শোভনলাল চক্রবর্তী
শেষ কবে এত গরমে কষ্ট পেয়েছে ইটালি, ফ্রান্স, স্পেনের মতো দেশগুলি, তা মনে করতে পারছেন না অনেকেই। তবে গত কয়েক দিনে নাজেহাল অবস্থা ইউরোপের বিভিন্ন দেশের নাগরিকদের। প্রয়োজন ছাড়া বাড়ির বাইরে না-বেরোনোর পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। ফ্রান্সে স্কুল বন্ধ, আইফেল টাওয়ারের মতো পর্যটনস্থলগুলিতেও না-যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছে প্রশাসন। অন্য দিকে, ইটালিতেও গরমের জেরে হাঁসফাঁস অবস্থা। মিলান, রোম-সহ দেশের ১৭টি জায়গায় চূড়ান্ত সতর্কতা জারি করা হয়েছে। শুধু তাপপ্রবাহ নয়, তুরস্ক লড়াই করছে দাবানলের সঙ্গে। ইউরোপের এই তাপপ্রবাহকে ‘ব্যতিক্রমী’ বলছেন আবহাওয়াবিদেরা। ইউরোপে সবে গরম পড়তে শুরু করেছে। আর গ্রীষ্মের শুরুতেই চড়চড়িয়ে বাড়ছে তাপমাত্রার পারদ। কোথাও কোথাও গরমের আগের সব রেকর্ড ভাঙছে। কোথাও ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস, আবার কোথাও ৪৬ ডিগ্রি, কোথাও কোথাও আবার তাপমাত্রা ৫০ ডিগ্রি ছুঁইছুঁই। ইউরোপে দ্রুত উষ্ণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা অতীতে লক্ষ করা যায়নি বলেই মানছেন আবহবিদেরা। পিছিয়ে নেই জার্মানি, ইটালিও। ইটালির নেপল্স, পালেরমোর তাপমাত্রা প্রায় ৪০ ডিগ্রি ছুঁইছুঁই। রোম ও মিলান-সহ ইটালির ১৮টি শহরে লাল সতর্কতা জারি হয়েছে। তীব্র দাবদাহের লাল সতর্কতা জারি হয়েছে অস্ট্রিয়া, বসনিয়া ও হার্জেগোভিনা, সার্বিয়া, স্লোভেনিয়া প্রভৃতি দেশেও।
Advertisement
এ পর্যন্ত ইউরোপে গরমের কারণে আট জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে স্পেনে চার জন, ফ্রান্সে দু’জন এবং ইটালিতে দু’জন মারা গিয়েছেন। শুধু তা-ই নয়, গরমের কারণে গারোন নদীর জলের উষ্ণতা বেড়ে যাওয়ায় দক্ষিণ ফ্রান্সের গল্ফেক পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রের দু’টি চুল্লির মধ্যে একটি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। সুইৎজ়ারল্যান্ডের বেজ়নাও পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রেও দু’টি চুল্লি বন্ধ রাখা হয়েছে। আরে নদীর জলের তাপমাত্রা অত্যধিক বেড়ে যাওয়ায় এই সিদ্ধান্ত। বন্ধ হয়ে যাওয়া তিন পরমাণুকেন্দ্রেই চুল্লির তাপমাত্রা কমানোর জন্য নদীর জল ব্যবহার করা হয়— চুল্লিতে ব্যবহারের পর গরম হয়ে যাওয়া সেই জল ফের ফিরিয়ে দেওয়া হয় প্রকৃতিতে। কিন্তু নদীর জলের স্বাভাবিক উষ্ণতা ২৫ ডিগ্রির বেশি হয়ে গেলেই তা আর ব্যবহারযোগ্য থাকে না। কারণ চুল্লিতে ব্যবহারের পর ওই জলের উষ্ণতা অত্যধিক বেড়ে যায়, যা জলজ বাস্তুতন্ত্রের জন্য ক্ষতিকর। তবে আপাতত তাপপ্রবাহের কারণে মাথায় হাত পড়েছে আবহবিদদের।
Advertisement
