পূর্ব প্রকাশিতর পর
তাই আমিও ওমরের সামান্যতম ঐতিহাসিক পটভূমি নির্মাণ করার চেষ্টা করছি এবং তাও শুধু ওমরের বিদ্রোহী মনোভাব দেখবার জন্য— কারণ ঐখানেই নজরুল ইসলামের সঙ্গে তিনি সখ্যসূত্রে আবদ্ধ হয়েছেন।
ওমরের প্রধান বিদ্রোহ ধর্মগুরুদের বিরুদ্ধে: ‘খা’জা! তোমার দরবারে মোর একটি শুধু আর্জি এই / থামাও উপদেশের ঘটা, মুক্তি আমার এই পথেই। / দৃষ্টি-দোষে দেখছ বাঁকা আমার সোজা সরল পথ, / আমায় ছেড়ে ভালো করো, ঝাপসা তোমার চক্ষুকেই।’
(কাজী সাহেবের অনুবাদ)
‘O master! Grant us only this, we prithee; / Preach not! But mutely guide to bliss, / we prithee! / “We walk not straight”— Nay, / it is thou who squintest! / ‘Go, heal thy sight, and leave us in pece, / we prithee!’ (কার্ণের অনুবাদ)
পৌরাণিক এবং ঐতিহাসিক রাজা-রাজড়ার শৌর্যবীর্য নিয়ে যেসব কবি ফিরদৌসীর ন্যায় আস্ফালন করে বর্তমানের আনন্দকে অবহেলা করতেন তাঁদের সম্বন্ধে বলছেন—
‘ভাষ্য-লিপি মিথ্যা সে নয়—ফুরোয় যা’তা ফুরিয়ে যাক, / কৈকোবাদ আর কৈখ্সরুর ইতিহাসের নামটা থাক। / রুস্তম আর হাতেম-তায়ের কল্পকথা—স্মৃতির ফাঁস— / সে-সব খেয়াল ঘুচিয়ে দিয়ে আজকে এস আমার পাশ।’ (কান্তি ঘোষ)
দরবেশ-সুফীরা করতেন কৃচ্ছ্রসাধন এবং যোগচর্চা। পূর্বেই নিবেদন করেছি, তাঁরা নৃত্যের সঙ্গে চিৎকার করতেন নাম জপ, তাঁদের বিশ্বাস, ঐ করেই ভগবৎপ্রেম এবং চরম মোক্ষ পাওয়া যায়।
‘দ্রাক্ষালতার শিকড় সেটি তার না জানি কতই গুণ— / জড়িয়ে আছেন অস্থিতে মোর, দরবেশী সাঁই যাই বলুন—/ গগনভেদী চীৎকারে তাঁর খুলবে নাকো মুক্তিদ্বার, / অস্থিতে এই মিলবে যে খোঁজ সেই দুয়ারের কুঞ্চিকার।’ (কান্তি ঘোষ)
কিন্তু সবচেয়ে বেশী চতুষ্পদী তিনি রচনা করেছেন দার্শনিক এবং পণ্ডিতদের বিরুদ্ধে। সেখানে তিনি জ্যোতির্বিদ ওমরকেও বাদ দেননি।
’অস্তি-নাস্তি শেষ করেছি, দার্শনিকের গভীর জ্ঞান / বীজগণিতের সূত্র-রেখা যৌবনে মোর ছিলই ধ্যান; / বিদ্যারসে যদই ডুবি, মনটা জানে মনে (মানে?) স্থির— / দ্রাক্ষারসের জ্ঞানটা ছাড়া রসজ্ঞানে নেই গভীর।’
অর্থহীন, অর্থহীন, সমস্তই অর্থহীন। তাই ওমরের বারবার কাতর রোদন, দরদী ফরিদায়—
‘হেথায় আমার আসাতে প্রভু হননি তো লাভবান / চলে যাবো যবে হবেন না তিনি কোনো মতে গরীয়ান। / এ কর্ণে আমি শুনিনি তো কভু কোনো মানবের কাছে / এই আশা-যাওয়া কি এর অর্থ—খামখা পোড়েন টান।’ (লেখক)
তাই ওমরের শেষ মীমাংসা—একবার মরে যাবার পর তুমি আর এখানে ফিরে আসবে না। অতএব যতটুকু পারো, যতক্ষণ পারো দর্শন-বিজ্ঞান-সাঁই সুফীদের ভুলে গিয়ে সাকী সুরা নিয়ে নির্জন কোণে আনন্দ করো।
‘মৃত্যু আসিয়া মস্তকে মোর আঘাত করার আগে। / লে আও শরাব—লাও ঝটপট—রাঙানো গোলাপী রাগে। / হায়রে মূর্খ। সোনা দিয়ে মাজা তোর কি শরীরখানা—? / গোর হয়ে গেলে ফের খুঁড়ে নেবে? ও ছাই / কি কাজে লাগে। (লেখক)
কিন্তু একটা জিনিস ভুল করলে চলবে না। ওমর খাঁটি চার্বাকপন্থী এবং ঐ জাতীয় লেকায়তীদের মত নন। ‘ঋণ ক’রে ঘি খাও, কারণ দেহ ভষ্মীভূত হলে ঋণ তো আর শোধ করতে হবে না’, অর্থাৎ ইহসংসারে কিংবা পরলোকে অন্য কারো প্রতি তোমার কোনো নৈতিক দায়িত্ব—মরাল রেসপনসিবিলিটি নেই— এ তত্ত্বের ওমর বিশ্বাস করতেন না। তাই তাঁর একমাত্র উপদেশ—
‘কারুর প্রাণে দুখ্ দিও না, করো বরং হাজার পাপ, / পরের মনে শান্তি নাশি বাড়িও না আর মনস্তাপ। / অমর-আশিস্ লাভের আশা রয় যদি, হে বন্ধু মোর, / আপনি স’য়ে ব্যথা, মুছো পরের বুকের ব্যথার ছাপ!’ (নজরুল ইসলাম) (ক্রমশ)