• facebook
  • twitter
Friday, 5 December, 2025

সিজিএসটি-র লেনদেনে লঙ্ঘিত নগদ বিধি

সরকারের ভাবখানা এমন, নিজের বেলায় আঁটিশুটি পরের বেলায় দাঁত কপাটি। কি আর করবেন? কিছুই করার নেই আপনার।

প্রতীকী চিত্র

একেই বলে, নিজের বলবৎ করা আইন নিজেই অমান্য করে। একদম ঠিক শুনেছেন। নগদ লেনদেনের ক্ষেত্রে আপনি যদি ভারতীয় হিসেবে ভারতের অভ্যন্তরে দেশের নিময় কোনও ভাবে লঙ্ঘন করেন, তবে নিশ্চিত জানবে সেক্ষেত্রে আপনি আইনানুগ শাস্তির মুখোমুখি হতে বাধ্য। এখানে কোনরকমের আপোষের স্থান নেই। নগদ লেনদেনের বিষয়ে এমনই সারা দেশ জুড়ে কঠোর ভাবে বিদ্যমান রয়েছে। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয়ের এমনই কড়া বিধি।

কিন্তু ওই যে, আমরা হামেশাই বলে থাকি ফাঁকা কলসীর আওয়াজ বেশি। আসলে নগদ লেনদেনের ক্ষেত্রে কোথাও না কোথাও বিশেষ ক্ষেত্রের শিথিলতাও যে বেশ প্রকট। সেটাও আবার যদি হয় কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রকের অধীনে।

Advertisement

আসলে এই নগদ লেনদেনের শিথিলতা শুধুমাত্র প্রযোজ্য গোপনীয়তার কারণে। আবার বলি সাবধান। এসব গোপনীয়তার নামে নগদ লেনদেনের বিষয়ে আপনার কোনও ভূমিকাকে পাত্তা দিতে নারাজ, অন্তত দেশীয় বিধি তো তাই বলে। আরে মশাই আদার ব্যাপারি হয়ে জাহাজের খোঁজের আপনার কি দরকার। দেশের নিয়মটা আপনি সুনাগরিক হয়ে মেনে চলুন। ব্যাস্ ঝামেলা মিটে গেল। এতে আপনিও নিশ্চিত থাকলেন আর দেশের আর্থিক স্বচ্ছলতাও নিরাপদে থাকলো। সো নো টেনসন। তবে হ্যাঁ! গোপনীয়তা রক্ষার দায় কিন্তু সরকারের আছে। তাই সরকার বাহাদুরের নগদ লেনদেনের ক্ষেত্রে কিন্তু কোনও সীমারেখা নেই। সরকার মনে করলে অগুনতি অর্থ নগদে কাউকে দিতেই পারে।

Advertisement

অর্থাৎ, সরকারের ভাবখানা এমন, নিজের বেলায় আঁটিশুটি পরের বেলায় দাঁত কপাটি। কি আর করবেন? কিছুই করার নেই আপনার। আপনি সুশীল নাগরিক হলে আপনার সর্বাগ্রে উচিৎ দেশে জারি করা যাবতীয় আইন সর্বান্তকরণে মেনে চলা। এটাও আপনাকে বুঝতেই হবে, সব কিছু সবার জন্য প্রযোজ্য হতে পারে না। তাই নগদ লেনদেনের বিষয়ে যাবতীয় আইন মেনে চলাটাও আপনার পরম কর্তব্যের মধ্যে পড়ে বৈকি। যা সরকারী ব্যবস্থাপনার জন্য শুধুমাত্র উপস্থাপিত সেখানে আপনার ব্যক্তিগত সত্ত্বা ব্রাত্যও হতে পারে দেশের প্রয়োজনে। তাছাড়া অবশ্যই বৃহত্তর স্বার্থরক্ষা ও সুরক্ষা দেওয়ার জায়গায় রাষ্ট্রের তো একটা আলাদা দায়িত্ব থেকেই যায়। ঠিক কিনা?

হ্যাঁ শুনতে অদ্ভুত লাগলেও এমনতর বাস্তব পর্যালোচনা আমাদের সমাজ ব্যবস্থাতেই সুপ্রতিষ্ঠিত। কিছুটা অসামঞ্জস্যপূর্ণ আর্থিক অবাক কড়া বিধির মোরকে। অনেকটা যেন বাঘের ঘরে ঘোগের বাসার মতো অবস্থা যাকে বলে। এ’প্রসঙ্গে জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত হিসেবে আলোচনার আতস কাঁচের নিচে অবশ্যই টেনে আনা যায় সিজিএসটি বা ‘সেন্ট্রাল গুডস এন্ড সার্ভিসেস ট্যাক্স’কে। এই সিজিএসটির দফতর কিন্তু আক্ষরিক অর্থেই কেন্দ্রীয় সরকারের অর্থমন্ত্রকের অধীনস্থ।

