সুপ্রিম কোর্টে মামলার শুনানি থাকলেও তার ৪৮ ঘণ্টা আগেই নয়া মুখ্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের ঘোষণা করে দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ অসম্মানজনক ও অশোভন কাজ করেছেন। কংগ্রেস নেতা ও লোকসভার বিরোধী দলনেতা রাহুল গান্ধী এই মন্তব্য করেছেন। রাহুল গান্ধীর পাশাপাশি মোদী সরকারের এই তড়িঘড়ি সিদ্ধান্তের কড়া সমালোচনা করেছেন কংগ্রেসের অনত্যতম সাধারণ সম্পাদক কেসি বেনুগোপাল। তিনি বলেছেন, এই জঘন্য পদক্ষেপ দেখিয়ে দিল, কীভাবে নির্বাচন প্রক্রিয়াকে ধ্বংস করতে চাইছে শসক গোষ্ঠী।
দেশের চিফ ইলেকশন কমিশনার (সিইসি) বা মুখ্য নির্বাচন কমিশনারের পদে নিয়োগ করা হয়েছে ১৯৮৮ সালের ব্যাচের কেরালা ক্যাডারের আইএএস অফিসার জ্ঞানেশ কুমারকে। রাজীব কুমার অবসর নেওয়ার পর আনুষ্ঠানিকভাবে সেই দায়িত্বও গ্রহণ করেছেন তিনি।
রাজীব কুমারের জায়গায় নতুন মুখ্য নির্বাচন কমিশনার বেছে নিতে বৈঠকে বসেছিল সরকারের সিলেকশন প্যানেল, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ ছাড়াও যার সদস্য লোকসভার বিরোধী দলনেতা রাহুল গান্ধী। সেই বৈঠকেই রাহুল গান্ধী সুপ্রিম কোর্টে এই সংক্রান্ত মামলার আসন্ন শুনানির পরিপ্রেক্ষিতে নয়া মুখ্য নির্বাচন কমিশনার বেছে নেওয়ার প্রক্রিয়া স্থগিত রাখার দাবি জানান। তিনি এই বিষয়ে লিখিত আপত্তি পেশ করেন বৈঠকে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তাতে কর্ণপাত করেননি। রাহুল গান্ধী যে মামলার কথা উল্লেখ করেছেন, তার শুনানির দিন আগেই ধার্য করেছিল সুপ্রিম কোর্ট। এমনকী যে বেঞ্চে এই শুনানি হবে, সেই বেঞ্চের দুই বিচারপতি সূর্যকান্ত ও এন কোটিশ্বর সিং অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে এই মামলা শুনবেন বলেও জানিয়ে দিয়েছিলেন।
দেশের মুখ্য নির্বাচন কমিশনার ও আরও দুই নির্বাচন কমিশনারের নিয়োগ পদ্ধতি নিয়ে বিতর্কের সূত্রপাত ২০২৩ সালে। ওই বছর ২ মার্চ সুপ্রিম কোর্ট এক রায়ে জানায়, নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগের দায়িত্ব সরকারের হাতে ছেড়ে দেওয়া হলে তা দেশের গণতন্ত্রের কাঠামো এবং সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের ব্যবস্থার পক্ষে ক্ষতিকর হবে। মুখ্য নির্বাচন কমিশনার ও আরও দুই নির্বাচন কমিশনারকে বেছে নেবে প্রধানমন্ত্রী, লোকসভার বিরোধী দলনেতা ও সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতিকে নিয়ে গঠিত সিলেকশন প্যানেল। সেই রায়কে নস্যাৎ করতে ওই বছরেই ডিসেম্বরে সংসদে বিজেপির সংখ্যা গরিষ্ঠতার জোরে তিন নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের জন্য নতুন আইন তৈরি করে দ্বিতীয় মোদী সরকার। নতুন আইন সিলেকশন চ্যানেল থেকে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতিকে সরিয়ে প্রধানমন্ত্রী মনোনীত কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার একজন সদস্যকে রাখার ব্যবস্থা করা হয়। তখনই বিরোধী দলগুলি এর জোরালো প্রতিবাদ জানায়। বিরোধীদের বক্তব্য ছিল, সিলেকশন প্যানেলে সরকারপক্ষের গরিষ্ঠতার ব্যবস্থা করা হলো, যাতে বিজেপি নিজের