স্বপনকুমার মণ্ডল
সাহিত্যে ‘বুকার প্রাইজ’ বিশ্বনন্দিত। সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারের মতোই তার গরিমা। ইংরেজি ভাষায় বা ইংরেজিতে অনূদিত কথাসাহিত্যের তীব্র প্রতিযোগিতায় সে বছরের শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপা স্বাভাবিক ভাবেই আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির আলোয় তার দিগন্তবিস্তারী প্রভাবে সাহিত্যিক ও তাঁর সাহিত্যের আবেদনকে তীব্র জনপ্রিয়তা লাভ করে। শুধু তাই নয়, পুরস্কারপ্রাপ্ত সাহিত্যিকের ভাষা ও স্বদেশকেও তা মহিমান্বিত করে। সেদিক থেকে এ বছর ২০ মে কন্নড় ভাষার কথাসাহিত্যিক বানু মুশতাকের ‘বুকার প্রাইজ’ লাভে যেমন কন্নড় ভাষার সম্মান বৃদ্ধি করেছে, তেমনই দেশের গৌরবও শ্রীবৃদ্ধি ঘটিয়েছে। ইতিপূর্বে দেশের ইংরেজি ভাষার কথাসাহিত্যিকদের মধ্যে অনেকেই এই পুরস্কার পেয়েছেন। ভি এস নইপাল, সালমান রুশদি, অরন্ধতী রায়, কিরণ দেশাই, অরবিন্দ আদিগা প্রমুখ। আবার গীতাঞ্জলী শ্রীর মতো হিন্দি কথাসাহিত্যিক ইংরেজিতে অনুবাদের মাধ্যমেও বুকার প্রাইজ পেয়েছেন। সেদিক থেকে কর্ণাটকের হাসানের কৃতী সন্তান তথা গল্পকার বানু মুশতাকের ইংরেজিতে অনূদিত ছোটগল্প সংকলন ‘Heart Lamp : Selected stories’(১৯২৪) বাছাই করা ১৫৪টি বইয়ের মধ্যে থেকে ২০২৫-এ মহার্ঘ ও অভিজাত আন্তর্জাতিক সাহিত্য পুরস্কার বুকার প্রাইজ লাভ করে। সেক্ষেত্রে তাঁর সাহিত্যিক স্বীকৃতির আবেদনে ব্যতিক্রমী অসাধারণত্ব প্রচারের আলো সেভাবে না পেলেও তার অনন্য পরিচয়ই এক্ষেত্রে অপরিহার্য হয়ে ওঠে। উল্লেখ্য, বানু মুশতাকের কোনও স্বতন্ত্র ছোটগল্পের বইয়ের অনুবাদ ‘Heart Lamp : Selected stories’ নয়। এটি তাঁর ১৯৯০ থেকে ২০২৩-এর মধ্যে প্রকাশিত গল্প থেকে বাছাই করা ইংরেজিতে অনূদিত বারোটি গল্পের সংকলন। গল্পগুলির অনুবাদক দীপা ভাস্তির অনন্যসাধারণ অনুবাদকেও স্বীকৃতি স্বরূপ তাঁকে বানু মুশতাকের সঙ্গে যৌথভাবে বুকার প্রাইজ প্রদান করা হয়েছে। অন্যদিকে দীপা ভাস্তির অনুবাদের মাধ্যমে বানু মুশতাকের বুকার প্রাইজ প্রাপ্তি শুধু গল্পকার বা অনুবাদকের শ্রেষ্ঠত্বের স্বীকৃতিই শুধু প্রতিফলিত হয়নি, সেইসঙ্গে সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠায় বিশেষ করে নানাভাবে শোষিত-শাসিত নারীদের অনাবৃত জীবনের কথা প্রচারের আলোর স্বার্থেও তা জরুরি ছিল। বৈষম্যপীড়িত সমাজে ধর্মীয় শাসন-অনুশাসনে বন্দি জীবনে বিপন্ন মানবতার অব্যক্ত যন্ত্রণার কথা জনমানসে নিবিড় করে তুলে ধরার ক্ষেত্রে বানু মুশতাকের বুকার