• facebook
  • twitter
Thursday, 21 August, 2025

ভারতীয় বিজ্ঞান জাদুঘরের ভীষ্ম পিতামহ ড. সরোজ ঘোষ

১৯৭৯ সালে ড. ঘোষ আন্তর্জাতিক শিশুবর্ষে, মুম্বাইয়ে ওরলিতে একটি পৌর আবর্জনা ফেলার জায়গাকে বিশ্বের প্রথম বিজ্ঞান পার্কে রূপান্তরিত করেছিলেন।

প্রতিনিধিত্বমূলক চিত্র

বিমলকুমার শীট

অন্যান্য বিষয় যাই হোক না কেন বিজ্ঞান বিষয়টি সাধারণ মানুষের মধ্যে জনপ্রিয় হওয়া দরকার। সভ্যতার উন্নতিতে বিজ্ঞানের অবদান ভোলার নয়। তাই বিজ্ঞানকে জনপ্রিয় করার আবশ্যিকতা প্রয়োজন। দরকার বিজ্ঞান মিউজিয়াম প্রতিষ্ঠা। মিউজিয়াম হল এক ঐতিহাসিক প্রতিষ্ঠান। পঞ্চদশ শতাব্দীতে ইউরোপে মিউজিয়াম শব্দটি ব্যবহৃত হত ইটালির ফ্লেরেন্সের লরেঞ্জো দি মেদিচির সংগ্রহশালাকে বোঝাতে। তবে এ সময় মিউজিয়াম বলতে কোনো প্রতিষ্ঠানের কল্পনা করা হয়নি। সপ্তদশ শতকীয় ইউরোপে ‘মিউজিয়াম’ শব্দটি ব্যবহৃত হত জ্ঞানের সংরক্ষণ অর্থে। মূলত ১৭৫৯ সালে লন্ডনের ‘দি ব্রিটিশ মিউজিয়াম’ প্রতিষ্ঠার পরবর্তীতে মিউজিয়াম শব্দটি একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নেয় এবং জনসাধারণের উদ্দেশ্যে সংরক্ষণ ও প্রদর্শনের ধারণা চালু হয়। ড. সরোজ ঘোষ ছিলেন বিজ্ঞানকে জনসাধারণের মধ্যে জনপ্রিয় করার অন্যতম ব্যক্তিত্ব ও স্ংগ্রাহলয় সংস্থাপক। সেই সঙ্গে তিনি ছিলেন একজন আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত জাদুঘরবিদ। তিনি ১৯৭৮ সালে ন্যাশনাল কাউন্সিল অব সায়েন্স মিউজিয়াম প্রতিষ্ঠার পেছনে বৃহত্তর অবদান রেখেছেন। দেশে বিজ্ঞান মিউজিয়াম প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ড. ঘোষ বর্তমান প্রজন্মকে নতুন দিশা দেখালেন।

১৯৩৫ সালে ১ সেপ্টেম্বর কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন সরোজ ঘোষ। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইলেকট্রিক্যাল এণ্ড কমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতক এবং আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কন্ট্রোল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে এমএস ডিগ্রি অর্জন করেন এবং স্মিথসোনিয়ান ইনস্টিটিউশনে গবেষণা করেন। ১৯৭৪ সালে দেশে ফিরে এসে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৬৫ সালে তিনি কলকাতায় বিড়লা ইণ্ড্রাস্ট্রিয়াল অ্যাণ্ড টেকনোলজিক্যাল মিউজিয়ামের অধিকর্তার দায়িত্ব নেন। ১৯৭৮ সালে ড. সরোজ ঘোষ ন্যাশনাল কাউন্সিল অব সায়েন্স মিউজিয়াম প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। মূলত তাঁরই উদ্যোগে কলকাতায় ৫০ একর জায়গা জুড়ে তৈরি হয় সায়েন্স সিটি, যা ছিল ভারতীয় উপমহাদেশে সর্ববৃহৎ। এই কেন্দ্রটি ভারতে সবচেয়ে বেশি পরিদর্শন করা বিজ্ঞান কেন্দ্র (বার্ষিক গড় ১.৫ মিলিয়ন দর্শনার্থীর উপস্থিতি)। বিজ্ঞাননগরী নামকরণে তার অভিমত ছিল “একটি শহরের যা যা থাকে ব্যাঙ্ক, পোস্ট অফিস, রেলগাড়ি, রেস্তঁরা, অডিটোরিয়াম ইত্যাদি সবই থাকবে। কেবল থাকবে না মানুষের বসবাস। থাকবে বিজ্ঞানের নানা শাখার বিভিন্ন গ্যালারি সমন্বিত বিজ্ঞানের এক বিশাল জগৎ। সব কিছু মিলে দর্শকের মনে হবে সে যেন বিজ্ঞান শহরে ঘুরে বেড়াচ্ছে”।

১৯৬৫ সালে ড. সরোজ ঘোষ BITM- এর দায়িত্ব গ্রহণ করেন একই বছর নরেন্দ্রপুরের রামকৃষ্ণ আশ্রম স্কুলে ‘ভ্রাম্যমান বিজ্ঞান জাদুঘর’ চালু করেন। প্রদর্শনীটি ‘আমাদের পরিচিত বিদ্যুৎ’ থিমের ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছিল, যার ৩০টি প্রদর্শনী বহনযোগ্য স্ট্যাণ্ডে স্থাপন করা হয়ে ছিল এবং অপরটি বাসে বহন করা হয়ে ছিল। এই ভ্রমণ প্রদর্শনীর পিছনের দর্শন ছিল, যদি শিশুরা বিজ্ঞান জাদুঘরে আসতে না পারে, তাহলে বিজ্ঞান জাদুঘর তাদের কাছে যাবে’। NCSM এখন সারা দেশে ৪৮টি ভ্রাম্যমান বিজ্ঞান প্রদর্শনী বাস পরিচালনা করে। লিমকা বুক অফ রেকর্ডস এই প্রোগ্রামটিকে ভারতের বৃহত্তম এবং দীর্ঘতম চলমান অ-অনুষ্ঠানিক বিজ্ঞান শিক্ষা প্রোগ্রাম হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছে।