দেশের আইন অনুসারে ২৬৯ এসটি ধারা অনুযায়ী একদিনে ভারতীয় মুদ্রায় নগদে দুই লক্ষ টাকার বেশি লেনদেন করা যায় না। এই বিধি দেশের সমস্ত নাগরিকদের জন্য সমান ভাবে জারি করা হয়েছে। অন্যথায় এই সীমারেখা কোনও অবস্থাতেই না মানা হলে তা সম্পূর্ণ বেআইনি লেনদেন হিসেবে গ্রাহ্য করা হবে। কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রণালয় সুপারিশেই এমনতর আইন দেশব্যাপী লাগু রয়েছে অত্যন্ত কঠোর ভাবে। অথচ জিএসটি (গুডস এন্ড সার্ভিসেস ট্যাক্স)’র রেভিনিউ আদায়ের একটি অতি বিশেষ ক্ষেত্রে এই নিয়মকে মানেই না কেন্দ্রীয় অর্থ দফতরের সরাসরি নিয়ন্ত্রিত এই সিজিএসটি। সেরকম প্রয়োজন পড়লে সংশ্লিষ্ট দফতর থেকে ২৬৯ এসটি ধারা উপেক্ষা করে একদিনে কোটি কোটি টাকা লেনদেন করা হয়। প্রকৃতই এটা চমকে যাবার মতোই তথ্য। কারণ সরকার যেখানে তার দেশের সমস্ত নাগরিকদের উদ্দেশ্যে একটা সীমারেখার উর্ধ্বে নগদ লেনদেন করার বিষয়ে বিধি নিষেধ বলবৎ করেছে, সেখানে খোদ সেই সরকারি সংস্থাই কিনা নগদ অর্থ প্রদানের ক্ষেত্রে সেই সীমারেখাকে কার্যত উপেক্ষাই করে কোনও বিশেষ ক্ষেত্রে। সত্য সেলুকাস কি বিচিত্র এই দেশ!

আসলে এখানে মূল আলোচ্য বিষয়টা এরকম, জিএসটি সংক্রান্ত রেভিনিউ সঠিক মাত্রায় আদায়ের জন্য সদা জাগ্রত সারা দেশের সিজিএসটি’র সঙ্গে যুক্ত কর্মকর্তারা। যাতে কেউ বা কোনও সংস্থা জিএসটি ফাঁকি না দিতে পারে তার জন্য নানা সময়ে বিভিন্ন জায়গায় সিজিএসটি আধিকারিকেরা নিয়মিত অভিযানও চালিয়ে থাকেন নিয়মিত পর্যায়ে। এমনকি ক্ষমাযোগ্য রকমারি আকর্ষণীয় নিয়মানুযায়ী স্কীমও লাগু করা হয়েছে রেভিনিউ আদায়পর্ব সুচারু ভাবে সম্পন্ন করার উদ্দেশ্যে। তবু এতো কিছু প্রচেষ্টার পড়েও জিএসটি ফাঁকি দেবার প্রবণতা সারা দেশেও এখনও উল্লেখযোগ্য হারে বিদ্যমান থেকে গেছে। আর এই ফাঁকি দেবার সংখ্যাটা নেহাতই কম নয়। এ’বিষয়ে কলকাতা জোনের চিফ কমিশনার (সিজিএসটি) শ্রাবণ কুমার বলেন, “জিএসটি ফাঁকি রুখতে আমাদের হামেশাই বিভিন্ন গোপন সোর্সের উপর নির্ভর করতে হয়। আমরা শেষ তিন মাসের মধ্যে আটশো কোটি টাকার ফাঁকি দেওয়া জিএসটির রেভিনিউ আদায় করেছি। এই কান্ডে এখনও পর্যন্ত আটজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। আর এক্ষেত্রে আমাদের সোর্সের একটা বড় ভূমিকা থাকে যা অনস্বীকার্য।”