প্রাইজ অত্যন্ত জরুরি মনে হয়। এজন্য ২০ মে লন্ডনের টেট মডার্ণ গ্যালারিতে পুরস্কারপ্রাপ্তির মঞ্চে তাঁর প্রতিক্রিয়ার তিনি গল্পকার হিসেবে নয়, শোষিত-শাসিত মানুষের সমবেত কণ্ঠস্বরের জয় হিসেবে তাঁর সাফল্যকে দেখার কথা দ্বিধাহীন ভাবে তুলে ধরেছেন। তাঁর কথায় : ‘মহান এ সম্মান আমি কোনও ব্যক্তি হিসেবে গ্রহণ করছি না, বরং এমন এক কণ্ঠস্বর হিসেবে গ্রহণ করছি, যা আরও বহু কণ্ঠের সঙ্গে সমবেত ভাবে উচ্চারিত হয়েছে।’ সেক্ষেত্রে বুকার প্রাইজের মতো আন্তর্জাতিক পুরস্কারের লাভে বানু মুশতাকের লক্ষ্যপূরণের কথাও প্রকট হয়ে উঠেছে। শুধু তাই নয়, সেকথা প্রকাশে তাঁর লক্ষ্যভেদী অর্জুনের সাফল্যের উচ্ছ্বাসও গোপন থাকেনি। অন্তরালে চাপা পড়া অশ্রুত থেকে যাওয়া জীবনযন্ত্রণার অব্যক্ত কথা প্রচারের আলোতে আসার কথাই আবেগমথিত অথচ প্রত্যয়সিদ্ধ ভাবে তাঁর মুখে উঠে এসেছে, ‘এটি কেবল আমার জয় নয়, বরং এমন কণ্ঠস্বরের সমবেত কণ্ঠস্বর যা ক্রমশই শোনা যায় না।’ সেই উপেক্ষিত কণ্ঠস্বরকে প্রচারের আলোতে আনাটা জরুরি ছিল। সেদিক থেকে সমাজ-ধর্ম, রাজনীতি-অর্থনীতি প্রভৃতিতে বৈষম্যের শিকার বিপন্ন প্রান্তিক মানুষের মুখপাত্র হিসেবে বানু মুশতাকের প্রতিবাদী কণ্ঠস্বরকে জনমানসে নিবিড় করে তুলে ধরার ক্ষেত্রে তাঁর বুকার প্রাইজটি আপনাতেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।
আসলে বানু মুশতাকের সাহিত্যচর্চা সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকেই সক্রিয় হয়ে ওঠে। তাঁর সাহিত্যজীবনের নেপথ্যেও একজন দায়বদ্ধ সাহিত্যিকের পরিসর ক্রমশ বিস্তার লাভ করে। সেক্ষেত্রে বাস্তব জীবনের তিক্ত অভিজ্ঞতাই তাঁকে অনেক বেশি পরিণতমুখী করে তোলে। সাহিত্যজীবনের সূচনা থেকেই তিনি বিভিন্ন প্রতিবাদী আন্দোলন থেকে অনুপ্রেরণা লাভ করেন। দলিত আন্দোলন, কৃষক আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন, নারী সংগ্রাম ও পরিবেশগত আন্দোলন ক্রমশ তাঁকে প্রাণিত করেছে। শুধু তাই নয়, সাত-আট দশকের কর্ণাটকের বান্দোয়া সাহিত্য আন্দোলনে আশির দশক থেকে তিনি সক্রিয় ভাবে জড়িয়ে পড়েন। সামাজিক ও অর্থনৈতিক ভাবে অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে ১৯৭৪-এ গড়ে তোলা সামাজিক ভাবে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ প্রগতিশীল সাহিত্য আন্দোলন হিসেবে বান্দোয়া সাহিত্য আন্দোলন বানু মুশতাককে প্রতিবাদী সাহিত্যে সক্রিয় করে রেখেছে। বিশেষ করে সামাজিক ও অর্থনৈতিক ন্যায়বিচারের লক্ষ্যে মুসলিম ও দলিতসহ প্রান্তিক মানুষের