১৯৭৯ সালে ড. ঘোষ আন্তর্জাতিক শিশুবর্ষে, মুম্বাইয়ে ওরলিতে একটি পৌর আবর্জনা ফেলার জায়গাকে বিশ্বের প্রথম বিজ্ঞান পার্কে রূপান্তরিত করেছিলেন। যেখানে শিশুরা পার্কের সবুজ পরিবেশে স্থাপিত প্রদর্শনীর সাথে খেলা করার সময় বিজ্ঞানের মূল বিষয়গুলির অন্বেষণ করতে পারত। এই মডেলটি বিশ্বব্যাপী বিপুল সংখ্যক বিজ্ঞান কেন্দ্র দ্বারা অনুসরণ করা হয়েছিল। ১৯৮৫ সালে এটি নেহরু বিজ্ঞান কেন্দ্রে পরিণত হয়।

জাতীয় বিজ্ঞান জাদুঘর গঠিত হলে ড. ঘোষ এর পরিচালক (১৯৭৯) এবং পরে এর মহাপরিচালক হিসাবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। বিজ্ঞানকে জনপ্রিয় করে তোলা, দেশে বৈজ্ঞানিক সচেতনতা তৈরি করা এবং বিজ্ঞান কেন্দ্রের কার্যক্রমের মাধ্যমে শিশুদের মধ্যে সৃজনশিলতা ও বৈজ্ঞানিক মেজাজ লালন করার উৎসাহে অনুপ্রাণিত হয়ে, ড. সরোজ ঘোষ ভারতে বিজ্ঞান কেন্দ্র আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। তার নেতৃত্বে কলকাতার ‘সায়ন্সে সিটি’ ছাড়াও ১৮টি বিজ্ঞান কেন্দ্র, এর মধ্যে ২টি জাতীয় স্তরে, ৭টি আঞ্চলিক স্তর এবং ৮টি উপ-আঞ্চলিক / জেলাস্তরে সারা ভারতে প্রতিষ্ঠিত হয়ে ছিল। দেশের বিজ্ঞান বার্তা ছড়িয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে এই বিজ্ঞান কেন্দ্রগুলি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। ড. ঘোষ “ভারতঃ বিজ্ঞানের ঐতিহ্য” শীর্ষক আন্তর্জাতিক মেগা ভ্রমণ প্রদর্শনীর ধারণার মূল পরিকল্পনাকারী ছিলেন। প্রদর্শনটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, রাশিয়া, বুলগেরিয়া, চীন, বাংলাদেশ, ত্রিনিদাদ ও তোবাগো, গায়ানা ইত্যাদি দেশে বেশ জনপ্রিয় ছিল। বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণ কার্যক্রমে অবদানের জন্য এই প্রদর্শনী NCSM কে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি প্রদান করে।

ড. সরোজ ঘোষ তার কাজের জন্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিকস্তরে নানা পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। ১৯৮৮ সালে ‘ইন্দিরা গান্ধী পুরস্কার’, বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন থেকে “হরি ওম ট্রাস্ট পুরস্কার” লাভ করেন। শিশুদের মধ্যে বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের জন্য ভারত সরকার তাঁকে ‘পদ্মশ্রী’ (১৯৮৯) এবং কবিগুরুর জীবন ও সাহিত্য কর্মের উপর নির্মিত সর্বাধুনিক সংগ্রাহালয়ের জন্য ‘পদ্মভূষণ’ (২০০৭) পুরস্কার প্রদান করে। তিনি আন্তর্জাতিক স্তরে ‘প্রিমো রোভিস ইন্টারন্যাশনাল প্রাইজ’ (১৯৯৬) এবং ‘এ এস টি ফেলো’ (১৯৯৭) লাভ করেন। ড. সরোজ ঘোষ ‘প্যারিস ভিত্তিক আন্তর্জাতিক জাদুঘর পরিষদ’ এর বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন এবং দুবার এর সভাপতি নির্বাচিত হন। তিনি বিশ্ব বিজ্ঞান কংগ্রেসের সভাপতির পদও অলংকৃত করে ছিলেন। অবসর গ্রহণের পরও ড. ঘোষ তাঁর দক্ষতা অব্যাহত রেখেছিলেন। তাঁর পরামর্শ ও তত্ত্বাবধানে গড়ে উঠে ছিল – কলকাতা টাউনহল জাদুঘর, নয়াদিল্লী সংসদ জাদুঘর এবং নয়াদিল্লীর রাষ্ট্রপতি ভবন জাদুঘর। এছাড়া তাঁর পরামর্শে আহমেদাবাদের গুজরাট সায়েন্স সিটির মতো জাদুঘরও গড়ে উঠেছে।

ড. ঘোষ ১৭ মে ২০২৫ সালে ৮৯ বছর বয়সে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সিয়াটলে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর ইচ্ছা অনুযায়ী তাঁর মরদেহ বৈজ্ঞানিক গবেষণার জন্য ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়কে দান করা হয়েছে। তিনি ভারত জুড়ে বিজ্ঞান জাদুঘরের একটি বিকেন্দ্রীভূত মডেলের উন্নয়নের কল্পনা করে ছিলেন এবং বাস্তবায়ন করেছিলেন, যা বিজ্ঞানকে লক্ষ্ লক্ষ মানুষের কাছে সহজলভ্য এবং অনুপ্রেরণামূলক করে তুলেছিল।