প্রবীর মজুমদার
তৃণমূল কংগ্রেসের ১৫ বছরের শাসনকালে অনেক নেতার বা পার্টি ঘনিষ্ঠদের দ্বারা গায়ের জোরে সম্পত্তি-বাড়ি-জমি হাতিয়ে নেওয়া থেকে শুরু করে, নানা স্তরে দুর্নীতি, মানুষকে হুমকি থেকে প্রায় প্রকাশ্যে ধর্ষণ, তাও কলকাতার সরকারি কলেজে—এসবই চলছে ও মানুষ দেখছে। কিন্তু এসবের পরও আর আট মাস পরের পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনে মানুষ আবার জমিয়ে তৃণমূল কংগ্রেসকে ভোট দেবেন এবং তারা জিতবে। শুধু জিতবেই না, হয়তো অতীতের চেয়ে বেশি আসন পেয়ে জিতবে। এর কারণ কী? এর প্রধান কারণ কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টির রাজনীতি। বিজেপি এমন এক নীতি ভারতজুড়ে নিয়েছে, যার ফলে অনেক জায়গায় মাথাচাড়া দিচ্ছে আঞ্চলিক জাতিভিত্তিক জাতীয়তাবাদ।
Advertisement
একদিকে বিজেপি দৈনন্দিন জীবনে কার্যত অবলুপ্ত সংস্কৃত ভাষার প্রসারে গত ১০ বছরে অন্যান্য সব ভাষার তুলনায় সর্বোচ্চ বাজেট বরাদ্দ করেছে এবং অন্যদিকে হিন্দি ভাষার প্রচার ও প্রসার পূর্ণ উদ্যমে চালিয়ে যাচ্ছে। এটা দক্ষিণ ভারতের রাজ্যগুলোর পাশাপাশি এখন পশ্চিম বা পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলোর পক্ষেও মানা সম্ভব হচ্ছে না। এর ফলে আঞ্চলিক জাতীয়তাবাদ অর্থাৎ তামিল, মারাঠি, কন্নড় প্রভৃতি থেকে বাঙালি জাতীয়তাবাদ মাথাচাড়া দিচ্ছে। এ কারণে পশ্চিমবঙ্গসহ একাধিক রাজ্যে বিজেপির সমস্যা বাড়বে।
Advertisement
বিজেপির যুক্তি হতে পারে, হিন্দিভাষী যেসব রাজ্যে তাদের প্রভাব বেশি, সেখানে তাদের নিয়ন্ত্রণ এর ফলে আরও দৃঢ় হবে। এসব হিন্দিভাষী রাজ্যের মধ্যে প্রধান, যেমন উত্তর ভারতের উত্তর প্রদেশ, পূর্ব ভারতের বিহার ও ঝাড়খন্ড এবং মধ্যপ্রদেশে ভবিষ্যতে লোকসভা আসনের সংখ্যা অপেক্ষাকৃতভাবে বাড়বে। কারণ, এসব রাজ্যে জনসংখ্যার হার দক্ষিণ বা পূর্ব ভারতের থেকে বেশি—তুলনামূলক অনুন্নয়নের কারণে। ফলে তাদের লোকসভা আসনের সংখ্যাও আগামী দিনে বাড়বে। এতে লাভ বিজেপির। আরও একটা কারণে হিন্দুত্ববাদী সংগঠন উত্তর ভারতের রামনবমী বা হনূমান জয়ন্তীর মত নির্দিষ্ট ধরনের হিন্দু সংস্কৃতি ও হিন্দি ভাষার প্রচার–প্রসার ঘটাতে চাইছে অ-হিন্দিভাষী রাজ্যগুলোতে।
উত্তর প্রদেশ, বিহার বা ঝাড়খন্ডের অনুন্নয়ন, দারিদ্র্য ও জনসংখ্যার কারণে সেখান থেকে হিন্দিভাষী শ্রমিক বিরাট সংখ্যায় অ-হিন্দিভাষী ও অর্থনৈতিকভাবে উন্নত রাজ্যে কাজ করতে যান। এভাবে সেই রাজ্যের জনবিন্যাস তারা ধীরে ধীরে পাল্টে দিচ্ছে। যেমন পশ্চিমবঙ্গে অবাঙালি ভোট বাড়ছে। বিজেপি জানে, এই হিন্দিভাষী ভোট তাদের।