কণ্ঠস্বর তুলে ধরার ক্ষেত্রে তাঁকে বান্দোয়া সাহিত্য আন্দোলন দিশা দেখিয়েছে। অন্যদিকে বানু মুশতাক সাংবাদিক হিসেবেও শোষিত-শাসিত প্রান্তিক মানুষের সঙ্গে নিবিড় সংযোগে এসেছিলেন। ১৯৮১ থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত প্রখ্যাত ধর্মনিরপেক্ষ প্রতিবাদী সাংবাদিক যাঁকে ২০১৭-তে ধর্মীয় মৌলবাদীরা নৃশংসভাবে হত্যা করেছিল সেই গৌরী লঙ্কেশের বাবা পি লঙ্কেশ সম্পাদিত ট্যাবলয়েড ‘লঙ্কেশ পত্রিকে’র নিয়মিত প্রতিবেদন লিখেছেন তিনি। সাংবাদিকতার ছেড়ে দিলেও তাঁর সঙ্গে সমাজের বিভিন্ন ভাবে অন্যায়-অবিচারের শিকারে পর্যুদস্ত মানুষের সঙ্গে তাঁর সহচর জীবন থেমে থাকেনি। ১৯৯০ থেকে বানু মুশতাক আইনজীবীর পেশাকে বেছে নিলেও অচিরেই তাঁর মানবাধিকার কর্মী থেকে সমাজকর্মী হিসেবে জনসংযোগ আরও নিবিড়তা লাভ করে। সেক্ষেত্রে তাঁর সাহিত্যচর্চাও তাঁর প্রতিবাদী সত্তারই শিল্পিত রূপ ও রূপান্তর। নিজেও সেকথা তিনি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে দ্বিধাহীন চিত্তে প্রকাশ করেছেন। বুকার প্রাইজ পাওয়ার পর বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে সেকথা ঘুরে ফিরে এসেছে। বানু মুশতাক নিজেই জানিয়েছেন : ‘প্রান্তিক সম্প্রদায়, নারী এবং অবহেলিতদের জীবনের সঙ্গে আমার সরাসরি সম্পৃক্ততা, তাদের অভিব্যক্তিসহ আমাকে লেখার শক্তি দিয়েছে। সামগ্রিকভাবে কর্ণাটকের সামাজিক পরিস্থিতি আমাকে গঠন করেছে।’ আর তারই ফসল তাঁর প্রতিরোধী সাহিত্যচর্চার নিবিড় আয়োজন। ইতিমধ্যে তাঁর ছয়টি ছোটগল্প সংকলন, একটি উপন্যাস, একটি প্রবন্ধ সংকলন এবং একটি কবিতা সংকলন প্রকাশিত হয়েছে। সাহিত্যের প্রায় সব শাখায় বিচরণ করলেও ছোটগল্পের প্রতি তাঁর সবিশেষ পক্ষপাতিত্ব বর্তমান। ‘Outlook’ পত্রিকায় (২১ মার্চ ২০২৫)-এর সাক্ষাৎকারে বানু মুশতাক বলেছেন, ‘ছোটগল্প আমার প্রথম ভালোবাসা।’ তাঁর গল্পগুলি ইংরেজি ছাড়াও তামিল, মালয়ালাম, পাঞ্জাবী ও উর্দুতেও অনূদিত হয়েছে। সেক্ষেত্রে তাঁর ছোটগল্পে প্রান্তিক মানুষের অন্ত্যজ জীবনের প্রতিরোধী কণ্ঠস্বরকে সজোরে প্রচারের আলোতে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য বুকার প্রাইজের আন্তর্জাতিক আলোর গুরুত্ব অপরিসীম। সেকথা বানু মুশতাকের প্রতিক্রিয়াতেই প্রতীয়মান।
