের নির্দিষ্ট বঞ্চনা দূরীকরণের জন্য ব্যক্তিগত ও প্রয়োগযোগ্য পরিকল্পনা তৈরি করা হয়। এর যে সুফলগুলি এখন দেখা যাচ্ছে, তা একটি পরিসংখ্যানের মাধ্যমে স্পষ্ট হয়। ৫,৪২২টি নতুন বাড়ি নির্মাণ করা হয়েছে। ৪৩৯টি পরিবারকে ২৮.৩২ একর জমি দেওয়া হয়েছে। ৫,৫২২টি বাড়ি সংস্কার হয়েছে। ৩৪,৬৭২টি পরিবারকে অদক্ষ শ্রমের মাধ্যমে ৭৭ কোটি টাকা অতিরিক্ত আয় করতে সহায়তা দেওয়া হয়েছে। ৪,৩৯৪ টি পরিবারকে স্ব-নিয়োজিত উদ্যোগে যুক্ত করা হয়েছে। ৫৭৯ জনকে স্বাস্থ্যসহায়ক যন্ত্রপাতি বিতরণ করা হয়েছে। ৭ জনকে অঙ্গ প্রতিস্থাপনের আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়েছে। ৫,৭৭৭ জনকে উপশমকারী চিকিৎসা প্রদান করা হয়েছে। ২৯,৪২৭টি পরিবারের ৮৫,৭২১ জনকে স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া হয়েছে। ২,২১০টি পরিবারে রান্না করা খাবার বিতরণ করা হয়েছে। ১৮,৪৩৮টি পরিবারকে খাদ্যসামগ্রী সরবরাহ করা হয়েছে। ২০,৬৪৮টি পরিবারে দৈনন্দিন খাদ্য বিতরণ করা হচ্ছে। ২১,২৬৩টি জরুরি সেবা ও নথি বিতরণ কাজ শেষ করা হয়েছে।
Advertisement
শ্রমজীবী মানুষের কল্যাণে কেরালার এলডিএফ সরকারের প্রগতিশীল পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়েছে সারা ভারত কৃষকসভা। ধানের সংগ্রহমূল্য ও রবারের ভিত্তিমূল্য বৃদ্ধির পদক্ষেপের জন্য, সামাজিক নিরাপত্তা ভাতা প্রতি মাসে ২ হাজার বৃদ্ধি করার সিদ্ধান্তে রাজ্যের ৬২ লক্ষ মানুষ উপকৃত হবেন, যাঁদের মধ্যে বিপুল সংখ্যক শ্রমিক-কৃষক রয়েছেন। তাছাড়া ৩৫ থেকে ৬০ বছর বয়সী দরিদ্র পরিবারের সমস্ত মহিলার জন্য মাসিক ১ হাজার টাকার ‘স্ত্রী সুরক্ষা পেনশন’ চালু করা হয়েছে, যা বহু মানুষের জীবনে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলবে। এর পাশাপাশি আশা ও অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীদের ভাতা ১ হাজার টাকা বৃদ্ধি করা হয়েছে। ফলে ৬৬,২৪০ জন কর্মী উপকৃত হবেন এবং মিড ডে মিল কর্মীদের মাসিক মজুরি ১১০০ টাকা বাড়ানো হয়েছে।
Advertisement
বিজেপি নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রের এনডিএ সরকারের আরোপিত অর্থনৈতিক সঙ্কট ও আর্থিক বিধিনিষেধ সত্ত্বেও এলডিএফ সরকারের রাজ্য প্রণোদনা বোনাস সহ ধান সংগ্রহের উদ্যোগ সত্যিই প্রশংসনীয়। কেরালা দীর্ঘদিন ধরে ধান সংগ্রহে ধারাবাহিকভাবে সাফল্য দেখাচ্ছে। শুধু রাজ্য সরকারের বোনাস নয়, রাজ্যের অধিকাংশ পঞ্চায়েতও কৃষকদের অতিরিক্ত ভরতুকি দিচ্ছে। যার পরিমাণ গড়ে প্রতি হেক্টরে প্রায় ৩০ হাজার টাকা করে। এটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, কারণ এনডিএ শাসিত বহু রাজ্যে ধানচাষিদের প্রতি সরকারের সংবেদনশীলতার অভাব স্পষ্ট। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ২০২২ সালের মধ্যে কৃষকদের আয় দ্বিগুণ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, কিন্তু তা বাস্তবায়নে ব্যর্থ হয়েছেন। তিনি এমএসপি নির্ধারণে কৃষকদের স্বার্থ দেখতে রাজনৈতিকভাবে অনিচ্ছুক। এই প্রেক্ষাপটে কেরলের এলডিএফ সরকার কৃষকদের ধান চাষে উৎসাহিত করে এবং কার্যকরভাবে ধান সংগ্রহ করে কৃষিক্ষেত্রে উদাহরণ তৈরি করেছে।
Advertisement



