শোভনলাল চক্রবর্তী
কোনও হাসপাতাল থেকে সদ্যোজাত চুরি হলে সবার আগে ওই হাসপাতালের ‘লাইসেন্স’ (ছাড়পত্র) বাতিল করা উচিত। শিশুপাচার সংক্রান্ত এক মামলার শুনানিতে এমনটাই জানিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। শিশুপাচার সংক্রান্ত সব মামলায় ছ’মাসের মধ্যে বিচার শেষ করতে হবে বলেও নির্দেশ দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। শীর্ষ আদালতের নির্দেশ, প্রতিটি নিম্ন আদালতের কাছে এই মর্মে নির্দেশিকা পাঠিয়ে দিতে হবে হাই কোর্টগুলিকে। উত্তরপ্রদেশের এক শিশুপাচার মামলায় অভিযুক্তদের অন্তর্বর্তী জামিন সংক্রান্ত মামলার শুনানি চলছিল সুপ্রিম কোর্টে। এক সদ্যোজাতকে চুরি করে অন্য এক পুত্রহীন দম্পতির কাছে তাকে ৪ লক্ষ টাকায় বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ ওঠে। মামলার শুনানির সময়ে উত্তরপ্রদেশ সরকারকে তুলোধনা করে শীর্ষ আদালত। একই সঙ্গে এলাহাবাদ হাই কোর্টের ভূমিকার সমালোচনাও করে সুপ্রিম কোর্ট। আইনি খবর পরিবেশনকারী ওয়েবসাইট ‘বার অ্যান্ড বেঞ্চ’ অনুসারে, শীর্ষ আদালত জানিয়েছে, ‘হাই কোর্ট জামিনের আবেদনগুলিকে অবহেলার সঙ্গে বিবেচনা করেছে এবং এর ফলে অনেক অভিযুক্ত পলাতক। এই অভিযুক্তেরা সমাজের জন্য ভীষণ ভাবে ক্ষতিকর। জামিন দেওয়ার সময় হাই কোর্টের অন্তত উচিত ছিল, অভিযুক্তদের প্রতি সপ্তাহে থানায় হাজিরার শর্ত দেওয়া।’ একই সঙ্গে মামলায় উত্তরপ্রদেশ সরকার কেন জামিনের বিরুদ্ধে আবেদন করেনি, তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে সুপ্রিম কোর্ট।
Advertisement
সুপ্রিম কোর্টের মন্তব্য, ‘এই মামলার ক্ষেত্রে অভিযুক্ত পুত্রসন্তানের আশায় ছিলেন। তার পরে তিনি ৪ লক্ষ টাকার বিনিময়ে এক পুত্রসন্তান পেয়ে যান। পুত্রের আশায় কারও পাচার হওয়া সন্তানকে আপনি নিতে পারেন না। অভিযুক্ত জানতেন যে ওই শিশুকে চুরি করা হয়েছে।’ সেই কারণে অভিযুক্তদের জামিনের পক্ষে হাই কোর্টের নির্দেশ খারিজ করে দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। প্রত্যেক অভিযুক্তকে থানায় আত্মসমর্পণ করার নির্দেশ দিয়েছেন বিচারপতি। প্রত্যককে জেলে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছে আদালত। শীর্ষ আদালতের দুই বিচারপতির বেঞ্চ জানিয়েছে, এই নির্দেশ বাস্তবায়নে কোনও ঢিলেমি হলে তা গুরুত্ব দিয়ে দেখা হবে এবং আদালত অবমাননা হিসাবে তা বিবেচনা করা হবে। রাজ্য সরকারগুলিকে এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের সুপারিশগুলি দেখে দ্রুত বাস্তবায়নের জন্য বলেছে শীর্ষ আদালত। শিশুপাচার সংক্রান্ত মামলা দেশের কোন আদালতে কতগুলি বিচারাধীন রয়েছে এবং মামলাগুলি বর্তমানে কোন পর্যায়ে রয়েছে, তা নিয়েও তথ্য সংগ্রহের জন্য প্রতিটি হাই কোর্টকে নির্দেশ দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। ইউনিসেফ’-এর সমীক্ষা অনুযায়ী, বিশ্বে প্রতি বছর ১২ লক্ষ শিশু পাচার হয়। তার বৃহত্তম উৎস ভারত। এর মূলে আছে দারিদ্র, সামাজিক বৈষম্য, লোভ, অশিক্ষা ও কুসংস্কার। ফলে বাল্যবিবাহ, দেহব্যবসা, যৌন শোষণ ও শিশুশ্রম ক্রমবর্ধমান। প্রবন্ধকার উল্লেখ করেছেন, ২০২২ সালে ভারতের মাটি থেকে হারিয়ে গেছে প্রায় ৮৩ হাজার শিশু। ধারণা, পাচার হয়ে গিয়েছে তারা। পণের দাবি পূরণে অক্ষম হওয়ায় প্রতি দিন গড়ে ভারতে খুন হন ২০ জন মেয়ে। এমনকি আত্মনির্ভরশীল নারীকেও ধর্ষিত হতে হয় তার নিজের বাড়িতেই। দাসত্বের এ এক অন্তহীন ট্র্যাজেডি। এই ব্যবস্থা থেকে মুক্তি পেতে হলে সবার আগে প্রয়োজন সুশিক্ষা, সহমর্মিতা, শ্রদ্ধা ও ভালবাসার বোধ। সর্বজনীন শিক্ষাই পারে এই বধ্যভূমি থেকে মুক্তি দিতে। কিন্তু কে দেবে শিক্ষা, কে পাবে মুক্তি।
Advertisement
দুর্ভাগ্যের বিষয় এই যে নিখোঁজ শিশুদের তালিকায় পশ্চিমবঙ্গ এগিয়ে। এই দুর্ভাগ্যময় সংবাদ মিললেও পরিসংখ্যান অমিল— ঠিক কত শিশু প্রতিনিয়ত পাচার হয়ে চলেছে। কিছু সময় অন্তরই শিশু চুরি সংক্রান্ত খবর শিরোনামে আসে। গত মাসেই হুগলির একটি হাসপাতাল ও বর্ধমানের মেডিক্যাল কলেজ থেকে নবজাতক চুরির চেষ্টা হয়। শিশু দু’টিকে উদ্ধার করা হয়, দোষীরা ধরা পড়ে। এ বার খাস কলকাতার বি সি রায় হাসপাতাল থেকে চুরি গেল চিকিৎসা করতে আসা ছ’মাসের শিশুপুত্র। চুরিগুলিতে একটি ছকের আভাস মেলে। অপরাধী শিশুর পরিবারের সঙ্গে আলাপ-পরিচয়ের মাধ্যমে ভরসা জয়ের চেষ্টা করে শিশুকে নিয়ে পালানোর সুযোগ খোঁজে। অর্থাৎ, তাদের সামনে রেখে বড় কোনও পাচার চক্রের সক্রিয়তা সম্ভব। কিছু পাচারচক্র ধরাও পড়ে। অনেক ক্ষেত্রেই তাদের জাল ছড়িয়ে আছে আন্তঃরাজ্য স্তরে। হাসপাতালে আসা ভিড়ের মধ্যে শিশুদের লক্ষ্যনির্ণয় এদের খুবই চেনা কৌশল এবং বার বার সেই কৌশল কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে। তা সত্ত্বেও হাসপাতালের নিরাপত্তার এ-হেন শিথিলতা বহু প্রশ্নের জন্ম দেয়।