সাহিত্যে সময়ের অনুবাদে ছোটগল্পের জুড়ি নেই। দ্রুততার সঙ্গে তার অনুবাদিত রূপ আবির্ভাবের আস্বাদ বয়ে আনে। অন্যদিকে তার আধুনিক যুগের যুগযন্ত্রণা প্রকাশের তীব্র একাঘ্নী বাণ জনমানসে লক্ষ্যভেদী হয়ে ওঠে। সেদিক থেকে বানু মুশতাকের ছোটগল্পে প্রান্তিক মানুষের আকাঁড়া জীবনযন্ত্রণার পরিচয় নিবিড়তা লাভ করায় তার আবেদন বিস্তারের অপেক্ষায় মুখিয়ে ওঠে। বিশেষ করে গল্পকার নিজেও একজন প্রান্তিক মুসলিম সম্প্রদায়ের নারী। তাঁর তিক্ত জীবনের অভিজ্ঞতাই তাঁকে সেবিষয়ে অভিজ্ঞ করে তুলেছে। অন্যদিকে তাঁর সাহিত্যজীবনের সূচনা থেকেই তাঁর ছোটগল্পের চর্চা শুরু হয়। মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পড়ার সময় তিনি প্রথম ছোটগল্প লেখেন। ২৬ বছর বয়সে তাঁর একটি গল্প জনপ্রিয় কন্নড় ম্যাগাজিন ‘প্রজামাতা’তে প্রকাশিত হলে স্বাভাবিক ভাবেই সাড়া ফেলে দেয়। নব্বইয়ের দশকেই বানু মুশতাকের নিবিড় সাহিত্যচর্চার মধ্যে ছোটগল্পই যে প্রাধান্য লাভ করে, তা তাঁর প্রকাশিত রচনাতেই প্রতীয়মান। তাঁর ছয়টি গল্প থেকেই ১২টি গল্পের অনুবাদ সংকলন ‘Heart Lamp : Selected stories’।
শুধু তাই নয়, ২০২৪-এ তাঁর পাঁচটি ছোটগল্পের দীপা ভাস্তি কৃত অনুবাদ সংকলন ‘Haseena and Other Stories’ পেন ইংলিশ অনুবাদ পুরস্কার লাভ করে। পুরস্কারটি একটি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন থেকে প্রদান করা হয়। ২০২৪-এর অনুবাদের সাফল্যেই যে ২০২৫-এর পুরস্কৃত গল্প-সংকলনের নেপথ্যে সক্রিয় ছিল, তা সহজেই অনুমেয়।
প্রসঙ্গত, দুটি গল্প-সংকলনের মধ্যেই বৈষম্যপীড়িত পুরুষশাসিত সমাজে নারীদের দুর্বিষহ জীবনের কথা প্রকট হয়ে উঠেছে। অন্যদিক একাধিক গল্পও দুটি সংকলনে বর্তমান। যেমন, ‘Be a woman once, oh Lord’ ও ‘Red Lungi’ গল্পদুটি উভয় সংকলনে বর্তমান। আসলে বানু মুশতাকের ছোটগল্প তাঁর প্রতিবাদের বড় হাতিয়ার হয়ে ওঠে। সেখানে তাঁর লক্ষ্যভেদী আয়োজন ক্রমশ নিবিড়তা লাভ করে এবং প্রভাবশালী হয়ে ওঠে। সেক্ষেত্রে তাঁর লেখকসত্তাই প্রান্তিক নারীদের কণ্ঠস্বর হয়ে ওঠায় স্বাভাবিকভাবেই তা রক্ষণশীল ধর্মীয় পুরুষশাসিত সমাজের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের মূর্ত প্রতীক হয়ে ওঠে। এজন্য তাঁর লেখকজীবনেই তীব্র আঘাত নেমে আসে। বানু মুশতাককে তাঁর ছোটগল্প সংকলন ‘বেনকি মালে’(১৯৯৯) প্রকাশের পর মুসলিম সম্প্রদায়ের নেতাদের থেকে তাঁকে হিংস্র আক্রমণের শিকার হতে হয়েছে। প্রসঙ্গত, ১৯৯৯-এ তিনি ছোটগল্প সংকলনটির জন্য কর্ণাটক রাজ্য সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন। সেক্ষেত্রে তাঁর পরিচিতির আলোয় তাঁর সাহিত্যও চর্চার অবকাশ পেয়ে যায়। সেক্ষেত্রে একজন নারী হয়ে ‘প্রকাশ্যে উচিত কথা’ বলার জন্য তাঁকে তাঁরই সম্প্রদায়ের কাছে থেকে তীব্র সমালোচনা