পছন্দের ও পক্ষের ব্যক্তিদের তিন নির্বাচন কমিশনারের পদে নিয়োগ করতে পারে। এতে নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা নষ্ট হবে। এই আইন প্রয়োগের পরবর্তী সময়েও দেখা গিয়েছে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী-সহ বিজেপি নেতা-নেত্রীরা জনপ্রতিনিধিত্ব আইন লঙ্ঘন করে নির্বাচনী প্রচারে ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়িয়ে ভাষণ দিলেও নির্বাচন কমিশন স্বতঃপ্রণোদিতভাবে বা অভিযোগ পেয়েও কোনও ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি।
সর্বশেষ লোকসভা নির্বাচনেও ভোটের শতকরা হার ঘোষণা ও ভোটারদের সংখ্যার অস্বাভাবিক বৃদ্ধি নিয়ে কমিশনের ভূমিকা প্রশ্নের মুখে পড়েছে, যে ধরনের প্রশ্নের মুখে অতীতে কমিশনকে কখনও পড়তে হয়নি বললেই চলে। পক্ষপাতিত্বমূলক নির্বাচন কমিশন গঠনের এই আইনের বিরুদ্ধে ২০২৪ সালে সুপ্রিম কোর্টে মামলা দায়ের করেছিল অ্যাসোসিয়েশন ফর ডেমোক্রেটিক রিফর্মস (এডিআর) নামে একটি এনজিও। প্রধান বিচারপতির পদে সঞ্জীব খান্না দায়িত্ব নেওয়ার পরে সেই মামলার শুনানির দিন ধার্য হয় ১৯ ফেব্রুয়ারি। তার আগের দিন অর্থাৎ ১৮ ফেব্রুয়ারি মুখ্য নির্বাচন কমিশনারের পদ থেকে রাজীব কুমারের অবসর নেওয়ার দিন হওয়ায় সরকারের তরফে জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল, এর আগেই নতুন একজনকে ওই পদের জন্য বেছে নেওয়া হবে। কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গে বলেছিলেন, নতুন যে আইনে পরবর্তী মুখ্য নির্বাচন কমিশনারকে বেছে নেওয়া হবে, তার বিরুদ্ধে দেশের শীর্ষ আদালতে মামলার শুনানি আছে। এই অবস্থায় সুপ্রিম কোর্টের অবস্থান না জানা পর্যন্ত প্রক্রিয়াটি স্থগিত রাখা হোক। মোদী সরকার তাতে সাড়া না দিয়ে কেন্দ্রের গঠিত সিলেকশন কমিটির বৈঠকে রাজীব কুমারের নাম চূড়ান্ত করে জানিয়ে দেয়।
মুখ্য নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনার বেছে নেওয়ার প্রক্রিয়াই সরকারি হস্তক্ষেপ মুক্ত নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশনের মৌলিক বিষয়। গণপরিষদে নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে আলোচনা ১৯৪৯ সালের জুন মাসে বিআর আম্বেদকর ভারতীয় গণতন্ত্র ও নির্বাচন কমিশনের কাজে সরকারি হস্তক্ষেপ নিয়ে সতর্ক করেছিলেন। সুপ্রিম কোর্টের সাংবিধানিক বেঞ্চও ২০২৩ সালের ২ মার্চ রায় দিয়েছিল, নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগের জন্য বেছে নেবে প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী দলনেতা ও দেশের প্রধান বিচারপতিকে নিয়ে গঠিত সিলেকশন প্যানেল। কিন্তু সেই রায়ের মর্মার্থকে অসৎভাবে লঙ্ঘন করে মোদী সরকার প্রধান বিচারপতির জায়গায় একজন কেন্দ্রীয় মন্ত্রীকে নিয়ে এসে প্যানেল পুনর্গঠনের আইন তৈরি করেছে এবং দেশে নির্বাচন প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা নিয়ে কোটি কোটি ভোটদাতাদের উদ্বেগ বাড়িয়ে দিয়েছে। বিভিন্ন সমীক্ষাতেও উঠে এসেছে যে, ভারতের নির্বাচন প্রক্রিয়া ও তার প্রতিষ্ঠানগুলির উপরে দেশের ভোটদাতাদের আস্থা ক্রমশ কমছে।