অসীম সুর চৌধুরী
১৯২১ সালের সেপ্টেম্বর মাসের কথা। বত্রিশ বছর বয়সী একজন তরুন ভারতীয় বিজ্ঞানী তাঁর প্রথম বিদেশ ভ্রমণ সেরে জাহাজে করে ফিরে আসছিলেন। তিনি অক্সফোর্ডে একটি আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয় কংগ্রেসে যোগ দিয়েছিলেন। সেন্ট পল ক্যাথিড্রালের হুইস্পারিং গ্যালারি সম্পর্কে প্রবন্ধ লেখার জন্য তিনি আমন্ত্রিত হয়েছিলেন। সেখানে উপস্থিত ছিলেন পৃথিবীবিখ্যাত বিজ্ঞানী জে জে থম্পসন এবং জন রাদারফোর্ড। তিনি তাঁদের সঙ্গে ভালো সময় কাটিয়েছিলেন।
জাহাজ সুয়েজ খাল হয়ে বোম্বে (অধুনা মুম্বই) যাওয়ার সময় তাঁর কাছে পর্যাপ্ত সময় ছিল সমুদ্রের রূপ উপভোগ করার। ভূমধ্যসাগরের নীল জলের তাকিয়ে একটি প্রশ্ন তাঁকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছিল। সেটা হল, ‘সমুদ্র নীল কেন’? এক গ্লাস জলের নিজস্ব কোনও রঙ নেই। কিন্তু গভীর সমুদ্রের একই জল নীল রঙ ধারণ করে। কেন এমন হয়? এই বিষয়ে ১৮৯৯ সালে, ইংরেজ পদার্থবিদ লর্ড রেলের বিশ্লেষনে সেই তরুন বিজ্ঞানী মোটেই একমত ছিলেন না। রেলে দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছিলেন যে সমুদ্রের সুন্দর নীল রঙের সঙ্গে জলের রঙের কোনও সম্পর্ক নেই বরং এটার কারন আকাশের রঙ প্রতিফলিত হয়ে সমুদ্রের জলকে নীল দেখায়’। তাছাড়া তখনকার বিভিন্ন বই ঘেঁটে তিনি জানতে পারেন যে, সেখানেও ওই একই ব্যাখ্যা দেওয়া আছে। কিন্তু তিনি নিশ্চিত হলেন না। তখনই তাঁর কাছে থাকা সহজ যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে জাহাজের মধ্যেই প্রাথমিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করে দিলেন।
বোম্বে বন্দরে নামার আগেই তিনি একটি ছোট প্রবন্ধ লিখে ফেললেন। পরবর্তীকালে বিখ্যাত নেচার পত্রিকায় এটা প্রকাশিত হয়েছিল। এই প্রবন্ধে তিনি লিখেছিলেন—
(১)
যে গভীর সমুদ্রের নীল রঙ নিজেই একটি স্বতন্ত্র ঘটনা, প্রতিফলিত আকাশের আলোর প্রভাব নয়। পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে এটা স্পষ্ট বোঝা গেছে। ভারতে পৌঁছে তিনি আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার পরে নিশ্চিত হয়েছিলেন যে আলো যখন জলের অণুর মুখোমুখি হয় তখন একটা প্রভাব পড়ে। আগেই জানা ছিল, সাদা আলো সাতটা রঙের মিশ্রণ। নীল রঙের তরঙ্গ দৈর্ঘ্য কম আর অন্যান্য রং যেমন সবুজ, হলুদ, লাল ইত্যাদির বেশি। সমুদ্রের জলে নীল আলো সবচেয়ে বেশি ছড়িয়ে পড়ে কিন্তু অন্যান্য রং শোষিত হয়। যার ফলে সমুদ্র নীল দেখায়। জলে অন্যান্য রঙের তুলনায় নীল আলো বেশি প্রতিফলিত হয়। ঠিক একই কারণে আকাশ নীল দেখায়।
এই ভারতীয় বিজ্ঞানীর যুগান্তকারী আবিষ্কারের পুরস্কার স্বরূপ ১৯৩০ সালের পদার্থ বিজ্ঞানের নোবেল তাঁর হাতে তুলে দেওয়া হয়। তিনি হলেন পদার্থ বিজ্ঞানে নোবেল পাওয়া প্রথম ভারতীয় তথা প্রথম এশীয় তথা প্রথম অশ্বেতাঙ্গ। এই প্রতিভাধর বিজ্ঞানীর পুরো নাম হল চন্দ্রশেখর ভেঙ্কট রমন, যিনি আমাদের কাছে সি ভি রমন নামে বেশি পরিচিত।
