• facebook
  • twitter
Friday, 5 December, 2025

গণতন্ত্র ধ্বংসের বিল

১৩০তম সংবিধান সংশোধন বিল, কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলের সরকার (সংশোধনী) বিল, জম্মু ও কাশ্মীর পুনর্গঠন (সংশোধনী) বিল নামে তিনটি সংশোধনীরই লক্ষ্য এক।

প্রতিনিধিত্বমূলক চিত্র

বিভিন্ন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ও মন্ত্রীদের সরানোর ক্ষমতা হাতে রাখতে চাইছে কেন্দ্র। এই লক্ষ্যে ১৩০তম সংবিধান সংশোধন বিল সহ মোট তিনটি সংশোধনী বিল লোকসভায় পেশ করেছিলেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। বিরোধীদের তুমুল বিক্ষোভের পর অবশ্য তিনটি বিলই যৌথ সংসদীয় কমিটির কাছে পাঠাতে বাধ্য হয় কেন্দ্র। তিনটি বিলেরই মোদ্দা কথা— কোনও গুরুতর অপরাধে প্রধানমন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রী, কেন্দ্র বা রাজ্যের মন্ত্রীরা গ্রেপ্তার হয়ে ৩০ দিনের বেশি জেলে থাকলে তিনি যদি পদত্যাগ না করেন, তাহলে ৩০তম দিনে তাঁর ওই পদ খারিজ হয়ে যাবে। অর্থাৎ আদালতের বিচার প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাওয়া নয়, তার আগেই শুধু অভিযোগের ভিত্তিতেই কোনও নির্বাচিত সরকারের মুখ্যমন্ত্রী বা মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষমতা হাতে নিতে চাইছে কেন্দ্র। গত এক দশকে মোদী সরকার যেভাবে বিরোধী দলের সরকারগুলিকে ভাঙার চেষ্টা করেছে, সেই নিরিখেই বিষয়টিকে গুরুতর বলছেন বিশ্লেষকরা।

১৩০তম সংবিধান সংশোধন বিল, কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলের সরকার (সংশোধনী) বিল, জম্মু ও কাশ্মীর পুনর্গঠন (সংশোধনী) বিল নামে তিনটি সংশোধনীরই লক্ষ্য এক। কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল এবং জম্মু-কাশ্মীরেও যাতে এই নিয়ম কার্যকরী হয়, সেটা নিশ্চিত করতেই পদ্ধতিগত কারণে তিনটি পৃথক বিল পেশ করা হয়। উল্লেখ্য, এর আগে দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়ালকে গ্রেপ্তার করে ছয় মাস জেলে আটকে রাখা হয়। কিন্তু তিনি ইস্তফা দেননি। একইভাবে তামিলনাড়ুর মন্ত্রী সেন্থিল বালাজীকেও গ্রেপ্তার করে দীর্ঘসময় জেলবন্দি করা হয়। অন্যদিকে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হবে বুঝতে পেরেই ইস্তফা দিয়েছিলেন ঝাড়খণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত সোরেন।

Advertisement

তারপরই তাঁকে গ্রেপ্তার করে জেলে আটকে রাখা হয় গত লোকসভা ভোটের আগে। ভোটের ফলপ্রকাশের পরই তিনি জামিন পেয়ে যান। ইডি, সিবিআই এবং অন্য কেন্দ্রীয় সংস্থাকে ব্যবহার করেই বিরোধী দলের দুই মুখ্যমন্ত্রীকে গ্রেপ্তার করে মোদী সরকার। কিন্তু কেজরিওয়ালকে গ্রেপ্তারের পরেও ইস্তফা না দেওয়া এবং সেক্ষেত্রে মোদী-শাহরা কিছু করতে না পারার পরেই এই ভাবনা শুরু হয়। এছাড়াও অন্যান্য রাজ্যের আরও মুখ্যমন্ত্রী ও প্রভাবশালী মন্ত্রীরাও বিজেপির নজরে রয়েছেন। কর্ণাটকে কংগ্রেস সরকার ভাঙার জন্য সেখানের উপমুখ্যমন্ত্রী ডিকে শিবকুমারের বিরুদ্ধেও কেন্দ্রীয় এজেন্সিগুলিকে লাগিয়ে রেখেছে সরকার। তবে সুপ্রিম কোর্টের রায় এখনও পর্যন্ত শিবকুমারের পক্ষে যাওয়ায় কিছু করতে পারছে না মোদী সরকার। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এই পদক্ষেপের লক্ষ্য শুধু বিরোধীরাই নয়, বিভিন্ন রাজ্যে বিজেপির সহযোগী দলের নেতাদেরও চাপে রাখতে চায় মোদী-শাহ সরকার।

Advertisement

সংবিধান সংশোধন বিল আসলে বিরোধীদের বিরুদ্ধে কাজে লাগানোর হাতিয়ার। এটি কোনওভাবেই জনস্বার্থ রক্ষা ও সুশাসনের বিল নয়। বরং এটি বিরোধী-শাসিত রাজ্যগুলিকে অস্থিতিশীল করা ও ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো ভাঙার হাতিয়ার। ‘সাংবিধানিক নৈতিকতা’র নামে প্রতিহিংসামূলক রাজনীতির বৈধতা দেওয়া হয়েছে। সংবিধান অনুযায়ী সমানাধিকারের অধিকার, মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও ব্যক্তিস্বাধীনতার নিশ্চয়তা যেখানে স্বীকৃত, সেগুলি লঙ্ঘিত হচ্ছে এই বিলে। এই সংশোধনী বিলটি চারটি ক্ষেত্রে বিশেষভাবে আপত্তিকর। এক, নির্দোষ ধরে নেওয়ার নীতি লঙ্ঘন— গ্রেপ্তার মানেই পদচ্যুতি, দোষী সাব্যস্ত নয়। দ্বিতীয় আপত্তির জায়গা হলো, এটি ক্ষমতার বিভাজনের ধারণাকেই ভেঙে দিচ্ছে। বিচারবিভাগ ও সংসদকে এড়িয়ে নির্বাহীকে অতি-ক্ষমতা দেওয়া হচ্ছে। তিন, ন্যায়সঙ্গত প্রক্রিয়ার অস্বীকার—বিচার, চার্জশিট বা আদালতের রায় ছাড়াই শাস্তি। চতুর্থ আপত্তি হলো এই আইনে রাজনৈতিক অপব্যবহারের ব্যাপক সুযোগ থাকছে। কেন্দ্রীয় এজেন্সির মাধ্যমে বিরোধীদের টার্গেট করার সাংবিধানিক বৈধতা দেওয়া হচ্ছে। এই বিল প্রকৃতপক্ষে সংবিধান ও গণতন্ত্রের ওপর নজিরবিহীন আক্রমণ। বিরোধীদের বিরুদ্ধে সাংবিধানিকভাবে প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে চাইছে মোদী সরকার।

Advertisement