সিজিএসটি’র কর্মরত আধিকারিদের এই সোর্স নিয়েই যত নগদ লেনদেনের বিধি লঙ্ঘনের বারোমাস্যা ঘটে চলেছে অতি গোপনে সবার অলক্ষ্যে। তবে কি সোর্সদের খুশ করার তাগিদে এমনতর বিধিভঙ্গের কোনও উপহার দেওয়া হয়? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি সরাসরি জানান, একদম ঠিক। আমরা কখনই প্রকাশ্যে কোনও সফল সোর্সকে কোনরূপ উপহার প্রদান করি না। পুরস্কৃত করা হয় অত্যন্ত গোপনীয়তা মেনে। এ’ব্যাপারে সোর্সের ব্যক্তি সুরক্ষার কথা পর্যালোচনা করে পুরো বিষয়ে চুড়ান্ত গোপনীয়তা আমরা রক্ষা করে চলি। বিনিময়ে আমরা সোর্সকে নগদ টাকা হাতে হাতে প্রদান করি পুরস্কার হিসেবে। সেক্ষেত্রে ব্যাঙ্ক লেনদেন ও ডিজিটাল পেমেন্ট আমরা পুরোপুরি এড়িয়ে চলি। সোর্সের সুরক্ষার স্বার্থে। যাতে সঠিক তথ্য আমাদের সরবরাহ করতে গিয়ে তাঁর পরিচয় জনসমক্ষে না চলে আসে, সেবিষয়ে আমরা চরম সতর্কতা অবলম্বন করি। অনথ্যায় তিনি বিপদগ্রস্ত হতে পারেন, যা আমাদের কখনও কাম্য নয়। এমনও উদাহরণ আছে একদিনে একত্রে নগদে আমরা কোটি টাকার উপরে পুরস্কৃত করেছি কোনও কোনও সোর্সকে। মোট আদায়কৃত রেভেনিউয়ের দশ শতাংশ থেকে কুড়ি শতাংশ অর্থ আমরা নগদে পুরস্কার হিসেবে ধার্য করি বলে তিনি মন্তব্য করেন।

একইসঙ্গে তিনি এও বলেন, “কেউ গোপনে অভিযোগ করলেই আমরা নগদ পুরস্কার দিই না। অভিযোগটা যথার্থ ও প্রমাণ সাপেক্ষ কিনা সেটা যাচাই করতে হয়। আবার এমনও দেখা গেছে কেউ জিএসটি রেভিনিউ প্রদান করার আগে নগদে কমিশন পুরস্কার প্রাপ্তির লোভে ড্যামি সোর্স দাঁড় করিয়ে দেন উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে। সেক্ষেত্রে আমরা ড্যামি সোর্স পুরোপুরি এড়িয়ে চলি। তাছাড়া কোনও প্রতিষ্ঠানকে আমরা সোর্স হিসেবে নগদ পুরস্কার দিই না। সোর্স আমাদের কাছে পুরোটাই ব্যক্তি কেন্দ্রিক হয়।”

প্রায় একই কথার প্রতিধ্বনি শোনা গেল কলকাতা নর্থের অ্যাডিশনাল কমিশনার (সিজিএসটি) প্রকাশ বোরগোহেনের কন্ঠে। তাঁর বক্তব্য, “যথার্থ সোর্সকে আমরা নূন্যতম দশ শতাংশ নগদ অর্থ পুরস্কার দিয়ে থাকি। সর্বোচ্চ স্তরের কুড়ি শতাংশ দেওয়া হয়। নালিশের মান, প্রামাণ্য নথি ও রেভিনিউ আদায়ের আর্থিক সংখ্যার ভিত্তিতে পুরস্কার প্রদানের শতাংশের পরিমাণ নির্ভর করে। আবার আগের থেকে চলমান কোনও তদন্তের উপর পুরস্কার কাউকে দেওয়া হয় না। জিএসটি ফাঁকি সংক্রান্ত সম্পূর্ণ নতুন অভিযোগকেই স্রেফ পুরস্কারের আওতায় আনা হয়।” গোপনীয়তার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “কোনও সোর্স আমাদের দফতরের আধিকারিকের সঙ্গে যোগাযোগ করলে শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট আধিকারিকই সোর্স সম্পর্কে সংযোগ রক্ষা করেন। এখানে অন্য কোনও আধিকারিকের ভূমিকা একদম থাকে না। সোর্সের নাম ও ঠিকানা রেকর্ড করারও রীতি নেই দফতরে। দু’টি বিশেষ ফর্মে নালিশের বিস্তারিত নথিভুক্ত করা থাকে। আর সোর্সের একমাত্র ফিঙ্গার প্রিন্ট ওই ফর্মে নেওয়া হয়। একটি ফর্ম গচ্ছিত রাখা হয় সোর্সের সঙ্গে সংযোগ রক্ষাকারী আধিকারিকের কাছে। অন্যটা পাঠিয়ে দেওয়া হয় নয়াদিল্লির সদর দফতরের সিজিএসটি কাউন্সিল সেক্রেটারিয়েটের কাছে। আসলে সোর্সের পরিচয় সম্পর্কে আমরা সর্বোচ্চ স্তরে গোপনীয়তা বজায় রাখি।

Advertisement