১৮৮৮ সালের ৭ নভেম্বর ভেঙ্কট তিরুচিরাপল্লিতে জন্মগ্রহণ করেন। খুব ছোটবেলা থেকেই রমন মেধাবী ছাত্র ছিলেন। বিজ্ঞান তাঁকে সবসময়ই আকর্ষণ করতো। ছোটোবেলায় তার পরিবার বিশাখাপত্তনমে চলে যায়। সেখানকার সেন্ট অ্যালয়সিয়াস অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান হাই স্কুল থেকে মাত্র ১১ বছর বয়সে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় পাস করেন। ১৯০৪ সালে তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজ মাদ্রাজ থেকে বিএ পরীক্ষায় প্রথম স্থান অর্জন করে ‘স্বর্ণপদক’ লাভ করেন। অধ্যাপকরা তাঁর প্রতিভার মূল্যায়ন করতে পেরেছিলেন। তাই তাঁরা রমনকে সবসময় পড়াশোনার জন্য উৎসাহিত করতেন। সি ভি রমনের একটা গবেষণাপত্র লন্ডন-ভিত্তিক ‘দার্শনিক জার্নাল’-এ ১৯০৬ সালের নভেম্বর সংস্করণে প্রকাশিত হয়েছিল। এরপরের বছরই ভালো নম্বর পেয়ে এমএ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন তিনি।
তখন ব্রিটিশ আমল চলছে। সেই সময়ে ভারতে বিজ্ঞান গবেষণার ভাল পরিকাঠামো ছিল না। বৈজ্ঞানিক হিসাবে ক্যারিয়ারের ভবিষ্যৎ ভাল হবে না ভেবে রমন ১৯০৭ সালে ভারতীয় অর্থ বিভাগে যোগদান করেন। কলকাতায় পোস্টিংয়ের পর আবার রমনের মাথায় বিজ্ঞানের ভাবনা ঢুকলো। তখন ভারতের মধ্যে একমাত্র কলকাতাই ছিল বিজ্ঞান চর্চার সেরা ঠিকানা। রমন কলকাতার ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অফ সায়েন্সের (IACS) পরীক্ষাগারে পরীক্ষামূলক গবেষণা চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ পেয়ে গেলেন। তিনি অবসর সময়ে ল্যাবে গবেষণা এবং পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। সেই সময় তাঁর গবেষণার বিষয় ছিল মূলতঃ স্বনবিদ্যা বা শব্দবিজ্ঞান। ভারতীয় বাদ্যযন্ত্রের উপর অনেক মৌলিক কাজ করেছিলেন।
তখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলার ছিলেন বাংলার বাঘ আশুতোষ মুখোপাধ্যায়। পাকা জহুরির যেমন হীরে চিনতে ভুল হয় না তেমনি রমনের প্রতিভা আশুতোষের চোখ এড়ায়নি। তাঁকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক পদে যোগ দিতে অনুরোধ করা হয়। রমন সরকারি চাকরিতে পদত্যাগ করেন। কেন্দ্রীয় সরকারের অনুমতি পাওয়ার পরে ১৯১৭ সালের ২ জুলাই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নেওয়ার পাশাপাশি IACS-এ তাঁর গবেষণা চলতে লাগল। ক্রমশই তিনি পুরোপুরি গবেষণায় ডুবে গেলেন। অবশ্য ভারতবর্ষের নানা জায়গায় পড়ানো ও ল্যাবরেটরি পরিদর্শন, বিভিন্ন সরকারি কমিটিতে অংশগ্রহণ ছাড়াও বিভাগীয় প্রধান হিসাবে তাঁকে অনেক দায়িত্ব পালন করতে হত।
১৯২১ সালে প্রথমবার ইউরোপ যাত্রা করে ফেরার সময় জাহাজ থেকে সমুদ্রের জল দেখে রমণের মনে প্রশ্ন জাগে সমুদ্র নীল কেন? এটা এই লেখার প্রথমেই আলোচনা করা হয়েছে। এরপর থেকে তিনি আলোর গবেষণায় আগ্রহী হয়ে পড়লেন। এর দু’বছর পরে রমণ ও তাঁর সহকারী আলোর বিচ্ছুরণ সংক্রান্ত পরীক্ষানিরীক্ষার সময় এক নতুন রঙের আলোর খুব ক্ষীণ চিহ্ন দেখতে পান। তখন এর উৎস তাঁরা বুঝতে পারেননি। ১৯২৫ সালেও একটা পরীক্ষায় একই ঘটনা ঘটে। এর দু’বছর পরে একটা পরীক্ষায় দেখা যায় গ্লিসারিন থেকে বিচ্ছুরিত সূর্যের আলোর রং হওয়া উচিত নীল, কিন্তু তা হয়েছে সবুজ। রমণের মনে হল তিনি এক বিরাট আবিষ্কারের কাছে চলে এসেছেন। খুব বেশি অপেক্ষা করতে হল না। সেটা ছিল ১৯২৮ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি। সেই দিনের পরীক্ষায় বিচ্ছুরিত আলোয় এক নতুন রঙের আলোর রেখা দেখা গেল, যা আগে কেউ আবিষ্কার করেনি। এর নাম দেওয়া হল ‘রমন এফেক্ট’ বা ‘রমন বিচ্ছুরণ’। কিন্তু রমণ এফেক্ট কেন এত গুরুত্বপূর্ণ যে আবিষ্কারের দু’বছরের মধ্যেই তার উপর দুশোর বেশি গবেষণা পত্র প্রকাশিত হয়েছিল?