থেকে সমাজচ্যুত হওয়ার মতো তিক্ত অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। শুধু তাই নয়, হুমকি ধামকির পরে একজন ছুরিধারী হামলাকারী তাঁকে ব্যক্তিগত ভাবে প্রাণঘাতী আক্রমণ করেছিল। শুধু তাই নয়, পরবর্তীতে ধর্মীয় বিধিনিষেধের বিরদ্ধে তাঁর সাক্ষাৎকার পত্রিকায় প্রকাশিৎ হলে তাঁকে নিজের সম্প্রদায়ের কাছে থেকেই নানাভাবে শিকার হতে হয়েছে। তিন মাস ধরে তাঁর পরিবারকে তাঁর সম্প্রদায়ের ধর্মীয় নিষেধাজ্ঞা ছিল। পরে সেসব মিটিয়ে নেওয়ার পর রেহায় মেলে। অন্যদিকে ১৯৯৯-এর আকস্মিক ঘটনার পর বানু মুশতাকের লেখনী সাময়িক ভাবে থেমে গিয়েছিল। ধর্মীয় রক্ষণশীলতা ও পুরুষশাসিত সমাজের বিরুদ্ধে তাঁর লেখনী সাময়িক বিরতি কাটিয়ে আবার ঘুরে দাঁড়ানোয় সক্রিয় হয়ে ওঠে। ক্ষমতার অপব্যবহারকারীদের বিরুদ্ধে থেকে ধর্ম ও রাজনীতিকে মেশানো নেতাদের বিরোধিতা করে, অধিকারবঞ্চিত নারীদের আত্মশক্তি জাগরণের জন্য বানু মুশতাক পুনরায় স্বমূর্তি ধারণ করেন। আসলে তাঁর মধ্যে যে প্রতিবাদী সত্তা ছিল, তাই তাঁকে নাছোড় সমাজবিপ্লবী সাহিত্যিক গড়ে তুলেছে। ১৯৭৪-এ ছাব্বিশ বছর বয়সে তাঁর প্রেম করে বিয়ে হলেও ধর্মীয় বিধিনিষেধে অবরোধবাসিনী হয়ে না থাকার জন্য পারিবারিক জীবনেও তাঁর বিষাদ নেমে আসে। সেখানে সাহিত্যচর্চা না করে সংসারধর্ম পালন করার প্রতি তীব্র অনীহা তাঁকে আত্মহত্যাতেও সক্রিয় করে তোলে। সেক্ষেত্রে তাঁর স্বামীর সম্মতিই তাঁকে আত্মহত্যা থেকে বিরত করে। ব্যক্তিগত জীবনে সেই আত্মহত্যার ঘটনাটি তাঁর ‘Heart Lamp’ গল্পটির আধার। অন্যদিকে ১৯৭৭-এ ঊনত্রিশ বছর বয়সের সন্তানের মা হওয়ার পর মানসিক অবসাদ কাটিয়ে ওঠার জন্য তাঁকে লেখালেখির আশ্রয় নিতে হয়েছে। সেদিক থেকে মুশতাকের গল্প আসলে নারীজীবনের নগ্ন বাস্তবতার আধারে স্বাধিকার অর্জনের বলিষ্ট কণ্ঠস্বর।
একথা অনস্বীকার্য, ছোটগল্পেই অতিদ্রুততায় সময়ের অনুবাদ উঠে আসে। সেক্ষেত্রে শুধু সময় নয়, জীবনের অনুবাদেও তাঁর জুড়ি মেলা ভার। স্বল্প পরিসরেও লক্ষ্যভেদী বাণে তার একমুখী চলনে প্রকাশের আভিজাত্য লাভ করে। আর তাতেই প্রতিবাদের তিক্ত চিত্রণ মন ও মননকে সক্রিয় করে তোলে। সেখানে নারীজীবনের আবর্তে বানু মুশতাকের ছোটগল্পে বহুমুখী বিস্তারে ও বহুমাত্রিক চেতনায় নারীদের অমানবিক পরাধীন জীবনের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর জাগিয়ে তোলার দায়বদ্ধতা নানাভাবেই প্রকাশমুখর। সেকথা তিনি নিজেই সাক্ষাৎকারে অকপটে জানিয়েছেন : ‘আমার গল্পগুলি নারীদের ঘিরেই আবর্তিত হয়েছে। ধর্ম, সমাজ, ও রাজনীতি কীভাবে তাঁদের থেকে নিঃশর্ত আনুগত্য দাবি করে, ফলাফল হিসেবে কীভাবে নিষ্ঠুরতার শিকার হন তাঁরা— এসব আমি গল্পে বর্ণনা করার চেষ্টা করেছি।’ সেক্ষেত্রে নারীদের নিয়ে গল্প লেখার দায়বদ্ধতা থেকেই যে বানু মুশতাকের গল্প লিখেছেন, তার পরিচয় তাঁর গল্পের মধ্যেও প্রতীয়মান। অথচ সেখানে নারীবাদের উগ্রতা নেই, নেই জীবনজিজ্ঞাসার একদেশদর্শিতার অন্ধত্ব। সত্য প্রকাশের দায়বদ্ধতা থেকেই গল্পগুলি লেখা। অন্যায়-অবিচারের পরিচয়ের আধারেই বানু মুশতাকের প্রতিবাদী সত্তা সক্রিয় হয়ে উঠেছে। সেখানে তাঁর আত্মসচেতন প্রকৃতি স্বচ্ছ ও স্পষ্ট। তাঁর মতে, লেখকের কাজ অন্যায়গুলি লিপিবদ্ধ করা। শিল্পসম্মত পদ্ধতির মাধ্যমে তা করা জরুরি। জোর করে সমাধান চাপানোর বিরুদ্ধে তাঁর চেতাবনি সদা জাগ্রত। অন্যদিকে বাস্তব অভিজ্ঞতার আধারেই তাঁর গল্পগুলি রচিত। এজন্য ‘বিস্তৃত গবেষণা নয়’, ‘বাস্তব জীবনের মিথষ্ক্রিয়া’ থেকে তাঁর অমুপ্রেরণার ফসল তাঁর গল্পগুলি।
বানু মুশতাকের অকপট স্বীকারোক্তি, ‘আমার হৃদয় নিজেই আমার অধ্যয়নের ক্ষেত্র’। এই হৃদয়তাড়িত গল্পগুলি শুধু নারীদের অধিকারের কথায় সোচ্চার হয়নি, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে অমানবিক অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধেও আওয়াজ তুলেছে। ‘Heart Lamp : Selected stories’-এর প্রতিটি গল্পেই তার পরিচয় বর্তমান। বিশেষ করে মুসলিম সমাজের ধর্মীয় গোঁড়ামিতে বৈষম্যপীড়িত নারীদের বিপন্ন অস্তিত্ব নানাভাবে গল্পের মধ্যে নিবিড়তা লাভ করে। সেক্ষেত্রে তাঁর ব্যক্তিগত জীবন থেকে উঠে আসা গল্পটিই ‘Heart Lamp’-এর আলো জ্বেলে দেয়। বিয়ের পর ১৯৭৭-এ উনত্রিশ বছর বয়সী বানু মুশতাক পারিবারিক জীবনে বোরখা পরে ঘরসংসারে বন্দি করে লেখালেখি ছেড়ে নিজেকে নিঃস্ব করতে না চাওয়ায় শেষে আগুনে পুড়ে মরতে চেয়েছিলেন। তখন তাঁর মেয়ের বয়স মাত্র তিন মাস। তাঁর স্বামীই তাঁকে আগের মতো লেখা, কাজকর্ম চালিয়ে যাওয়ার সম্মতি দিয়ে তাঁকে বাঁচিয়েছিলেন। ‘Heart Lamp’-এর মধ্যে তা হুবহু উঠে না এলে সেখানেও তিন সন্তানের মা মেহরুনের কেরোসিন গায়ে দিয়ে আগুনে পুড়ে আত্মহত্যা করায় সক্রিয় হয়েছে। বহু সন্তানকামী ও পণলোভী স্বামীর দ্বিতীয় বিয়ে করতে হঠাৎ বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ায় মেহেরুনের সংসারে সংকট দেখা দেয়। কোনওভাবে স্বামীকে বাগে আনতে না পেরে তার নিরুদ্দেশ হওয়ায় অসহায় হয়ে বাবার বাড়িতে গিয়েও সুবিচারের বদলে প্রত্যাখ্যাত হতে হয় তাকে। শেষে