পূর্ব প্রকাশিতর পর
সিকান্দ্রার গম্বুজ শেষ করার পূর্বেই আকবর ইহলোক ত্যাগ করেন— তাই বলা শক্ত সম্পূর্ণ সমাধি মনে রসের কোন ভাবের উদয় করে দিত। দিওয়ান-ই-খাস্ ও আম্ যে অলঙ্কারের চূড়ান্তে পৌঁছে দিয়েছে, সে সত্য তো পৃথিবীর সবাই স্বীকার করে নিয়েছে। এত দিন বলা হত, পাঠান স্থাপত্যে স্থপতি ও স্বর্ণকার একজোটে কাজ করেছেন। দিওয়ান-ই-খাস ও আম্ দেখে লোকে বলল, এইবাবে এসে জহুরীও যোগ দিয়েছেন।
মোগল-কলা এত বিচিত্র ও ভিন্নমুখী যে, তাকে গুটিকয়েক সূত্রে ফেলা প্রায় অসম্ভব। তবে স্থাপত্যের বিকাশ দেখতে হলেসবচেয়ে উত্তম পন্থা হুমায়ুনের কবর ও তাজ দুটি মিলিয়ে দেখা। দুটোর গম্বুজ মিলিয়ে দেখুন, ছত্রিগুলো কার ভালো (এখানে বলা উচিত হুমায়ুনের ছত্রিগুলো নীল টাইলে ঢাকা ছিল; এখন উঠে গিয়ে কালো হয়ে গিয়েছে— তাই আগে ছিল গম্বুজ মর্মরের সাদা, পুরো ইমারত লাল পাথরের লাল আর ছত্রিগুলোর গম্বুজ নীল; তাজে তিনই মার্বেলের); হুমায়ুনের ভিত্তিতে এক সার আর্চ (তার ভিতর দিয়ে নিচে যায়ো যায়), তাজে তার ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে মাত্র; গুলদস্তাজ্ (মিনারিকার ও ছোট মিনারিকা) যার শেষ হয় অর্ধস্ফূট পদ্মকোরকে—দুই ইমারতেই এক রকম; নির্মাণকালে হুমায়ুনে ছিললাল-সাদা-নীলের সামঞ্জস্য, তাজ শুভ্র-ধবল এবং সবচেয়ে বড় পার্থক্য—হুমায়ুনে মিনারিকা নেই, তাজের চার কোণে চারটি। আপনার কোনইট ভালো লাগে? আর এই শৈলীর অধঃপতন দেখতে হলে দেখুন।
স্পষ্ট দেখছি হুমায়ুনে দার্ঢ্য, তাজে মাধুর্য।
তার কারণ, অনেক ভেবে আমি মনস্থির করেছি, হুমায়ুনের সমাধি নির্মাণ করেছেন তাঁর বিধবা—স্বামীর জন্য। তাই তাতে পৌরুষ সমধিক। তাজ নির্মাণ করেছেন বিরহকাতর স্বামী—প্রিয়ার জন্য। তাই সেটিতে লালিত্য বেশী।
বেজো না চরণে চরণে
বিখ্যাত সাহিত্যিকদের কাছে নাকি নবীন সাহিত্যিকরা তাঁদের লেখা নিয়ে গিয়ে চাঁইদের সার্টিফিকেট চান। বেচারীদের বিশ্বাস, চাঁইরা উত্তম সার্টিফিকেট দিলে তাঁরা সাহিত্যিক হিসেবে খ্যাতিপ্রতিপত্তি পেয়ে যাবেন।
চাঁইদের কেউ কেউ সার্টিফিকেট দেন, কেউ লেখককে অন্য চাঁইদের কাছে পাঠিয়ে দেন, কেউ বা অসুখের ভান করে দেখাই করেন না। এ বাবদে পূজনীয় রাজশেখরবাবু রাজকীয় পন্থাটি বের করে আরামসে দিন কাটাচ্ছেন। তিনি সবাইকে অকাতরে সার্টিফিকেট দেন—এমন কি মাঝে-মধ্যে না চাইলেও দেন। তাঁর বয়স হয়েছে। শেষের ক’টি দিন শান্তিতে কাটাতে চান। সোজাসুজি ‘দেব না’ বললে তাঁকে আর বাঁচতে হবে না, এবং ‘দেব-দিচ্ছি’ করে টাল-বাহানা দেবার মতো শক্তিও তাঁর নেই।
রবীন্দ্রনাথ অমিতবীর্য পুরুষসিংহবৎ ছিলেন, উমেদওয়ারদের ঠেকাবার মতো তাঁর সেক্রেটারিও ছিলেন—তবু তিনিও অকাতরে সার্টিফিকেট দিতেন। প্রাণের প্রতি তাঁর অহেতুক কোনো মায়াও ছিল না—‘মরণরে তুহুঁ শ্যাম সমান’ এ গান তিনি রচেছেন অল্প বয়সেই—তবু তিনি ‘না-চাহিতে যারে দেওয়া যায়’ ভাবখানা মুখে মেখে পিলপিল করে সার্টিফিকেট বিলোতেন। (ক্রমশ)