সৌভাগ্য, এ বারও শিশুপুত্রটিকে কয়েক ঘণ্টা পরেই উদ্ধার করা গিয়েছে। চুরিতে পাচার চক্র জড়িত কি না, সেই তদন্তও চলছে, যেমন আশ্বাস প্রতি ক্ষেত্রেই মেলে। যত শিশু খোয়া যায়, তার বহুলাংশকেই ফেরানো যায়— এই দাবিতে পরিস্থিতির ভার লাঘবের চেষ্টাও পরিচিত। কিন্তু, অন্তঃতদন্ত আঙুল তুলেছে, পাচারচক্রগুলি বিভিন্ন স্তরের স্বাস্থ্যকর্মীদের সঙ্গে যোগসাজশ রাখে। বহু দম্পতিই সুস্থ সন্তান জন্মের পর হঠাৎ তার মৃত্যুর খবরে স্তম্ভিত হন। আশঙ্কা প্রবল, খবর প্রশাসন পর্যন্ত পৌঁছনো দূর, হয়তো অভিভাবকও জানতে পারেন না যে সন্তান চুরি গিয়েছে। শিশুর নিরাপত্তার স্বার্থেই দত্তক প্রক্রিয়াটিকে দীর্ঘ ও বহুস্তরীয় রাখার ফলে বহু নিঃসন্তান দম্পতিই ধৈর্য ধরতে পারেন না বা নির্বাচিত হন না। সন্তানের সঙ্গে সম্পত্তি ও বংশরক্ষার বিশ্বাস জুড়ে দেওয়ার সামাজিক প্রবণতাটি তাঁদের বিচলিত করে। ফলে, অর্থের বিনিময়ে সহজে সন্তানলাভে মরিয়া হওয়া অসম্ভব নয়। পিতৃতান্ত্রিক দেশে পাচার তালিকায় পুত্রসন্তানের গুরুত্ব এই তত্ত্বের সাক্ষ্য। গর্ভ ভাড়ায় কঠিন নিয়ম পরোক্ষ ভাবে শিশুর চাহিদা আরও বাড়াতে পারে। স্বল্প বেতনের শ্রমে নিয়োগ, শৈশব থেকে অপরাধী-প্রশিক্ষণের দুরভিসন্ধি ছেলে-শিশু চুরির অন্যতম কারণ। হারানো মেয়েদের অধিকাংশেরই স্থান হয় যৌনপল্লিতে। তুমুল আর্থিক বৈষম্যসম্পন্ন এই দেশে ন্যায়বিরুদ্ধ উপার্জনের রাস্তা নির্মাণ করছে শিশুপাচার।এর প্রতিরোধ কিন্তু সেই তিমিরেই। দেশে রোজগারের সংস্থান বাড়ানো, নিঃসন্তান দম্পতিকে দত্তক প্রথা প্রসঙ্গে ওয়াকিবহাল রাখা এবং পদ্ধতিটিকে স্বচ্ছ অথচ যথাসম্ভব সরল রাখা সেই প্রতিরোধের জরুরি ধাপ। হাসপাতাল, স্টেশন ও নানা গুরুত্বপূর্ণ গণপরিসরে নজরদারি, নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থার মাধ্যমে শিশু ও তার পরিবারের সুরক্ষা প্রশাসনিক দায়। কর্মীদের কঠোর জবাবদিহির আওতায় আনা, নিয়োগের সময় ভাল ভাবে খোঁজখবর করলে স্বাস্থ্য দফতরের তরফেও বিপদ কিছুটা ঠেকানো যায়। দুষ্কৃতীরা কী উপায়ে শিশুহরণ করছে, তা নিয়ে ব্যাপক প্রচার প্রয়োজন। সভ্য রাষ্ট্রে শিশু পণ্য হয়ে উঠলে তা মানবাধিকারের উল্লঙ্ঘন, আন্তর্জাতিক আঙিনায় জাতীয় অপমান। খবরে প্রকাশ, শিশু বিক্রির মতো জঘন্য অপরাধ ঘটে চলেছে রাজ্যের আইভিএফ সেন্টারগুলির একাংশে। কলকাতার নোনাডাঙা রেল কলোনি এলাকার এক সদ্যোজাতকে বিক্রির অভিযোগের তদন্ত করতে নেমে পুলিশ জেনেছে, বেশ কিছু সুপরিচিত নার্সিংহোম, আইভিএফ সেন্টার এবং ডায়াগনস্টিক সেন্টারের কর্মীরা শিশু বিক্রির সঙ্গে জড়িত। ইতিপূর্বেই এমন ইঙ্গিত মিলেছিল যে, আইভিএফ চিকিৎসার কেন্দ্রগুলিকে ব্যবহার করে শিশুপাচার চক্র নানা রাজ্যে সক্রিয় হয়েছে। এ বছরই মার্চ মাসে শিলিগুড়িতে পুলিশ ফাঁদ পেতে ধরেছিল চার দুষ্কৃতীকে, যারা সাত লক্ষ টাকার বিনিময়ে সাত দিনের শিশুকন্যাকে বিক্রির চেষ্টা করছিল। ওই শিশুকে আনা হয়েছিল বিহারের একটি আইভিএফ সেন্টার থেকে।