অসহায়তাবোধে বেঁচে থাকাটাই মেহেরুনের কাছে ভারী হয়ে ওঠে। অবশেষে কেরোসিন গায়ে ঢেলে পুড়ে মরতে গেলে তার কিশোরী মেয়ে সালমা ও তার ছোট বোন মাকে জড়িয়ে ধরে তাদের জন্যই বেঁচে থাকার করুণ আর্তি জানিয়ে তাঁকে আত্মহত্যা থেকে বিরত করে। সেক্ষেত্রে মেহেরুন তাঁর সন্তানের মধ্যেই হার্ট ল্যাম্প খুঁজে পেয়ে নতুন জীবনের হদিশে গল্পটি শেষ হয়।
আসলে নারীদের পরাধীন দুর্বিষহ জীবনের নেপথ্যে ধর্মীয় পিতৃতান্ত্রিক সমাজের শোষণ-শাসনের বিরুদ্ধে বানু মুশতাকের লেখনী শুধু মাত্র নারীদের পক্ষপাতিত্বে সওয়াল করেনি, বরং সত্য প্রকাশে নিরপেক্ষতাকেই প্রাধান্য দিয়েছে। যেমন, তাঁর ‘A Decision of the Heart’ গল্পটি। ইউসুফের ঝগড়ুটে বৌ অখিলার জন্য সংসার ভেঙে যায়। সে তার বিধবা মাকে নিয়ে থাকে, অখিলা আলাদা হয়ে যায়। এর পরেও বৌয়ের সঙ্গে সে সম্পর্ক বজায় রাখতে চায়। অথচ মা-বৌয়ের বিচ্ছিন্ন সংসারেও ইউসুফের শান্তি মেলে না । উল্টে অখিলার ব্যবহারে অতিষ্ঠ হয়ে পড়ে সে। ইউসুফের বিধবা মাকে দেখভাল করতে গিয়ে টাকাপয়সা খরচ করাকে অখিলা মেনে নিতে পারে না। সেক্ষেত্রে স্বামী-শাশুড়ির পবিত্র সম্পর্ক অখিলার কাছে অসহ্য হয়ে ওঠে। শেষে বৌয়ের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য পঞ্চাশ বছর বয়সি মাকেও বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেয় ইউসুফ। সেদিক থেকে শুধু পুরুষশাসিত সমাজের প্রতিই নয়, নারীজীবনের করুণ পরিণতির জন্য নারীদের ভূমিকাকেও বানু মুশতাক দ্বিধাহীন ভাবে তুলে ধরেছেন ।
আবার নারীদের প্রতি ধর্মীয় বিধিনিষেধই শুধু নয়, হেয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ব্রাত্য ভাবনার পরিচয়ও তাঁর গল্পে প্রকট হয়ে উঠেছে । ‘The Arabic Teacher and Gobi Manchuri’, ‘Black Cobras’, ‘The Shroud’ প্রভৃতি গল্পেই তা প্রতীয়মান। প্রথম গল্পটিতে একজন তরুণ গৃহশিক্ষক তার মনের মতো একজন পাত্রী খোঁজার জন্যই মেয়েদের একটি আরবি ক্লাস পরিচালনা করে। তার প্রিয় খাবার কীভাবে রান্না করতে হবে তা পাত্রীর জানা জরুরি। অথচ তার ‘স্বপ্নের মেয়ে’কে খুঁজে পেয়ে বিয়ে করার পর অপ্রিয় পরিণতি বেরিয়ে পড়ে। অন্যদিকে অভিশপ্ত নারীজীবন থেকে মুক্তির জন্য ঈশ্বরকেও ছাড়েননি গল্পকার । ‘Heart Lamp : Selected stories’-এর শেষ গল্প ‘Be a Woman Once, O Lord ’ গল্পটি তার বিশুদ্ধ উচ্চারণ। একজন অসুস্থ নারী বৈষম্যপীড়িত সমাজে নারীদের দুর্গতির জন্য তীব্র ক্ষোভের সঙ্গে আল্লাকে প্রশ্ন ছুঁড়েছে, ‘কেন তুমি একজন নারী হওনি ?’