কোনো পদার্থের সঙ্গে যখন আলোর ধাক্কা লাগে, তখন আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্যের পরিবর্তন হয়। ধাক্কার পরে তরঙ্গদৈর্ঘ্য বেড়েও যেতে পারে আবার কমেও যেতে পারে। এই কমা-বাড়ার পরিমাণটা খুবই ছোট। এই খুব সামান্য পরিবর্তনটা রামন আবিষ্কার করেছিলেন। কঠিন, তরল বা বাতাস, যেকোনো অবস্থার পদার্থের মধ্যে আলো প্রবেশ করলেই উপরের ব্যাপারটা ঘটে। কোন পদার্থে কী পরিমাণ তরঙ্গদৈর্ঘ্যের পরিবর্তন হবে, তা নির্দিষ্ট। কাচের মধ্যে যে পরিবর্তন হবে, কাঠের মধ্যে পরিবর্তন হবে তার চেয়ে আলাদা। বাতাসে হবে একরকম, জলে আরেক রকম। এই আবিষ্কারটাই ‘রমন এফেক্ট’ নামে পরিচিত। একে কাজে লাগিয়ে যে কোন পদার্থের রাসায়নিক পরিচয় শনাক্ত করা যায়।
‘রমন এফেক্ট’ আবিষ্কারের পরের দিন ২৯ ফেব্রুয়ারি কলকাতার দ্য স্টেটসম্যান খবরের কাগজে এই খবর ছাপা হয়। ৩১ মার্চ নেচার পত্রিকায় তাঁর আবিষ্কার বিষয়ের গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়। এরপর এল সেই সন্ধিক্ষণ। ১৯৩০ সালে, নোবেল কমিটি তাঁকে পদার্থবিদ্যার নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনীত করেন। পুরস্কারের প্রস্তাবক দশজনের মধ্যে ছয় জনই ছিলেন নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী।
আজ থেকে প্রায় একশো বছর আগে না ছিল উন্নত যন্ত্রপাতি না ছিল কম্পিউটার। অথচ সেই সময়ে রমন অনেক মেধা খাটিয়ে এবং সহজ কিছু যন্ত্রপাতির সাহায্যে এই আবিষ্কার করেছিলেন। পরে অনেকবার সি ভি রমন বলেছিলেন যে মাত্র দুই শ’ টাকার যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে তিনি নোবেল পুরস্কার নিয়ে এসেছেন।
(২)
রমন এফেক্ট ব্যবহার করে রাসয়ানিক বা গঠন বিশ্লেষণের সময় নমুনার কোনো ক্ষতি হয় না। তাই এর কার্যকারিতা দিন দিন বেড়েই চলেছে। বর্তমান যুগে লেজার ও আধুনিক যন্ত্রপাতি আসার পরে রমনের আবিষ্কার আরো বিভিন্ন জায়গায় ব্যবহৃত হচ্ছে। রসায়ন শিল্প ও ঔষধ শিল্প থেকে শুরু করে জীববিদ্যা, ইলেকট্রনিক্স ইত্যাদি নানা ক্ষেত্রে এর প্রয়োগ কঠিন কাজকে সহজ করে দিয়েছে।
পদার্থ বিজ্ঞানের খ্যাতি অর্জনকারী প্রতিভাবান এই গবেষক ১৯৭০ সালের ২১ নভেম্বর বেঙ্গালুরুতে ‘রমন এক্সপ্লোরেশন অর্গানাইজেশনে’ তাঁর ল্যাবে কাজ করার সময় হঠাৎ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে পরলোক গমন করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮২ বছর।
১৯৮৬ সালে, জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি যোগাযোগ পরিষদ (NCSTC) ভারত সরকারকে ২৮ ফেব্রুয়ারিকে জাতীয় বিজ্ঞান দিবস হিসেবে মনোনীত করার অনুরোধ জানায়। ২৮ ফেব্রুয়ারি তারিখে জাতীয় বিজ্ঞান দিবস পালনের কারণ ওই বিখ্যাত আবিষ্কার রমন এফেক্ট। ১৯২৮ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি তারিখে এই বিখ্যাত আবিষ্কার হয়। তাই সি ভি রমনকে সম্মান জানাতে জাতীয় বিজ্ঞান দিবস হিসেবে ঐ দিনটি বেছে নেওয়া হয়। প্রতি বছর আলাদা আলাদা ভাবনা (Theme) নিয়ে পালন করা হয় এই দিনটি। এই বছর ২০২৫-এর ভাবনা হল, ‘বিকশিত ভারতের জন্য বিজ্ঞান ও উদ্ভাবনে বিশ্বব্যাপী নেতৃত্বের জন্য ভারতীয় যুবদের ক্ষমতায়ন’। ভারতকে উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য তরুণ মনকে জ্ঞান ও দক্ষতায় সজ্জিত করার গুরুত্ব তুলে ধরা হবে এখানে।