পূর্ব প্রকাশিতর পর
যুক্তি নয়, অজুহাত হিসেবে বলা যেতে পারে, আকবরের আমল থেকে বহুল ফার্সী শিক্ষাদানের ফলে বাঙলাদেশে তখন প্রচুর লোক বিস্তর আরবী-ফার্সী শব্দ দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহার করতে আরম্ভ করেছে। এটা কন্তু কোনো সংযুক্তি নয়। কারণ আজ আমরা দৈনন্দিন জীবনে বিস্তর ইংরিজি শব্দ ব্যবহার করি: তাই বলে সাহিত্যসৃষ্টিরসময় বে-এক্তেয়ার হয়ে যত্র-তত্র ভূরি ভূরি ইংরিজি শব্দ ব্যবহার করিনে।
কিন্তু সত্য কবি পথভ্রষ্ট হন না। তার প্রকৃত নিদর্শন আমরা পাই, চট্টগ্রামের মহিলা কবি শ্রীমতী রহীম্মুনিসার’ (আশা করি ‘শ্রীমতী’ লেখাতে কেউ আপত্তি করবেন না, কারণ তিনি নিজেই তাঁর কাব্যে আপন পরিচয় দেবার সময় লিখেছেন— ‘‘স্বামী আজ্ঞা শিরে পালি লিখি এ-ভারতী। / রহিমুনিচা নাম জান আদ্যে ছিরীমতী।।’’
এক মহিলা কবির সঙ্গে হালে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন সুপণ্ডিত ডক্টর মুহম্মদ এনামুল হক, পূর্ববঙ্গের বাঙলা-একাডেমির প্রথম ডাইরেক্টর (বাঙলা একাডেমী পত্রিকা, ১ম সংখ্যা, পৌষ ১৩৬৩,পৃ: ৫৩)। তাঁর মতে ‘১০৬৩ খৃষ্টাব্দ হইতে ১৮০০ খৃষ্টাব্দের মধ্যেই রহীমু’ন-নিসা আবির্ভূতা হয়েছিলেন।’ ইনিও সৈয়দ সুলতানের মত সৈয়দ বংশের মেয়ে এবং পরিবারে প্রচুর আরবী-ফার্সীর চর্চা থাকা সত্ত্বেও সুস্থ, সরল এবং মধুর বাঙলায় কবিতা রচনা করে গিয়েছেন।
এঁর হাতের লেখা খুব সম্ভব সুন্দর ছিল। তাই বোধ করি তাঁর স্বামী তাঁকে কবি আলাওলের ‘পদ্মাবতী’ নকল করতে আদেশ দেনঃ—
‘শুন গুণিগণ হই এক মন, / লেখিকার নিবেদন। / অক্ষর পড়িলে টুটা পদ হৈলে / শুধারি অ সর্ব্বজন।। / পদ এই রাষ্ট্র হেন মহাকষ্ট / পুঁথি সতী পদ্মাবতী। / আলাওল মণি, বুদ্ধি বলে গুণী, / বিরচিল এ ভারতী।। / পদের উকতি বুঝি কি শকতি, / মুই হীন তিরী জাতি। / স্বামীর আদেশ মানিয়া বিশেষ / সাহস করিল গাঁথি।।’
রহীমুন্নিসার স্বরচিত কাব্য অল্পই পাওয়া গিয়াছে। এর মধ্যে তাঁর একটি ‘বারমাস্যা’ বড়ই করুণ এবং মধুর। পূর্ববঙ্গের কবিরা সচরাচর প্রিয় বিরহে বারমাস্যা রচনা করেছেন—রবীমুন্নিসা ভ্রাতৃশোকে তাঁর নব বারমাস্যা রচনা করেছেন।
আশ্বিনেতে খোয়াময় / কান্দে তরুলতাচর / ভাই বলি কান্দে উভরায়। / আমার কান্দনি শুনি / বনে কান্দে কুরঙ্গিনী / জল মাছ কান্দিয়া লুকায়।।
(খোয়া=কুয়াশা)
অন্য এক স্থলে ‘কন্যাহারা জননী’র শোকাতুরার ক্রন্দন প্রকাশ করেছেন অতুলনীয় সরল বাঙলায়—
নয়া সন নয়া মাস ফিরে বারে বার / মোর জাদু গেল ফিরি না আসিল আর।।
এঁর রচনায় সত্যই মধুর কবি-প্রতিভা ‘বারেবার’
ধরা পড়ে। পাঠককে মূল প্রবন্ধটি পড়তে অনুরোধ জানাই।
(ক্রমশ)