এভাবেই একদিকে উত্তর ও মধ্য ভারতের নিজেদের ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করে এবং অন্যদিকে অ-হিন্দি রাজ্যে জনবিন্যাসের পরিবর্তন ঘটিয়ে ভবিষ্যতে টিকে থাকতে চাইছে বিজেপি। এই লক্ষ্যে উত্তর ভারতীয় হিন্দু সংস্কৃতি ও হিন্দি ভাষার প্রচার ও প্রসার ঘটাতে চাইছে দক্ষিণ বা পূর্ব ভারতে। এর প্রতিক্রিয়ায় জোরালো হচ্ছে আঞ্চলিক জাতীয়তাবাদ।
উত্তর ভারতীয় হিন্দুত্ব ও হিন্দি ভাষাকেন্দ্রিক জাতীয়তাবাদের যে প্রসার বিজেপি শুরু করেছে, তার জেরে একাধিক রাজ্যে বিপরীতমুখী আঞ্চলিক শক্তি ভবিষ্যতের কথা মাথায় রেখে একজোট হচ্ছে। যেমন দীর্ঘ কয়েক দশকের বিবাদ ভুলে মহারাষ্ট্রে জুলাই মাসে একজোট হয়েছেন বিশ শতকে মারাঠি জাতীয়তাবাদের প্রধান প্রবক্তা বালাসাহেব ঠাকরের ছেলে উদ্ধব ঠাকরে ও ভাইপো রাজ ঠাকরে। তাঁরা দুজনই একসময় মুখ্যমন্ত্রী হতে চাইতেন। সে কারণে নব্য হিন্দু জাতীয়তাবাদের উত্থানের সময় দুই ভাই বিজেপির ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টায় পরস্পরের শত্রু হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু এখন দেখছেন, হিন্দি-হিন্দুভিত্তিক জাতীয়তাবাদ মহারাষ্ট্রে তাঁদের জাতিভিত্তিক জনভিত্তি ধ্বংস করে দিচ্ছে। তাঁরা এক হয়ে গেছেন। তামিলনাড়ুতেও হিন্দি ভাষার বিরুদ্ধে বড় ধরনের আন্দোলন শুরু হয়েছে। একই বিষয় লক্ষ্য করা যাচ্ছে কর্ণাটকে, যেখানে কন্নড় জাতীয়তাবাদীরা সর্বভারতীয় সরকারি ব্যাংকগুলোর কর্মচারীদের আঞ্চলিক এবং স্থানীয় ভাষায় কথা বলার দাবি তুলেছেন। এ রকমটা ঘটছে দক্ষিণ ভারতের অন্যান্য রাজ্যসহ আরও একাধিক রাজ্যে।
পশ্চিমবঙ্গের অভিজ্ঞ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এটা বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কারণ নেই যে উত্তর ভারতীয় হিন্দুত্ব ও ভাষার পূর্ব ভারতে প্রচার তাঁর জন্য কি বিশাল সুযোগ, বিশেষত ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকার পর যখন প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার হাওয়া তাঁর বিরুদ্ধে। বিষয়টি ২০১৯ সালে লোকসভা নির্বাচনে বিপর্যয়ের পরই সম্ভবত লক্ষ করেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তখন থেকেই শুরু হয় ‘বাঙালি বনাম বহিরাগত’ স্লোগান দিয়ে প্রচার। অর্থাৎ একদিকে যখন বিজেপি ‘হিন্দু বনাম মুসলমান’ লাইনে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ ঘটাতে চাইছে, তখন ‘বাঙালি বনাম বহিরাগত’ লাইনে মেরুকরণ ঘটিয়ে নিজেদের অবস্থান মজবুত করেছে তৃণমূল কংগ্রেস। বহিরাগত বলতে এখানে মূলত বিহার ও উত্তর প্রদেশ থেকে আসা হিন্দিভাষী শ্রমিক এবং রাজস্থান থেকে আসা ব্যবসায়ীদের বোঝানো হচ্ছে। তৃণমূল কংগ্রেস নিষ্ঠার সঙ্গে বিজেপিকে হিন্দিভাষী এই সমাজের প্রতিনিধি হিসেবে বাংলায় তুলে ধরেছে।
ইতিমধ্যে আসাম ও পশ্চিমবঙ্গে ভারতীয় বাঙালিদের ‘বাংলাদেশি’ বলে চিহ্নিত করে বাংলাদেশে পাঠানো এবং তারপর ফেরত নেওয়া থেকে বিভিন্ন রাজ্যে বাঙালি শ্রমিকদের ওপরে হামলা, বিশেষত বাংলাদেশে গত বছরের অভ্যুত্থানের পরে তৃণমূল কংগ্রেসের বাড়তি সুবিধা করে দিয়েছে।
এর ফলে তৃণমূলের ওপরে অনেক ক্ষেত্রে অসন্তুষ্ট মুসলমান সমাজের একাংশ ইচ্ছা থাকলেও কংগ্রেস বা কমিউনিস্টদের ভোট দিতে ভয় পাচ্ছে। তারা ভাবছে, তাদের ভোট সিপিআইএম বা কংগ্রেসে গেলে সুবিধা হবে বিজেপির। মনে রাখা প্রয়োজন, পশ্চিমবঙ্গে এক-তৃতীয়াংশ ভোট সংখ্যালঘু মুসলমানের। অন্যদিকে হিন্দুদের মধ্যেও একটা বড় অংশ রয়েছে, যাঁরা তৃণমূলের কাজে তিতিবিরক্ত; কিন্তু তা সত্ত্বেও তাঁরা কোনো দিনই বিজেপিকে ভোট দিতে পারবেন না।
তাঁরা ভয় পাবেন, কারণ পশ্চিমবঙ্গের অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ ইতিমধ্যে প্রায় সম্পূর্ণভাবে চলে গেছে অবাঙালিদের হাতে, এখন যদি বিজেপির কল্যাণে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণও চলে যায়, তবে পশ্চিমবঙ্গের বাঙালির হাতে আর কী রইল? এটাই আঞ্চলিক জাতীয়তাবাদ—এই তাস খেলেই আগামী বছরে জিতবে তৃণমূল কংগ্রেস।
বিজেপির এই উত্তর ভারতীয় হিন্দু-হিন্দিভিত্তিক জাতীয়তাবাদী রাজনীতির কারণে বাংলায় ক্রমে জনপ্রিয়তা বাড়ছে বিভিন্ন বাঙালি জাতীয়তাবাদী সংগঠনের। তাদের প্রধান ‘বাংলা পক্ষ’। তাদের জনপ্রিয়তা ভালো রকম বেড়েছে গত কয়েক বছরে, জেলায় জেলায় তৈরি হয়েছে তাদের অফিস। এটাই প্রমাণ করছে, পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি ভারত রাষ্ট্রে তার অবস্থান সম্পর্কে উদ্বিগ্ন। সে কারণেই সামাজিক স্তরে তারা জোটবদ্ধ হওয়ার চেষ্টা করছে। প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার হাওয়া সামলে রাজনৈতিকভাবে পশ্চিমবঙ্গে এর ইতিবাচক ফল পাবে একমাত্র তৃণমূল কংগ্রেস। আগামী নির্বাচনে তাদের জয়ও তাই একপ্রকার নিশ্চিত। বিজেপিই কার্যত তা নিশ্চিত করেছে।
Advertisement