মনে করা হচ্ছে, বিশ্ব উষ্ণায়নের কারণেই এই পরিস্থিতি ইউরোপে। আগামী কয়েক বছরে পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটতে পারে বলে আশঙ্কা। ইউরোপীয় ইউনিয়নের কোপারনিকাস ক্লাইমেট চেঞ্জ সার্ভিস ও বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার মুখপাত্র ক্লেয়ার নালিসের মতে, বিশ্বব্যাপী তাপমাত্রা বৃদ্ধির গড়ের দ্বিগুণ গতিতে গরম বাড়ছে ইউরোপে। এইরকমভাবে তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে মহাদেশটির লক্ষ লক্ষ মানুষ ঝুঁকির মুখে পড়ছেন। মহাদেশের বিভিন্ন দেশে মৃতের সংখ্যাও বাড়ছে। সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতি ফ্রান্স, স্পেন, পর্তুগাল, ইটালি, গ্রিস এবং সুইৎজ়ারল্যান্ডে। উত্তর গোলার্ধের দেশগুলিতে এই সময় তাপপ্রবাহের ঘটনা অস্বাভাবিক নয়। তবে তাপমাত্রার এই ঊর্ধ্বগতি আগে দেখা যায়নি। ফ্রান্সের কিছু কিছু অংশে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪০-৪১ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছে গেছে। এরপর পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে বলে আশঙ্কা। ফ্রান্সে প্রায় ১৯০০ স্কুল বন্ধ রাখা হয়েছে। প্রতিদিনই সেই সংখ্যা বাড়ছে। ১৬টি জায়গায় লাল সতর্কতা জারি করেছে স্থানীয় আবহাওয়া দফতর। পর্যটকদের জন্য আইফেল টাওয়ার বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন কর্তৃপক্ষ।
জানানো হয়েছে, ‘‘আইফেল টাওয়ার বন্ধ থাকার কারণে পর্যটকদের যে অসুবিধা হচ্ছে তার জন্য আমরা ক্ষমাপ্রার্থী। তবে পরিস্থিতির কথা বিবেচনা করে এই সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে।’’ ইতালির মিলান, রোম-সহ দেশের ১৭টি জায়গায় লাল সতর্কতা জারি করা হয়েছে। দিনের উষ্ণতম সময়ে ঘরের বাইরে বার না-হওয়ার পরামর্শ দিচ্ছে প্রশাসন। কিছু কিছু জায়গায় বাইরে কাজ বন্ধ করার নির্দেশও দেওয়া হয়েছে। পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি না-হওয়া পর্যন্ত সতর্কতা এবং নিষেধাজ্ঞা বলবৎ থাকবে। ইটালির বোলোনা শহরে এক শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। অতিরিক্ত গরমই মৃত্যুর কারণ বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকেরা। গরমের সঙ্গে দোসর বিদ্যুৎবিভ্রাটও। বেশ কয়েকটি জায়গায় এই সমস্যা দেখা দিয়েছে। দক্ষিণ-পশ্চিম স্পেনের লা গ্রানাদো শহরে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা উঠেছে ৪৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। গত ছয় দশকে কখনও এত গরম পড়েনি সে দেশে। এই পরিস্থিতিতে সে দেশের সরকারি আবহাওয়া বিজ্ঞান সংস্থা (এইএমইটি) জানিয়েছে, চলতি সপ্তাহে পরিস্থিতির বিশেষ হেরফের হওয়ার সম্ভাবনা নেই। অতীতে জুন মাসে এত গরম কোনও সময়ে পড়েনি এ দেশে। এইএমইটি জানিয়েছে, স্পেনের ইতিহাসে ‘উষ্ণতম জুন’। ভূমধ্যসাগর উপকূলীয় এলাকাগুলিতে আরও তাপমাত্রা বৃদ্ধির বিষয়ে সতর্ক করেছেন স্পেনের আবহবিজ্ঞানীরা। রোদে রাস্তায় না বেরোনোর পরামর্শ দিয়েছে সে দেশের সরকারও।
পর্তুগালের লিসবন থেকে প্রায় ৮০ মাইল পূর্বে অবস্থিত মোরা শহরে সর্বোচ্চ তাপমাত্রার পারদ ৪৬.৬ ডিগ্রি ছুঁয়েছে। এমনই জানাচ্ছে পর্তুগালের আবহাওয়া বিভাগ (আইপিএমএ)। রাজধানী লিসবনেও সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪২ ডিগ্রি হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন আবহাওয়াবিদেরা। দিনকয়েকের মধ্যে আবহাওয়া পরিবর্তনের তেমন কোনও সম্ভাবনা নেই বলেই জানাচ্ছে আইপিএমএ। এ ছাড়াও, গ্রিস এবং তুরস্কের মতো দেশগুলি গরমের পাশাপাশি লড়াই করছে দাবানলের সঙ্গে। গ্রিসের একাংশেও তাপমাত্রা পৌঁছেছে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ঘরে। দক্ষিণ আথেন্সে যে দাবানল লেগেছিল, তা আরও ছড়িয়ে পড়েছে।
