• facebook
  • twitter
Sunday, 11 May, 2025

কংগ্রেস, হিন্দুত্ববাদী ও আম্বেদকর: বিতর্ক আজও চলছে

১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি আমরা এক স্ববিরোধী জীবনে প্রবেশ করতে চলেছি। রাজনীতির ক্ষেত্রে আমাদের সাম্য থাকবে এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনে থাকবে অসাম্য।

ফাইল চিত্র

শোভনলাল চক্রবর্তী

আম্বেদকরকে যদি একটিমাত্র বিশেষণে তুলে ধরতে হয়, হয়তো অগ্রাধিকার পাবে ‘বিতর্কিত’ শব্দটি। গত শীতের সংসদে আম্বেদকর-কাণ্ড অনেক দিন পর অক্ষরে অক্ষরে তা মিলিয়ে দিয়েছিল। রাজনীতির ঘাত-প্রতিঘাত আম্বেদকরকে কেন্দ্র করে এখন জটিল রূপ নিচ্ছে, হয়তো আরও নেবে। সেই রাজনীতির জটিল রাস্তা বিচার করার আগে স্পষ্ট একটা ইতিহাসের তথ্য চাই— জহরলাল নেহরুর সঙ্গে আম্বেদকরের রাস্তা চূড়ান্তভাবে আলাদা হয়ে গেল কখন এবং কেন। হিন্দু কোড বিল ছিল সেই ঐতিহাসিক মুহূর্ত। প্রধানমন্ত্রী নেহরু এবং আম্বেদকর দুই জনেই ছিলেন হিন্দু কোড বিল আনার পক্ষে। সেই সংস্কারের মাধ্যমে হিন্দু সমাজের অন্তঃস্থিত নানারকম বৈষম্য এবং অনাচারের নিরসন হতে পারে বলে তাঁরা ভাবছিলেন। যেমন, সম্পত্তিতে নারীর উত্তরাধিকারের সূত্রপাত, বহুবিবাহ রোধ, বিধবার পুনর্বিবাহে স্বীকৃতি, এক জাতের মধ্যে বিবাহের বাধ্যতা লোপ, এই সব কয়টি বিষয়ই সেই বিলে ছিল। আম্বেদকরের ভাষায়, হিন্দু সমাজের মূল সূত্রটা আছে শ্রেণির সঙ্গে শ্রেণির, জাতির সঙ্গে জাতির বিরোধ চালু রাখার মধ্যে, আর সেখানে যদি সংস্কার না আনা যায় তা হলে কোনও সাংবিধানিক অধিকারেরই কোনও অর্থ থাকে না। বুঝতে অসুবিধা হয় না, কী প্রবল বিরোধিতার সামনে পড়েছিল এই বিল, রাজেন্দ্র প্রসাদ, শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়রা খড়্গহস্ত হয়ে উঠেছিলেন এই বিলের বিরুদ্ধে। শেষ অবধি তুমুল চাপের সামনে প্রধানমন্ত্রী পিছু হটতে বাধ্য হন। তার প্রত্যক্ষ ফলাফল, আম্বেদকরের পদত্যাগ। নেহরু কেন পিছিয়ে এলেন? ১৯৫১ সালে প্রথম জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতি তখন শুরু হচ্ছে, হয়তো তাই সময় নিয়েছিলেন তিনি। অর্থাৎ? নেহরু ও তাঁর কংগ্রেসের সঙ্গে আম্বেদকরের সেই সময়ের বিচ্ছেদটি ঘটিয়েছিলেন সনাতন-পন্থী হিন্দুত্ববাদী নেতারাই। নেহরু তাঁদের চাপে পশ্চাদপসরণ করেছিলেন। আম্বেদকর তা মানতে পারেননি।

