উজ্জ্বলা যোজনা প্রকল্প। গরিব মানুষকে বিনা পয়সায় রান্নার গ্যাস দেবে কেন্দ্র। এখন এই প্রকল্পটি নিয়ে ল্যাজে গোবরে অবস্থান মোদী সরকারের। এতদিন ১০০ দিনের কাজ ও আবাস যোজনার অর্থ নিয়ে তৃণমূল সরকারের বিরুদ্ধে বলছিল কেন্দ্রীয় সরকার। এই দুই প্রকল্পের গাইডলাইন মেনে যাবতীয় ত্রুটি সংশোধন করলেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারকে প্রকল্পের প্রাপ্য টাকা দিতে নারাজ কেন্দ্র। বাধ্য হয়ে মানবিকতার স্বার্থে রাজ্যের কোষাগার থেকেই প্রকল্প দু’টি চালু রেখেছে নবান্ন। বঞ্চনার এই তালিকায় এখন উঠে এল আরও একটি নাম। নরেন্দ্র মোদীর সাধের প্রকল্প উজ্জ্বলা যোজনা।
এই প্রকল্পটি শুরুর পর থেকে গত বছরের গোড়ার দিক পর্যন্ত সরকারের দাবি ছিল, গোটা দেশে ১০ কোটি পরিবারকে বিনা পয়সায় গ্যাসের সংযোগ দেওয়ার কাজ শেষ হয়েছে। এই সাফল্যকে এগিয়ে নিয়ে যেতে ২০২৪ সালের লোকসভা ভোটের আগে আরও ৭৫ লক্ষ পরিবারকে নতুন গ্যাস সংযোগ দেওয়ার কথা ঘোষণা করেন মোদী। এই নতুন ঘোষণার ঢাক বাজাতে এ রাজ্যে লোকসভা নির্বাচনের প্রচারে এসে মোদী অভিযোগ করেছিলেন, উজ্জ্বলা যোজনা বাংলায় কার্যকর করতে দিচ্ছে না মমতা সরকার। সরকারের বাধায় বাংলার ১৪ লক্ষ আবেদনকারী গ্যাসের সংযোগ পাচ্ছেন না। কিন্তু কেন্দ্রের দেওয়া তথ্যেই পরিষ্কার, নিজেদের সীমাহীন ব্যর্থতা ঢাকতে অথবা রাজনৈতিক অঙ্ক কষে সুকৌশলে বাংলার মানুষকে বঞ্চিত করা হয়েছে।
দ্বিতীয় ধাপে নতুন ৭৫ লক্ষ গ্যাস সংযোগ দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিটি জেলায় একটি করে কমিটি (উজ্জ্বলা কমিটি) গঠনের শর্ত চাপিয়ে দেয় কেন্দ্র। পছন্দের লোকদের নিয়ে তৈরি সেই কমিটিতে রাজ্য সরকারের একজন মাত্র আধিকারিক রাখার কথা বলা হয়েছে। শুধুমাত্র স্বাক্ষর করার জন্য এই কমিটিতে যোগ দিতে অস্বীকার করে রাজ্য। এরপর কেন্দ্র সিদ্ধান্ত নেয়, রাজ্যের প্রতিনিধি ছাড়াই কমিটি তৈরি হবে। কিন্তু অবাক করা বিষয় হলো, নিজেদের দেওয়া সেই নির্দেশ নিজেরাই কার্যকর করেনি কেন্দ্র। এমন কোনও কমিটি তৈরিই হয়নি এ রাজ্যে। ফলে ১৪ লক্ষ আবেদনকারী গ্যাসের সংযোগ পাননি। এটা অবশ্য ‘সরকারি’ কারণ। কিন্তু আসল কারণ হলো, মোদীর অভিযোগের সুর ধরে কেন্দ্রীয় আমলারা প্রকল্পটি নিয়ে এগোনোর সাহস দেখাননি। রাজ্যের ঘাড়েই দোষ চাপিয়ে প্রধানমন্ত্রীর লক্ষ্যপূরণে সাহায্য করেছেন। কারণ, পরবর্তীকালে কেন্দ্র দাবি করেছে, ২০২৪-এর জুলাই মাসের মধ্যে ৭৫ লক্ষ গ্যাস সংযোগ পেয়ে গিয়েছেন নতুন গ্রাহকরা। এমন ছলচাতুরি করেও বিগত লোকসভা ভোটে বাংলায় বিজেপি-র আসন কমেছে। ১৮-র জায়গায় ১২-তে থামতে হয়েছে গেরুয়া শিবিরকে।
বিনা পয়সায় রান্নার গ্যাস দেওয়া দূরের কথা, শুধুমাত্র সংযোগ দিয়ে কিস্তিতে ওভেন বা চুল্লি কেনার সুযোগ সামনে নিয়ে আসা হল। এরপর ধীরে ধীরে বাড়তে থাকল রান্নার গ্যাসের দাম। সরকারি হিসাব বলছে, দেশে ১০ কোটি ৩৩ লক্ষ পরিবার প্রবল উৎসাহে গ্যাসের সংযোগ নিয়েছে। কিন্তু দিল্লির রিপোর্টে আবার বলা হয়েছে, ২০২৩-২৪ অর্থবর্ষে ১ কোটি ৪০ লক্ষ ৪৮ হাজার পরিবার একটিও সিলিন্ডার কেনেনি। ওই সময়ে বছরে একটি মাত্র সিলিন্ডার কিনেছে এমন, পরিবারের সংখ্যা ১ কোটি ৬৬ লক্ষ ৫২ হাজার। তার অর্থ হলো, ৩০ শতাংশের বেশি পরিবারই উজ্জ্বলা প্রকল্পের সুবিধা নিতেই পারেনি। এই অবস্থায় ২০২৪ এর অক্টোবরে সিলিন্ডার পিছু ৩০০ টাকা ভর্তুকি দেওয়ার কথা ঘোষণা করা হয়। কিন্তু তাতেও একটি সিলিন্ডার কিনতে ৫০০ টাকা খরচ করতে হয়। বহু গরিব পরিবারের এই টাকা খরচের মতো সামর্থ্য না থাকায় প্রধানমন্ত্রীর সাধের উজ্জ্বলা প্রকল্প অনুজ্জ্বলই থেকে গিয়েছে। বলা হয়েছিল, উজ্জ্বলার সুবাদে গ্রামের মহিলারা কাঠ-পাতা জ্বালানির ক্ষতিকর ধোঁয়া-কালি থেকে রক্ষা পাবেন। গ্রামের মহিলাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার প্রশ্নে যে প্রকল্পটির যাত্রা শুরু হয়েছিল তার সম্পূর্ণ সুফল যে মিলছে না তা জলের মতো পরিষ্কার। উজ্জ্বলা প্রকল্পের ঔজ্জ্বল্য ক্রমশই কমছে।