• facebook
  • twitter
Tuesday, 5 August, 2025

চতুরঙ্গ

ইমারৎ তৈরি করা কত সোজা! কারিগরের হাতে সেখানে কত অজস্র মাল-মশলা! গম্বুজ, থাম, আর্চ, ছত্রি, মিনারেট, ছজ্জা (ড্রিপস্টোন), কার্নিস, ব্র্যাকেট কত কী!

পূর্ব প্রকাশিতর পর

দ্বিতীয় তলাতে শুধু বাঁশী, তৃতীয় তলাতে শুধু কোণ। চতুর্থ ও পঞ্চম তলাতে কি ছিল জানার উপায় নেই, কারণ বজ্রাঘাতে সে দুটি ভেঙে যাওয়ায় ফিরোজ দুগলুক (যিনি ‘অশোক স্তম্ভ’ দিল্লী আনেন; ইনি যেমন নিজে সোৎসাহে ইমারত বানাতেন ঠিক তেমনি অকাতরে অন্যের ইমারত মোরামৎ করে দিতেন—দিল্লীর অতি অল্প রাজাতেই এই দ্বিতীয় গুণটি পাওয়া যায়) সে দুটি মার্বল দিয়ে মেরামৎ করে দেন. পঞ্চমটিতে নাকি আবার সিকন্দর লোদীরও হাত আছে।

মিনারের মুকুটরূপে সর্বশেষ (যেখানে এখন আলো জ্বালানো হয়) কি ছিল সে সম্বন্ধে রসিকজনের কৌতূহলের অন্ত নেই। দনিয়ার সবচেয়ে সেরা মিনারকে স্থপতি কি রাজমুকুট পরিয়েছিলেন—সেখানেও তিনি তাল রেখে শেষরক্ষা করতে পেরেচিলেন কিনা, তাঁর যে অদ্ভুত কল্পনা-শক্তি মিনারের সর্বাঙ্গে স্বপ্রকাশ, সে-কল্পনাশক্তি দিয়ে তিনি দর্শককে কোন্ দ্যুলোকে উড়িয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন, কে জানে?

ইমারৎ তৈরি করা কত সোজা! কারিগরের হাতে সেখানে কত অজস্র মাল-মশলা! গম্বুজ, থাম, আর্চ, ছত্রি, মিনারেট, ছজ্জা (ড্রিপস্টোন), কার্নিস, ব্র্যাকেট কত কী! তার তুলনায় একটি সোজা খাড়া স্তম্ভে সৌন্দর্য আনা কত শক্ত! এখানে শিল্পী সফল হয়েছেন শুদু সেটাকে কয়েকটি তলাতে বিভক্ত করে, সামঞ্জস্য রেখে প্রতি তলায় তাকে একটু চো করে করে, গুটি কয়েক ব্যালকনি লাগিয়ে দিয়ে এবং মিনারের গায়ে কখনো ‘বাঁশী’, কখনো ‘কোণে’র নকশা কেটে। প্রদর্শনের এরকম চূড়ান্ত পৃথিবীর আর কোনো মিনারে পাওয়া যায় না।

আর তার গায়ের কারুকার্যও অতি অদ্ভুত। বাঁশী এবং কোণের উপর দিয়ে সমস্ত মিনারটিকে কোমরবন্ধের মতো গিরে রয়েছে সারিসারি লতা-পাতা, ফুলের মালা, চক্রের নকশা। এগুলো জাতে হিন্দু এবং এর সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে এক সারি অন্তর আরবী লেখার সার—সেগুলো জতে মুসলমান। কিন্তু উভয় খোদাইয়ের কাজই যে হিন্দু শিল্পী করেছেন সে বিষয়ে কণামাত্র সন্দেহের অবকাশ নেই। গোটা মিনারটির পরিকল্পনা করেছে মুসলমান, যাবতীয় কারুশিল্প করেছে হিন্দু—ভারতবর্ষে মুসলমানদের সর্বপ্রথম সৃষ্টিকার্যে হিন্দু-মুসলমান মিলে গিয়ে যে অদ্ভুত সাফল্য দেখিয়েছিল সে মিলন পরবর্তী যুগে কখনো ভঙ্গ হয়নি, কভু বা মুসলমানের প্রাধান্য বেশী, কোনো ইমারতে হিন্দুর প্রধান্য বেশী। আট শত বৎসর এক সঙ্গে থেকেও হিন্দু-মুসলমান চিন্তার ক্ষেত্রে, রাজনীতির জগতে সম্পূর্ণ এক হয়ে যেতে পারেনি, কিন্তু কলার প্রাঙ্গণে (স্থাপত্য, সঙ্গীত এবং নৃত্যে) প্রথম দিনেই তাদের যে মিলন হয়েছিল, আজও সেটি অটুট আছে।

কুৎবের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আর কোনো মিনার কখনো মাথা খাড়া করেনি। দীর্ঘ আট শতাব্দী দরে বহু বাদশা বহু ইমারৎ গড়েছেন কিন্তু ‘কুৎবের চেয়েও ভালো মিনার গড়বো’ এ সাহস কেউ দেখান নি। যে ইংরেজ দিল্লীতে সেক্রেটারিয়েট, রাজভবন গড়ে, কলকাতায় ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল বানিয়ে নিজেকে অতুল বিড়ম্বিত করেছে, সেও বিলক্ষণ জানতো কুৎবের সঙ্গে পাল্লা দেওয়া কোনো স্থপতির কর্ম নয়।

(ক্রমশ)