এই ইতিহাস পিছনে লুকিয়ে বিজেপি নেতারা আজকের কংগ্রেসকে আম্বেদকর-বিরোধী বলে গাল দিলে তাতে কেবল অর্ধসত্য বলা হয় না, অন্যায়ের ভারা পূর্ণ হয় একশো শতাংশ। আম্বেদকরের আজীবন সংগ্রাম হিন্দু সমাজের সামাজিক বৈষম্য ও অনধিকারের বিরুদ্ধে। এই সংগ্রামে তিনি সে দিন ছিলেন প্রায় একাকী। ক্রমবর্ধমান বিদ্বেষ ও বিরোধে পরিপূর্ণ এই উত্তরোত্তর হিন্দুত্ব-অভিমুখী ভারতে আজও তিনি ততটাই একাকী। কোনও রাজনীতিই তাঁকে আত্মসাৎ করতে না পারুক, এটাই কাম্য। তেমন রাজনীতি এখনও এই ভারত নির্মাণ করতে পারেনি। বাস্তবিক, বাবাসাহেব আম্বেদকর এমনই একজন রাজনৈতিক বা দার্শনিক ব্যক্তিত্ব, যাঁকে নিয়ে বিতর্ক হাতাহাতি-মারপিটের পর্যায়ে চলে যাওয়ার মধ্যে অস্বাভাবিক তো কিছু নেই বটেই, এক দিক দিয়ে দেখলে ভারতের বিবিধ ভয়ঙ্কর বৈষম্য ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে ক্রমাগত আঘাত করতে থাকা এই মানুষটির ক্ষেত্রে সেটাই যেন সবচেয়ে ‘স্বাভাবিক’। যে ভারতে কেবলই আম্বেদকরের গুণগান হয়, এবং তাঁর অভিমুখে ভক্তিরসের বন্যা বইতে থাকে, সেই ভারতই বরং সন্দেহের উদ্রেক ঘটায়, ভক্তিডালার পিছনে কিছু কালো আছে, প্রতারণা আছে, এমনই মনে হয়। বিশেষত যে ভারতীয় জনতা পার্টি সর্বার্থেই জনসঙ্ঘ, হিন্দু মহাসভার উত্তরসূরি, রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের পার্শ্বগামী— তার শাসনে যখন আম্বেদকর-ভক্তির প্রবাহ বইতে থাকে, তখন সেই সন্দেহ ঘোর আতঙ্কে পরিণত হয়, প্রতারণা মিথ্যাচার হয়ে যায়। আবার, কংগ্রেসের দিক থেকেও আম্বেদকর-ভক্তি কিছুটা আতিশয্য-মাফিক, এবং রাজনীতির প্রয়োজনে আলঙ্কারিক, তাও বুঝতে অসুবিধা নেই। আম্বেদকরের নাম বার বার জপে কংগ্রেস ও বিরোধী নেতারা প্রতারণা করছেন— স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ কথাটি যে ভাবে বলেছিলেন তা অত্যন্ত কুরুচিসম্পন্ন। তবে এতে কিছু সত্যাণু রয়েছে। নেহরুরনেতৃত্বে কংগ্রেসের সঙ্গে আম্বেদকরের একাধিক সংঘাতবিন্দু ছিল, আজ যে কথা আর তোলা হয় না। কিন্তু সে প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে একটি আরও বড় সত্য স্পষ্ট ও প্রাঞ্জল হওয়া দরকার। তা হল, কংগ্রেসের থেকে তাঁর অনেক বেশি, অনেক মৌলিক, অনেক ব্যাপক সংঘাত ছিল হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলির সঙ্গে। ফলে বিজেপি এখন তাঁকে যে ভাবে ‘ব্যবহার’ করে, তার মধ্যে ইতিহাসের আরও বড় অন্যায় আছেই, দ্বিচারিতা ও মিথ্যাভাষণ আছে ভূরি ভূরি। অমিত শাহ এবং তাঁর দল প্রথমে নিজেদের দিকে আঙুল তুলুন, তার পর অন্য কারও কথা ভাববেন, বলবেন।

“১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি আমরা এক স্ববিরোধী জীবনে প্রবেশ করতে চলেছি। রাজনীতির ক্ষেত্রে আমাদের সাম্য থাকবে এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনে থাকবে অসাম্য।” বলেছিলেন আম্বেদকর ২৫ নভেম্বর, ১৯৪৯-এ গণপরিষদে ভাষণ দিতে গিয়ে। সংবিধানের খসড়া গৃহীত হওয়ার জন্য পেশ করে, গণপরিষদের অতি গুরুত্বপূর্ণ খসড়া রচনা কমিটির সভাপতি ভীমরাও আম্বেদকরের সেই সংবিধানেরই কার্যকারিতা সম্পর্কে এই অতীব তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণটি যাত্রা শুরুর দিন থেকেই বিশ্বের সর্ববৃহৎ গণতান্ত্রিক দলিলটির ‘সীমা’ বিষয়ে আমাদের সচেতন করে। এমন ‘স্ববিরোধ’ অবশ্য বিশ্বের সব সংবিধানেই কমবেশি আছে। ব্রিটেনের সুপ্রাচীন ‘অলিখিত’ সংবিধানের উৎসমুখ, বিদ্রোহী ভূস্বামী ব্যারনদের ও চার্চের সঙ্গে রাজার বিবাদ নিষ্পত্তির জন্য, কিছু অধিকারের স্বীকৃতি দিয়ে, ইংল্যান্ডের রাজা জন-এর জারি করা ১২১৫ সালের সনদ ‘ম্যাগনা কার্টা’; কিংবা ১৭৮৭ সালে ফিলাডেলফিয়া সম্মেলনে প্রস্তুত হওয়া ও ১৭৮৯-এ প্রণীত আমেরিকার সংবিধান; অথবা, ফরাসি বিপ্লবের (১৭৮৯) সময় গৃহীত ‘মানুষ ও নাগরিকদের জন্য অধিকারসমূহ’; বা, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর রাজতন্ত্রের অবসান হলে জার্মানির হ্বাইমার প্রজাতন্ত্রের সংবিধান, সবেতেই খুঁজলে ছোট-বড় নানা অসঙ্গতি-সীমাবদ্ধতা চোখে পড়বে। ভারতের সংবিধান প্রণয়ন ও চালু হওয়ার মুহূর্তে অবশ্য দু’টি লক্ষণীয় বিপরীত প্রতিক্রিয়া ছিল। এক দিকে, দেশভাগের যন্ত্রণা বহন করেও সংবিধান-রচনার জটিল গুরুভার পালন করে শেষ অবধি ২৬ নভেম্বর তা গৃহীত হওয়ায় উচ্ছ্বাস ছিল। অনেকেই ভেবেছিলেন, দেশের এই মৌলিক আইনগুচ্ছ এবং তার প্রস্তাবনায় বলা, ‘ন্যায়, স্বাধীনতা, সাম্য ও সৌভ্রাতৃত্ব’-এর আদর্শ মেনে নতুন রাষ্ট্র সুবিচার ও সার্বিক সমৃদ্ধির প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করবে।