গত দু’-তিন বছরে বিভিন্ন জেলা-শহরে শিশু বিক্রির ঘটনা সামনে এসেছে, যেখানে নার্সিংহোমের আয়া এবং অন্যান্য কর্মী জড়িত। এই দালাল বা মধ্যস্থতাকারীদের ধরাই যথেষ্ট নয়, তাদের পিছনে কোনও বড় সংগঠক রয়েছে কি না, তা-ও জানা জরুরি। প্রশাসনিক নজরদারি এড়িয়ে কী করে এমন চক্র গড়ে উঠতে পারল? ভুলে যাওয়া চলে না, ২০২৩ সালে জলপাইগুড়ি ও দার্জিলিঙের হোম থেকে শিশুপাচারের তদন্তে নেমে সিআইডি দু’টি জেলার শিশুসুরক্ষা আধিকারিক এবং দার্জিলিঙের শিশুকল্যাণ কমিটির সদস্য এক ডাক্তারকেও রেখেছিল চার্জশিটে। অন্তত সতেরোটি শিশুকে বেআইনি ভাবে দত্তক দেওয়াতে তাঁদের জড়িত থাকার প্রমাণ পেয়েছিল সিআইডি। উত্তর ২৪ পরগনায় শিশুপাচার চক্রের সঙ্গে হোম কর্তৃপক্ষের ও জেলার ‘স্পেশালাইজ়ড অ্যাডপশন এজেন্সি’-র যোগসাজশ মিলেছিল। অতএব দালালদের ধরাই যথেষ্ট নয়, সংগঠিত অপরাধ চক্রটিকে প্রকাশ্যে আনা দরকার।
শিশু বিক্রির যে ঘটনাগুলি সংবাদে এসেছে, সেগুলিতে পাড়া-প্রতিবেশীই বিষয়টি নিয়ে পুলিশে অভিযোগ দায়ের করেছে। তার পরে তদন্তে নামছে পুলিশ। প্রশ্ন হল, এই চক্রগুলি যে সক্রিয় রয়েছে, তা জেনেও রাজ্য পুলিশ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে আইভিএফ কেন্দ্র এবং নার্সিংহোমগুলিকে সতর্ক করেনি কেন? নজরদারি আরও কড়া হয়নি কেন? কেনই বা নারী ও শিশুকল্যাণ দপ্তর, বা শিশু-অধিকার সুরক্ষা কমিশনের তরফ থেকে শিশু কেনা-বেচার ঝুঁকির বিষয়ে প্রচার করা হয়নি? অভিভাবকহীন শিশুকে গ্রহণ, এবং দত্তক দানের বৈধ ব্যবস্থা বিষয়ে মানুষকে, বিশেষত শিশুসন্তান গ্রহণে আগ্রহী দম্পতিদের যথেষ্ট অবহিত করা দরকার। শিশুকে ভরণপোষণের জন্য যে কারও হাতে তুলে দেওয়া, বা সে বিষয়ে মধ্যস্থতা করা যে বেআইনি, তা অনেক দরিদ্র মানুষ এখনও জানেন না। হাসপাতাল, নার্সিংহোমের এক শ্রেণির কর্মী তার সুবিধা নেন। নতুন প্রযুক্তির সুবিধার বিপরীতে সব সময়েই থাকে নতুন ধরনের প্রতারণার ঝুঁকি। আইভিএফ, সারোগেসি প্রভৃতি প্রযুক্তির অপব্যবহার করে মানবশরীরকে সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র করে তোলা, এবং শিশুকে পণ্য করে ফেলার নিদর্শন ভারতে কম নেই। এ সব রুখতে আইন ও বিধি কঠোর করা হয়েছে। শিশু চুরি, শিশুপাচারের পুরনো চক্রগুলো যাতে এই কাজে লাগাতে না পারে, সে বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে নার্সিংহোম, আইভিএফ কেন্দ্রের পরিচালকদেরও। শিশুকে পণ্য করা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ।
Advertisement



