• facebook
  • twitter
Wednesday, 9 July, 2025

মাটির মানুষের কাছাকাছি বাইশ বছর

নিঃসন্দেহে‌ দৈনিক স্টেটসম্যান প্রথম বড় ব্রেক পেয়েছিল সিঙ্গুর নন্দীগ্রাম আন্দোলনের সময়। তখন বামফ্রন্টের একচেটিয়া রমরমা রাজত্ব।

সুমিত চৌধুরী

দেখতে দেখতে দৈনিক স্টেটসম্যান পত্রিকার বাইশ বছর হয়ে গেল। আমরা সাংবাদিক মহলে যে কাগজকে বলতাম বাংলা স্টেটসম্যান তা এখন নিজস্ব পরিচিতি অর্জন করে নিয়েছে “দৈনিক স্টেটসম্যান” হিসেবে। ইংরেজি স্টেটসম্যানের সুবিশাল ঐতিহ্যের ছায়া এড়িয়ে দৈনিক স্টেটসম্যান হিসেবে বাংলা সংস্করণের এই নিজস্ব পরিচিত অর্জন চাট্টিখানি কথা নয় বলেই আমার ধারণা। যারা সংবাদপত্রের শিল্পের সঙ্গে ন্যূনতম যোগাযোগ রেখে চলেন তাঁরা বুঝবেন আমার এই কথাটার সারমর্ম কি। যে কারণে আনন্দবাজার পত্রিকা হাউস যখন তাদের ইংরাজি কাগজ বার করবার সিদ্ধান্ত নেয় আশির দশকের গোড়ার দিকে, প্রথম থেকেই দ্য টেলিগ্রাফ রীতিমত কর্পোরেট পদ্ধতিতে নিজস্ব আলাদা অভিজ্ঞান তৈরি করে নিতে সচেষ্ট ছিল। দৈনিক স্টেটসম্যানের লড়াইটা ছিল আলাদা। সাহেবসুবোদের কাগজ হিসেবে পরিচিত স্টেটসম্যানের ইংরেজি সংস্করণের লম্বা ছায়া থেকে বেরিয়ে নিজের আলাদা একটা আইডেন্টিটি তৈরি করা। যেটা বিস্ময়ের ব্যাপার দৈনিক স্টেটসম্যান খুব দ্রুত সেটাই সফল হয়েছিল।

আমরা যখন প্রেসিডেন্সি কলেজে ছাত্র জীবনের দিন কাটাচ্ছি, সহপাঠীদের এক আধজন, কলেজের পাঠ শেষ না করেই সংবাদপত্রে চাকুরীতে ঢুকে যাচ্ছে, তখন থেকেই আমরা শুনতাম দ্য স্টেটসম্যান নাকি বাংলা কাগজ বার করবে। সম্ভবত তখন স্টেটসম্যান পত্রিকার মুখ্য সম্পাদক সুনন্দ দত্ত রায়।

তারপরে কলেজ জীবন পেরিয়ে নিজেও যখন সংবাদপত্রের পেশায় ঢুকে পড়লাম তখনও প্রায় দু দশক ধরে এই কথাটা বারেবারে শুনতাম। একটা সময় মনে মনে ধরে নিয়েছিলাম ওটা নিতান্তই গুঞ্জন। আসলে স্টেটসম্যান পত্রিকা কোনদিনই বাংলা কাগজ বার করবে না।

কিন্তু হওয়ার যা নয় সেটাও হলো। আচমকাই একদিন দেখলাম শহর এবং মফস্বল শহর হোর্ডিং-এ হোর্ডিং-এ ছেয়ে গেছে। স্টেটসম্যান হাউজ থেকে বাংলা কাগজ বেরোচ্ছে। দৈনিক স্টেটসম্যান।

নিঃসন্দেহে‌ দৈনিক স্টেটসম্যান প্রথম বড় ব্রেক পেয়েছিল সিঙ্গুর নন্দীগ্রাম আন্দোলনের সময়। তখন বামফ্রন্টের একচেটিয়া রমরমা রাজত্ব। বুদ্ধবাবুর সেই অমোঘ উক্তি আমরা ২৩৫ ওরা ৩৫। একের পর এক লগ্নির ঘোষণা হচ্ছে। কমিউনিস্ট মুখ্যমন্ত্রী ব্রিগেডে দাঁড়িয়ে বলছেন তাঁর জীবনের সবথেকে গর্বের দিন টাটাদের কাছ থেকে কয়েক হাজার কোটি টাকার লগ্নি পাওয়া। আজ সিঙ্গুর। কাল নন্দীগ্রাম। তারপর জিন্দালরা শালবনীতে। হই হই ব্যাপার।