নারীদের মুক্তি কামনায় ঈশ্বরের প্রতি তার ক্ষোভমিশ্রিত তীব্র আবেদনই বলে দেয় নারীদের দুর্দশাগ্রস্ত জীবনের করুণ পরিণতি কতটা নারীজীবনে অপরিহার্য হয়ে ওঠে। গল্পটির শেষে তারই তীব্র আর্তি পাঠককে সচকিত করে তোলে : ‘যদি তুমি আবার পৃথিবী গড়তে চাও, আবার পুরুষ ও নারী সৃষ্টি করতে চাও, তাহলে একজন অনভিজ্ঞ কুমোরের মতো হয়ো না। একজন নারী হয়ে পৃথিবীতে এসো, প্রভু! একবার নারী হও, হে প্রভু।’ মুসলিম সম্প্রদায়ের পুরুষতান্ত্রিক সমাজে বৈষম্যপীড়িত নারীদের কথা যেভাবে বানু মুশতাক তাঁর গল্পে তুলে ধরেছেন, তা শুধু তাঁর সম্প্রদায়ের বিপন্ন নারীজীবনের কথায় সীমাবদ্ধ থাকে না, ভারতের শোষিত-শাসিত নারীসত্তাতেও বিস্তার লাভ করেছে। অথচ সেই সোচ্চারে আপামর দীপ্ত নারীকণ্ঠস্বর বিঘোষিত হয়ে ওঠে। সেখানে নারীকে ভোগ্যপণ্য করে রাখা, সন্তান প্রসবিনী ভাবা, বা, স্বামীকে ঈশ্বরের আসনে বসিয়ে সেবাদাসী করে তোলার সযত্ন প্রয়াসের বিরুদ্ধে শিল্পিত প্রকাশ তীব্র আবেদনক্ষম হয়ে ওঠে। আসলে বানু মুশতাকের গল্পগুলি তাঁর সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর। অথচ তা সেভাবে দেশের বিভিন্ন ভাষায় ছড়িয়ে পড়েনি, গড়ে তোলেনি তীব্র প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর। উল্টে তাঁর বলিষ্ঠ নারীকণ্ঠ রক্ষণশীল মুসলিম সমাজের কাছে আক্রমণ ও উপেক্ষার শিকারে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। কন্নড় রাজ্য সাহিত্যে একাডেমী বা পেন ইংলিশ পুরস্কার পেলেও সেভাবে বানু মুসতাকের কৃতিত্ব বা তাঁর গল্প উচ্চ সমাদর লাভ করেনি। বুকার পাইজ পাওয়ার আগে তাঁর প্রতিবাদী সত্তার শিল্পিত হাতিয়ার হিসাবে তাঁর ছোটগল্পগুলির অসামান্য অবদান দেশময় চর্চার অবকাশ পায়নি। বুকার প্রাইজের দৌলতে বানু মুস্তাকের সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠায় বলিষ্ঠ নারীকণ্ঠ দেশ থেকে দেশান্তরে ছড়িয়ে পড়ার অবকাশ পেল। তাঁর ‘Heart Lamp’ বুকার প্রাইজের আলোতে নতুন করে জ্বলে ওঠার এবং জ্বালিয়ে দেওয়ার অবকাশ পেল। সাতাত্তর বছর বয়সি বানু মুস্তাকের সাতচল্লিশ বছরের নাছোড় সাধনায় সুদীর্ঘ কাল ধরে চলা সমাজের সবচেয়ে শোষিত-শাসিত প্রান্তিক ও দলিত মানুষের ক্রমশ অশ্রুত ও অব্যক্ত হয়ে থাকা সমবেত কণ্ঠস্বর প্রকাশের জন্যও তাঁর বুকার প্রাইজটি অত্যন্ত জরুরি ছিল।