• facebook
  • twitter
Monday, 28 July, 2025

চলছে অঘোষিত জরুরি অবস্থা

জরুরি অবস্থায় সরকারবিরোধী রাজনৈতিক নেতা-কর্মী, সাংবাদিক এবং সমাজকর্মীদের জেলে পোরা হয়। সংবাদমাধ্যমে সেন্সরশিপ জারি করা হয়।

প্রতিনিধিত্বমূলক চিত্র

পঞ্চাশ বছর আগে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী সারা দেশে জরুরি অবস্থার ঘোষণা করেছিলেন। সেটাই ছিল ভারতের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার উপর প্রথম বড় আকারের আক্রমণ। এই জরুরি অবস্থা গভীরভাবে নাগরিক স্বাধীনতা এবং গণতান্ত্রিক অধিকারকে সংকুচিত করেছিল। তাই ২৫ জুন বিজেপি ও নরেন্দ্র মোদী সরকার ‘সংবিধান হত্যা’ দিবস পালনের ডাক দিয়েছে।
১৯৬০-এর দশকের শেষ দিকে কংগ্রেসের একচ্ছত্র ক্ষমতায় ধাক্কা লাগে। বিভিন্ন রাজ্যে বিরোধী দলগুলি সরকার গঠন করতে সমর্থ হয়। এই অবস্থায় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী গরিবী হটাও, ব্যাঙ্ক রাষ্ট্রায়ত্তকরণের মতো প্রগতিশীল স্লোগানের সঙ্গে নিজেকে নতুন রূপে তুলে ধরার চেষ্টা করেন। পরম্পরাগত রাজনৈতিক রীতি বদলে তিনি রাজ্যের শক্তিশালী নেতাদের পাশ কাটিয়ে সমস্ত ক্ষমতা নিজের হাতে কুক্ষিগত করেন এবং সরাসরি সাধারণ মানুষের কাছে আবেদন করতে থাকেন। এর ফলে তাঁর ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠায় লাভ হয়, কিন্তু প্রকৃত অর্থে প্রভূত প্রতিষ্ঠিত করার ক্ষেত্রে তাঁর ইচ্ছাপূরণ হয় বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধে হস্তক্ষেপ করার পরেই। এর পরিণামস্বরূপ স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়। পাকিস্তানকে চূড়ান্ত পরাজয়ের মুখে পড়তে হয়। পাকিস্তানের সেনা শাসকদের বাঁচানোর জন্য আমেরিকার সম্ভাব্য হস্তক্ষেপ রুখতে সোভিয়েত রাশিয়ার উপস্থিতিও সাহা্য্য করেছিল। যা শেষ পর্যন্ত তাঁকে ১৯৭১ সালের নির্বাচনে বিপুল জয় এনে দেয়। কিন্তু এত কিছুর পরও ওই বছরের ভোটে পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভায় সিপিআই(এম) একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসাবে উঠে আসে। ১৯৭২ সালে পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা ভোটে রিগিং করে কংগ্রেস ক্ষমতায় আসে এবং পরবর্তী পাঁচ বছর ক্ষমতায় কায়েম ছিল। যা ১৯৭৫ সালের ২৫ জুন জরুরি অবস্থা ঘোষণার সঙ্গে সহজভাবে জুড়ে যায়।

জরুরি অবস্থায় সরকারবিরোধী রাজনৈতিক নেতা-কর্মী, সাংবাদিক এবং সমাজকর্মীদের জেলে পোরা হয়। সংবাদমাধ্যমে সেন্সরশিপ জারি করা হয়। পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ, খরা এবং ১৯৭৩ সালের তেল সংকটের মতো বিষয়ের জেরে অর্থনৈতিক সংকটের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়েছিল ইন্দিরা গান্ধীকে। ক্রমবর্ধমান বেকারি এবং মূল্যবৃদ্ধির জেরে মানুষের এবং বিরোধীদের বিরোধিতার সম্মুখীন হতে হয় ইন্দিরা গান্ধীকে। এই বেড়ে চলা চাপ, শ্রীমতী গান্ধীর নিজের নিরাপত্তাহীনতার মনোভাব এবং আইনি ধাক্কা— বিশেষ করে তাঁর লোকসভার সদস্যপদ বাতিলের আশঙ্কা, সব মিলিয়ে ১৯৯৭৫ সালের জরুরি অবস্থা রাজনৈতিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক কারণের সঙ্গে মিলেমিশেই ঘোষণা করা হয়েছিল। ওই সময়ে সিপিএমের প্রবীণ সাংসদ এ কে গোপালন লোকসভায় তাঁর ভাষণে বলেছিলেন, শাসক দল নিজের এবং নিজের নেতাকে সংকট থেকে বের করার জন্য এই যে পদক্ষেপ করেছে, তা তাদের দুর্বলতাকেই প্রকাশ করে, সামর্থ্যের প্রদর্শন করে না। এই পদক্ষেপ বিরোধী এবং গণ আান্দোলনকে দমন করার জন্য নেওয়া হয়েছে। এরপরই অপরিহার্যভাবে রাজনৈতিক পরাজয়ের মুখে পড়তে হয় কংগ্রেস দল এবং ইন্দিরা গান্ধীকে। ১৮ মাসের জরুরি অবস্থা সমকালীন রাজনৈতিক ইতিহাসে গণতন্ত্রের গভীর বিকৃতি এবং খারাপ দিক হিসাবে চিহ্নিত হয়ে আছে।

১৯৭৭ সালের লোকসভা ভোটে অনেক শক্তির বৃহৎ জোট গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা নিশ্চিত করেছিল। এখন আমরা যে পুরোদস্তুর স্বৈরাচার সহ্য করছি, তার সঙ্গে ১৯৭৫ সালের জরুরি অবস্থার তুলনা প্রায় অপেশাদার। বর্তমান অবস্থা থেকে নিস্তার পাওয়া খুবই কঠিন বলে মনে হয়। কিন্তু সত্তরের দশকে যে সাফল্যের সঙ্গে জরুরি অবস্থার মোকাবিলা করা হয়েছে, তার অভিজ্ঞতা থেকে এই বিশ্বাস তৈরি হয় যে, আরএসএসের ঘাতক মতাদর্শের বিরুদ্ধে লড়াই করার দৃঢ় ইচ্ছাশক্তি নিয়ে ঐক্যবদ্ধ হলে বর্তমান চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করা সম্ভব।

নরেন্দ্র মোদী ১৯৭৫ সালের জরুরি অবস্থার কথা তুলে ধরে একে সংবিধানের উপর ‘কালো ছাপ’ বলে চিহ্নিত করেছেন। কিন্তু গত ১১ বছর ধরে গণতন্ত্রের উপর আরএসএস-বিজেপি যে হামলা করে চলেছে, তার থেকে নজর ঘোরাতেই পঞ্চাশ বছর আগের জরুরি অবস্থার কথা বলা হচ্ছে। গত এক দশকের মোদীর শাসনকালকে ‘অঘোষিত জরুরি অবস্থা’ বলে বিরোধীরা যে কটাক্ষ করছেন, তা প্রকৃত অর্থে সত্যই।