কিন্তু ইতিহাসের চাকা আচমকায় ঘুরতে শুরু করেছিল। শিল্পের নামে জমি কেড়ে নেয়ার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে শুরু করেছিলেন গ্রাম বাংলার কৃষকরা। বিরোধিতায় কৃষকদের সেদিন পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে শুরু করে বিভিন্ন নকশালপন্থী দল এবং এস ইউ সি আই। বাংলার সংবাদ মাধ্যম তখন প্রায় বামফ্রন্টের দিকে ঝুঁকে। সর্বাধিক প্রচারিত বাংলা কাগজটি বামফ্রন্টের শিল্পনীতির সমর্থক। অন্য একাধিক বাংলা কাগজ শাসকের প্রসাদ থেকে বঞ্চিত হওয়ার ভয়ে বুদ্ধবাবুদের দিকে ঝুঁকে। সিপিআইএম দলের মধ্যেও শিল্পায়নের এই নীতি নিয়ে যারা সন্দিহান তাঁরাও দলের মধ্যে মুখ ফুটে বলবার সাহস পাচ্ছেন না। সেই সময় বর্তমান পত্রিকা ছাড়া বাংলা কাগজের মধ্যে যে কাগজটি জমি হারাতে বসা কৃষকদের পাশে রুখে দাঁড়িয়ে ছিল, নাগরিক সমাজের আন্দোলনের কথা বলেছিল সেটি হল দৈনিক স্টেটসম্যান। বাংলা স্টেটসম্যান কাগজের সেই ভূমিকার কথা ক্রান্তিকালের দিনলিপিতে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।

যাঁরা নাগরিক সমাজের আন্দোলনের সমর্থনে কলম ধরেছিলেন, নাগরিক সমাজের আন্দোলনের কথা তুলে এনেছিলেন, তাদের মধ্যে মহাশ্বেতা দেবী থেকে সুজাত ভদ্র নব দত্তরা নিয়মিত লিখেছিলেন দৈনিক স্টেটসম্যানে। প্রথম পাতার ডানদিকের সিঙ্গল কলমে লম্বা করে এই সমস্ত লেখা ছাপা হতো।

আর আমার অনুজপ্রতিম সাংবাদিক সুকুমারের মতো কেউ কেউ মাটিতে পড়ে থেকে দৈনিক স্টেটসম্যানের পাতায় তুলে এনেছিলেন জেলায় জেলায় মানুষের লড়াইয়ের কথা। নন্দীগ্রামে এমন সময়ও গেছে যে, দৈনিক স্টেটসম্যানের পর্যাপ্ত কপি পৌঁছায়নি। মসজিদের মাইকে দৈনিক স্টেটসম্যানের নন্দীগ্রামের লড়াইয়ের বিবরণ পড়ে শোনানো হয়েছে। আমরা সেই সময় বলাবলি করতাম বসুমতী পত্রিকা ষাটের দশকে বামপন্থীদের লড়াইয়ের খবর যেভাবে ছাপতো দৈনিক স্টেটসম্যানকে আজকে সেই ভূমিকায় দেখা যাচ্ছে।
আজকের নতুন প্রজন্ম নিশ্চয়ই বামেদের তখনকার সর্বাত্মক দাপট বুঝতে পারবেন না। বড় টেলিভিশন চ্যানেল এবং প্রিন্টমিডিয়া সবাই প্রায় রাজ্যের শাসকের দিকে ঝুঁকে। যারা কৃষকদের গ্রামবাসীদের আন্দোলন সমর্থন করছেন তাঁদের বিরুদ্ধে প্রবল কুৎসা। সেই অবস্থাতে নির্ভীকভাবে মানুষের লড়াইয়ের কথা বলা একটি নতুন চালু হওয়া দৈনিকের পক্ষে কতটা কঠিন সেটা যারা সংবাদপত্রের ইনসাইডার তারা বুঝতে পারবেন।

দৈনিক স্টেটসম্যান সেই ক্ষমতা দেখিয়েছিল। অনেক সময়ই তখন বিভিন্ন টেকনিক্যাল কারণে কাগজে নিউজ প্রিন্টের মান সেরকম ভালো হচ্ছে না। বিজ্ঞাপনদাতারা ভয়ে চুপ। বিজ্ঞাপন দেওয়ারও সাহস দেখাচ্ছেন না অনেকে। তবু দৈনিক স্টেটসম্যান বুক চিতিয়ে লড়াই করেছিল।

অনেক প্রতিকূলতার মধ্যে সেই দৈনিক স্টেটসম্যান দেখতে দেখতে বাইশটা বছর পার করে দিল। যদিও আমার মনে হয় সবকিছুই তো চোখের সামনে ‘এই তো সেদিন।’ জাহাজ যখন তীর থেকে ছাড়ে, তীরের কাছেই ঢেউয়ের দাপট বেশি থাকে।

অভিজ্ঞ নাবিকেরা জানেন তার পরে তরী পার করা অনেকটা সহজ কারণ সমুদ্র কম উত্তাল থাকে। আমার আশা দৈনিক স্টেটসম্যান সেই উথাল পাতাল ঢেউয়ের মধ্যে দিয়ে যোগ্য নেতৃত্বে গোড়ার দিককার টাল মাতাল দিনগুলি পার করে দিতে পেরেছেন। আগামী দিনগুলোর জন্য অনেক শুভেচ্ছা।