জাতির উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ভাষণ মানেই চমক। ২০১৬ সালের ৮ নভেম্বর রাত ৮টা। দেশবাসীকে স্তম্ভিত করে সেদিন রাত থেকেই নোটবন্দির কথা ঘোষণা করেন নরেন্দ্র মোদী। তারপর ২০১৯-এর ২২ মার্চ বালাকোটে এয়ার স্ট্রাইকের ঘোষণা। ২০২০ সালের ২৪ মার্চ দেশজুড়ে লকডাউনের ঘোষণা এবং মে মাসে লকডাউন শিথিল করার ঘোষণা। এরপর চলতি বছরে ‘অপারেশন সিঁদুর’-এর সাফল্য দাবি। এইভাবে মোদী বারে বারে চমকে দিয়েছেন দেশবাসীকে। এইসব ভাষণের পর দেশের অবস্থা কী হয়েছে, তা সকলেই কমবেশি জানেন। একই রকম ‘সাসপেন্স’ বজায় রেখে দেবীপক্ষের শুরুতে ২১ সেপ্টেম্বরের বিকেলে ফের জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিতে পর্দায় ধরা দিলেন প্রধানমন্ত্রী মোদী।
উপলক্ষ্য, নতুন সংশোধিত হারে জিএসটি-র ঘোষণা। মোদীর কথায়, দেশে ‘সাশ্রয় উৎসব’ শুরু হলো। জিএসটি করের হার কমিয়ে গরিব-মধ্যবিত্ত, শ্রমিক-কৃষক, মহিলা, ছাত্রছাত্রী, যুবক-যুবতী সকলের সুবিধার কথা ঘোষণা করলেন। জানালেন, এর ফলে সঞ্চয় বাড়বে, পণ্য কেনাবেচা বাড়বে, তৈরি হবে চাহিদা। ফলে অর্থনীতিতে গতি আসবে। আশায় বুক বাঁধলেন সাধারণ মানুষ, যেমন নোটবন্দিতে কালো টাকা উদ্ধার হবে ভেবেছিলেন।
Advertisement
কিন্তু নতুন হারে জিএসটি চালুর ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই প্রকৃত সত্যটা সামনে চলে এলো। জিএসটির হার কমানোর সাফল্য দাবি করে মোদী সরকার এবং বিজেপির উচ্চকিত প্রচারের ফানুস চুপসে গেল বণিকসভা ফিকি-র ঘোষণায়। ফিকি জানিয়েছে, এতে মধ্যবিত্ত পরিবারে মাসে মাথাপিছু মাত্র সাশ্রয় হবে ৫৮ থেকে ৮৮ টাকা। থট আর্বিটেজ রিসার্চ ইনস্টিটিউট সংস্থার সঙ্গে ফিকির যৌথ সমীক্ষায় লাভ বা সাশ্রয়ের এই ছবি ধরা পড়েছে।রিপোর্টে বলা হয়েছে, গ্রামীণ পরিবারগুলিতে নিত্যপণ্যের ৭৫.৫ শতাংশই এখন হয় জিএসটি মুক্ত অথবা ৫ শতাংশ জিএসটি-র আওতায়। শহরে এই হার ৬৬.২ শতাংশ। সেখানেও মাথাপিছু সাশ্রয় মাসে মাত্র ৫৮ থেকে ৮৮ টাকার মতো দাঁড়াচ্ছে। জিএসটি কমানোর প্রচার চললেও প্যাকেটজাত নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম কমানো হয়নি।
Advertisement
আর্থিক সুবিধালাভের দাবি মোদী সরকার জানালেও রিজার্ভ ব্যাঙ্কের একটি চমকপ্রদ তথ্য তা নিষ্প্রভ করে দিয়েছে। এই তথ্যে বলা হয়েছে, গত কয়েক বছরে মধ্যবিত্ত পরিবারের ঋণের বোঝা বেড়েছে, কমেছে সঞ্চয়। ২০২৪ সালে পরিবারের সঞ্চয়ের হার মোট জিডিপি-র মাত্র ৫.৪ শতাংশ ছিল। অন্যদিকে মূল্যবৃদ্ধির কারণে ২০২৫-এর মাঝামাঝি সময়ে পরিবারের ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে জিডিপি-র ৪১ শতাংশ। এই আর্থিক পরিস্থিতির জিএসটি থেকে সামান্য সাশ্রয় কোনও মধ্যবিত্তকে যে সুরাহা দিতে পারবে না, এই সত্যটা চেপে যাচ্ছে মোদী সরকার।
নরেন্দ্র মোদী আসলে সামান্য কয়েকজন ধনী ব্যবসায়ীর স্বার্থরক্ষায় বেশি আগ্রহী। চলতি বছরের বাজেট অধিবেশনে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামণ জানিয়েছিলেন, মোদী জমানার এক দশকে কর্পোরেট ও ধনী ব্যবসায়ীদের ১৬ লক্ষ কোটি টাকা ঋণ মকুব করে দিয়েছে সরকারি ও বেসরকারি ব্যাঙ্কগুলি। এর মধ্যে শুধু রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলিই ১২ লক্ষ কোটিরও বেশি টাকা মুছে দিয়েছে অনাদায়ী ঋণের পাতা থেকে। অর্থাৎ এই কর্পোরেট ও বেসরকারি সংস্থাগুলি ব্যাঙ্ক থেকে কোটি কোটি টাকা ঋণ নিয়ে শোধ করেনি। সরকার তাদের ঋণ মকুব করে দিয়েছে। অথচ সাধারণ মানুষ সামান্য টাকা ধার নিয়ে সময়মতো শোধ না করতে পারলে তাদের সামান্য সঞ্চয়ও বাজেয়াপ্ত করে ঋণের টাকা আদায় করে ব্যাঙ্কগুলি। অথবা স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে নেয়।
জিএসটি হার কমানোর কথা ঘোষণা করে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী জানিয়েছিলেন, এর ফলে বছরে ২.৫ লক্ষ কোটি টাকা সাশ্রয় হবে ১৪৫ কোটি দেশবাসীর। আর ব্যাঙ্ক ঋণ মকুব করে দিয়ে দেশের প্রধানমন্ত্রী অতি ধনী কিছু পরিবারের ১৬ লক্ষ কোটি টাকা সাশ্রয়ের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। জাতির উদ্দেশের নামে ‘তেলা মাথায় তেল’ দেওয়ায় সিদ্ধহস্ত মোদী সাধারণ মানুষকে এইভাবে বোকা বানানোর চেষ্টা করছেন।
Advertisement