সতর্কতামূলক পদক্ষেপ হিসাবে ইতিমধ্যেই বহু মানুষকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে আনা হয়েছে। তুরস্কের অবস্থাও একই। ব্রিটেনে দেশের বিভিন্ন জায়গার তাপমাত্রা স্বাভাবিকের থেকে অনেকটাই বেশি। তবে ইউরোপের অন্য দেশগুলির তুলনায় ব্রিটেনের পরিস্থিতি কিছুটা ভাল। তবে সেখানেও সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে গিয়েছে। সে দেশে এখন উইম্বলডন টেনিস টুর্নামেন্ট চলছে। চলছে ভারত-ইংল্যান্ড টেস্ট সিরিজ। বিশ্বের নানা প্রান্তের টেনিস ও ক্রিকেট তারকারা তো বটেই, অন্যান্য খ্যাতনামা ব্যক্তিরও ভিড় ব্রিটেনে। তবে অতিরিক্ত তাপমাত্রার কারণে সমস্যায় পড়ছেন অনেকেই। এই বেলাগাম তাপপ্রবাহ অপ্রত্যাশিত নয়। রাষ্ট্রপুঞ্জের ইন্টারগভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ ইতিমধ্যেই জানিয়েছে, এমন চরম উষ্ণ আবহাওয়া আগামী দিনে আরও বেশি করে এবং আরও তীব্রভাবে অনুভব করবে বিশ্ববাসী। কারণ, বিশেষজ্ঞদের অনুমান অভ্রান্ত প্রমাণ করে পৃথিবী উষ্ণতর হয়ে উঠছে। ইউরোপের ক্ষেত্রে এই পরিবর্তনের আঘাতটি সর্বাধিক।
পরিসংখ্যান বলছে, মহাদেশগুলির মধ্যে ইউরোপই সবচেয়ে দ্রুত উষ্ণ হয়ে উঠছে। বিশ্বে যেখানে প্রতি দশকে গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার ০.২ ডিগ্র সেলসিয়াস, সেখানে ইউরোপে এই হার ০.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। গত বছর বিশ্বের বার্ষিক গড় তাপমাত্রা শিল্পবিপ্লব-পূর্ব যুগের তুলনায় ১.৫ ডিগ্রি বৃদ্ধি পেয়েছিল। কিন্তু ইউরোপের ক্ষেত্রে গত পাঁচ বছরে তাপমাত্রা শিল্পবিপ্লব-পূর্ব যুগের তুলনায় গড়ে প্রায় ২.৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস অধিক থেকে গিয়েছে। নতুন গবেষণা বলছে, ইউরোপের গ্রীষ্ম ঋতুটি আর চিরচেনা সময়সীমাতে আবদ্ধ থাকবে না। তা আরও দীর্ঘতর হয়ে উঠবে। কিছু শহরে তা বছরে পাঁচ মাস অবধিও টিকে যাবে। অধিক তাপমাত্রা শুধুমাত্র শারীরিক এবং পরিবেশগত ক্ষতি ডেকে আনে না, অর্থনীতিতেও মোক্ষম ধাক্কা দেয়। সে ক্ষতির মোকাবিলা বিষয়ে এখনই ভাবা প্রয়োজন। কিন্তু সমস্যা সেখানেই। জলবায়ুর মতো বৈশ্বিক বিষয়ে জরুরি পদক্ষেপগুলি শুধুমাত্র নিজের দেশের গণ্ডিতে আবদ্ধ রাখলেই চলবে না, ভাবতে হবে ‘অন্য’দের বিষয়েও। কিন্তু ধনী দেশগুলি সে পথে হাঁটতে নারাজ।
সম্প্রতি ব্রিকস সম্মেলনে যৌথ বিবৃতিতে উপস্থিত নেতৃবৃন্দ জোর গলায় বলেছেন, জলবায়ু খাতে অর্থ বরাদ্দ করা ধনী দেশগুলির উন্নয়নশীল দেশের প্রতি কর্তব্য। অথচ, সে কর্তব্য যথাযথ পালিত হচ্ছে না। আগামী নভেম্বর ব্রাজ়িলে হতে চলা আন্তর্জাতিক জলবায়ু সম্মেলন সিওপি ৩০-এর চিফ এগজ়িকিউটিভ আনা টোনি মূল্যবান একটি মন্তব্য করেছেন— “জলবায়ুই আমাদের সবচেয়ে বড় যুদ্ধ।” আরও বলেছেন, সামরিক আর বাণিজ্য যুদ্ধগুলি অত্যন্ত ক্ষতিকর— সেগুলি জলবায়ু থেকে মনোযোগ ঘুরিয়ে দেয় অন্য দিকে। উন্নত বিশ্ব আদৌ সে বিষয়ে সচেতন কি?
Advertisement



