• facebook
  • twitter
Tuesday, 19 August, 2025

চতুরঙ্গ

আর সঙ্গে সঙ্গে দুটি ছোকরা জাহাজের দু’প্রান্ত থেকে চুম্বকে টানা লোহার মত তার গায়ের দু’দিকে যেন সেঁটে গেল। স্পষ্ট বোঝা গেল, এতক্ষণ ধরে দু’জনাই তার পদধ্বনির প্রতীক্ষায় ছিল।

প্রতীকী চিত্র

পূর্ব প্রকাশিতর পর

চাচা বললেন, ‘যায়, যায়, যায়। আকছারই যায়। অবশ্য প্র্যাকটিস থাকলে?’
আড্ডা সমন্বয়ে বললে, ‘প্র্যাকটিস!’
চাচা বললেন, ‘হ। এবারে দেশে যাবার সময় জাহাজে হয়েছে।’
গল্পের গন্ধ পেয়ে আড্ডা আসন জমিয়ে বললে, ‘ছাড়ুন, চাচা।’

চাচা বললেন, ‘এবার দেখি, জাহাজ ভর্তি ইহুদির পাল। জর্মনি, অষ্ট্রিয়া, চেকোস্লোভাকিয়া থেকে ঝেঁটাই করে সবাই যাচ্ছে শাংহাই। সেখানে যেতে নাকি ভিজার প্রয়োজন হয় না। কি করে টের পেয়েছে, এবারে হিটলার দাবড়াতে আরম্ভ করলে নেবুকাডনাজারের বেবিলোনিয়ান ক্যাপটিভিটি নয়, এবারে স্রেফ কচু-কাটার পালা। তাই শাংহাই হয়ে গেছে ওদের ল্যাণ্ড অব মিলক্ এণ্ড হানি, ননীমধুর দেশ।

আমার ডেক-চেয়ারটা ছিল নিচের তলা থেকে ওঠার সিঁড়ির মুখের কাছে। ডাইনে এক বুড়ো ইহুদি আর বাঁয়ে এক ফরাসী উকিল। ইহুদি ভিয়েনার লোক, মাতৃভাষা জর্মন, ফরাসী জানে না। আর ফরাসী উকিল জর্মন জানে না, সে তো জানা কথা। ফরাসী ভাষা ছাড়া পৃথিবীতে অন্য ভাষা চালু আছে সে তত্ত্ব জাহাজে উঠে সে এই প্রথম আবিষ্কার করলে। এতদিন তার বিশ্বাস ছিল, পৃথিবীর আর সর্বত্র ভাঙা-ভাঙা ফরাসী, পিজিন ফ্রেঞ্চই চলে—বিদেশীর। প্যারিসে এলে যে রকম টুকিটাকি ফরাসী বলে ঐ রকম আর কি।
তিনজনাতে তিনখানা বই পড়ার ভান করে এক একবার সিঁড়ি দিয়ে উঠনে-ওলা নামনে-ওলা চিড়িয়াগুলোর দিকে তাকাই, তারপর বইয়ের দিকে নজর ফিরিয়ে আপন আপন সুচিন্তিত মন্তব্য প্রকাশ করি।

একটি মধ্যবয়স্কা উঠলেন। জর্মন-ইহুদি বললে, ‘হালব্-উন্ট-হাল্ব্’—অর্থাৎ হাফাহাফি।’ ফরাসী বললে, ‘অঁ প্যো আঁসিয়েন্’—একটুখানি এনশেন্ট।’ জর্মন আমাকে শুধালে, ‘ফ্রেঞ্চি কি বললে?’ আমি অনুবাদ করলুম। জর্মন বললে, ‘চল্লিশ, পঁয়তাল্লিশ হবে। তা আর এমন কি বয়স— নিষ্ট ভার— নয় কি?’ ফরাসী আমাকে শুধালে ‘ক্য দি তিল্?’— কি বললে ও?’ উত্তর শুনে বললে, ‘ম’ দিয়ো-ইয়াল্লা—চল্লিশ আবার বয়স নয়! একটা কেথীড্রেলের পক্ষে অবশ্য নয়। কিন্তু মেয়েছেলে, ছোঃ!’

এমন সময় হঠাৎ এক সঙ্গে তিনজনের তিনখানা বই ঠাস করে আপন উরুতে পড়ে গেল। কোর্ট-মার্শালের হুকুম মোতাবেক যে রকম দশটা বন্দুক এক ঝটকায় গুলি ছোড়ে। কি ব্যপার? দ্যাখতো না দ্যাখ, সিঁড়ি দিয়ে উঠলো এক তরুণী!
সে কী চেহারা! এ রকম রমণী দেখেই ভারতচন্দ্রের মুণ্ডুটি ঘুয়ে যায় আর মানুষে দেবতাতে ঘুলিয়ে ফেলে বলেছিলেন, ‘এ তো মেয়ে মেয়ে নয় দেবতা নিশ্চয়।’

ইটালির গোলাপী মার্বেল দিয়ে কোঁদা মুখখানি, যেন কাজল দিয়ে আঁকা দুটি ভুরুর জোড়া পাখিটি গোলাপী আকাশে ডানা মেলেছে, চোখ দুটি সমুদ্রের ফেনার উপর বসানো দুটি উজ্জ্বল নীলমণি, নাকটি যেন নন্দলালের আঁকা সতী অপর্ণার আবক্ররেখা মুখের সৌন্দর্যকে দু’ভাগ করে দিয়েছে, ঠোঁট দুটিতে লেগেছে গোলাপ ফুলের পাপড়িতে যেন প্রথম বসন্তের মৃদু পবনের ক্ষীণ শিহরণ।’

চাচা বললেন, ‘তা সে যাকগে। আমার বয়স হয়েছে। তোদের সামনে সব কথা বলতে বাধো বাধো ঠেকে। কিন্তু সত্যি বলতে কি, অপূর্ব, অপূর্ব।
দেখেই বোঝা যায়, ইহুদি—প্রাচ্য প্রাতীচ্য উভয় সৌন্দর্যের অদ্ভুত সম্মেলন।
জর্মন এবং ফরাসী দুজনাই চুপ। আস্মো।

আর সঙ্গে সঙ্গে দুটি ছোকরা জাহাজের দু’প্রান্ত থেকে চুম্বকে টানা লোহার মত তার গায়ের দু’দিকে যেন সেঁটে গেল। স্পষ্ট বোঝা গেল, এতক্ষণ ধরে দু’জনাই তার পদধ্বনির প্রতীক্ষায় ছিল।

(ক্রমশ)