অন্যদিকে, ছিল তীব্র অবিশ্বাসের ভ্রুকুটি। ১৯৪৮ সালে নিষিদ্ধ হওয়া, বি টি রণদিভের নেতৃত্বাধীন ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি আওয়াজ তুলেছিল ‘ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায়’! তবে কি সংবিধানের অন্যতম প্রণেতা উপরে উদ্ধৃত বক্তৃতায় এমন কিছুরই ইঙ্গিত দিয়েছিলেন? পুরো বক্তব্য খুঁটিয়ে পড়লে অবশ্য স্পষ্ট হয়, অসঙ্গতির কথা বললেও আম্বেদকর কিন্তু ‘রক্তাক্ত বিপ্লবের’ পথকেও সমর্থন করেননি, বরং এই পন্থাকে ‘নৈরাজ্যের ব্যাকরণ’ আখ্যা দিয়ে বলেছেন যখন সামাজিক ও আর্থিক লক্ষ্যপূরণের জন্য সাংবিধানিক উপায় রয়েছে, তখন তাকে ধরেই এগোতে হবে, এবং রাজনৈতিক গণতন্ত্রকে সামাজিক গণতন্ত্রে রূপান্তরিত করতে হবে। এইভাবে, সংবিধানের কার্যকারিতা সম্পর্কে প্রশ্ন তুলেও শেষ পর্যন্ত আম্বেদকর তাকে কাজে লাগিয়েই আর্থসামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠার লড়াই চালিয়ে যাওয়ার পক্ষে সওয়াল করেন।

ফলে, কেবল নেহরু-প্যাটেল প্রমুখ কংগ্রেসের বড় নেতারা নন, বা ধনিক শ্রেণির মানুষই নন, যুগসঞ্চিত শোষণ-বঞ্চনার শিকার মানুষদেরও একটা বড় অংশ সাংবিধানিক অধিকারকে হাতিয়ার করেই সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালিয়েছেন। আম্বেদকর-বর্ণিত বৈপরীত্য ছাড়াও একাধিক বিতর্ক বেধেছে সংবিধানকে ঘিরে। যে হেতু স্বাধীনতার পরও ভারত ব্রিটিশ কমনওয়েলথ-এর সদস্য, তাই ভারতকে কি প্রকৃত অর্থে ‘স্বাধীন’ বলা যায়, না কি কানাডা বা অস্ট্রেলিয়ার মতোই সে স্বায়ত্তশাসনভুক্ত (ডোমিনিয়ন) দেশ? বা, সংবিধানের প্রথম থেকেই ভারতকে যেভাবে রাজ্যদের ‘সঙ্ঘ’ (ইউনিয়ন) বলা হয়েছে (১ নং ধারা); নতুন রাজ্যগঠন, রাজ্যের সীমানা/নাম পরিবর্তনে যে ভাবে কেন্দ্রীয় আইনসভার পাল্লা ভারী (২-৪ নং ধারা); সপ্তম তফসিল-এ প্রদত্ত কেন্দ্র, রাজ্য ও যুগ্ম তালিকায় বর্ণিত সরকারের নানা বিভাগের কাজ ও দায়িত্বের ভাগাভাগিতেও যে ভাবে কেন্দ্রমুখিতা প্রকট— তাতে কি ভারতকে আদৌ ‘যুক্তরাষ্ট্র’ বলা যায়? কিংবা, প্রথম ধারায় বলা ‘ইন্ডিয়া দ্যাট ইজ় ভারত’ কি আসলে শহুরে ক্ষমতাবান ‘ইন্ডিয়া’ আর গ্রামীণ (প্রান্তিক) ‘ভারত’-এর বৈপরীত্যময় সহাবস্থানের দ্যোতক?