• facebook
  • twitter
Thursday, 15 May, 2025

ভারতীয় ঐতিহ্যের এক জীবন্ত দলিল পুরীর জগন্নাথদেবের মন্দির

ওড়িশার মহাকবি সারলা দাস জগন্নাথকে একইসঙ্গে — বুদ্ধ ও কৃষ্ণ বলেছিলেন, তাঁর মতে, মানবমুক্তির জন্য জগন্নাথের এই অভিনব রূপধারণ।

ফাইল চিত্র

সুস্মিতা মুখার্জী চট্টোপাধ্যায়

ওড়িশার উপকূলীয় শহর পুরী হল জগন্নাথদেবের ক্ষেত্র। আর জগন্নাথের পুণ্যভূমি নীলাচল বাঙালির শ্রেষ্ঠ তীর্থ। পুরীর জগন্নাথ মন্দির একাধারে আধ্যাত্মিকতা, সংস্কৃতি এবং স্থাপত্য— জাঁকজমকের এক আলোকবর্তিকা হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে। লক্ষ লক্ষ মানুষের কাছে শ্রদ্ধার পাত্র এই মন্দিরটি তাই কেবল একটি ধর্মীয় স্থান নয় বরং ভারতের সমৃদ্ধ ঐতিহ্যের একটি জীবন্ত দলিল বলা যায়।

পুরীর এই জগন্নাথ মন্দিরের ইতিহাস এক সহস্রাব্দ জুড়ে বিস্তৃত। ওড়িশার গঙ্গবংশীয় রাজা অনন্তবর্মন চোড়গঙ্গ খৃষ্টীয় একাদশ শতকে জগন্নাথদেবের বর্তমান মন্দিরটির নির্মাণের কাজ শুরু করেছিলেন এবং তাঁর উত্তরাধিকারীদের আমলে সেই নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছিল। তাঁরা সমগ্র ওড়িশা রাজ্যকে জগন্নাথদেবের কাছে উৎসর্গ করে তাঁর সামন্ত হিসেবে রাজ্যটি শাসন করেছিলেন। যদিও মাদলাপঞ্জীতে বলা হয়েছে যে, রাজা যযাতি কেশরী জগন্নাথের মন্দিরটি নির্মাণ করেছিলেন। একথা বলাই যায় যে এই মন্দিরটি হিন্দুধর্মের একটি প্রধান ঐতিহ্য ও বৈষ্ণব ধর্মের কেন্দ্রবিন্দু। কিংবদন্তি অনুসারে, জগন্নাথ (ভগবান বিষ্ণুর এক রূপ), বলভদ্র এবং সুভদ্রা দেবতাদের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন, যিনি ভগবান বিষ্ণুর একজন ভক্ত ছিলেন।

অতীতে উড়িষ্যার বৈষ্ণবরা বিশ্বাস করতেন যে, জগন্নাথ হলেন আদি পুরুষ; তিনি- অলেখ, নিরঞ্জন, নির্গুণ ও নিরাকার। বৈষ্ণবেরা তখন জগন্নাথকে একজন নির্গুণ পুরুষ হিসেবে দেখেছিলেন। পুরীর জগন্নাথ ক্ষেত্রটি যে একসময় বৌদ্ধ মঠ ছিল তা ইতিহাসসিদ্ধ এবং মন্দিরের চেহারা বা গঠন দেখলে অনুমান করা যায় এটা মন্দির ছিল না, মঠই ছিল। গবেষকদের মতে অতীতে উড়িষ্যার উপরে মহাযানী বৌদ্ধমত ও তন্ত্রের প্রভাব পড়েছিল। প্রভু জগন্নাথ তখন পঞ্চসখা সম্প্রদায়ের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছিলেন। তাঁদের মতে জগন্নাথ হলেন বুদ্ধ— তিনি শূন্যপুরুষ ও জ্ঞানমিশ্রা ভক্তির পরিপূর্ণ প্রকাশ। গবেষকদের মতে উড়িষ্যার জগন্নাথ তত্ত্বের ওপরে গোরক্ষনাথের সাধন পদ্ধতির প্রভাবও পড়েছিল। বৌদ্ধধর্মের শূন্যবাদ, তন্ত্রের ক্রিয়াবাদ এবং যোগের কায়াসাধন —মিলিতভাবে সমন্বয়ী জগন্নাথ তত্ত্বের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

মন্দিরের কেন্দ্রস্থলে জগন্নাথ, বলভদ্র এবং সুভদ্রার দেবতারা অবস্থিত। এই কাঠের মূর্তিগুলি তাদের নকশায় অনন্য। বিশ্বাস করা হয় যে এটি ভগবান বিষ্ণুর সর্বজনীন রূপের প্রতিনিধিত্ব করে। নীলাচল হল প্রভুর গোলোক। উড়িষ্যার বৈষ্ণবেরা সর্বদাই জগন্নাথদেবের মহিমা কীর্তন করেন। সিংহভাগ গবেষকদের মতে জগন্নাথ আদিতে শবরদের দেবতা ছিলেন এবং পরে তিনি জৈন, বৌদ্ধ, শৈব ও বৈষ্ণবদের উপাস্য দেবতা হয়েছিলেন।

ওড়িশার মহাকবি সারলা দাস জগন্নাথকে একইসঙ্গে — বুদ্ধ ও কৃষ্ণ বলেছিলেন, তাঁর মতে, মানবমুক্তির জন্য জগন্নাথের এই অভিনব রূপধারণ।

সুদূর অতীত থেকেই ওড়িশা রাজ্যের সংস্কৃতির ধারা জগন্নাথ ও জগন্নাথ ধর্মকে অনুসরণ করে প্রবাহিত হয়ে চলেছে বলে দেখতে পাওয়া যায়। সেখানে জগন্নাথ হলেন সর্বধর্ম সমন্বয়ের প্রতীক। বিষ্ণু, অগ্নি, নারদ ও স্কন্দপুরাণে জগন্নাথের উল্লেখ পাওয়া যায়। জগন্নাথ শুধু পূর্ব ভারতের দেবতা নন, সমগ্র উত্তর, পশ্চিম ও দক্ষিণ ভারতেও তাঁর মহিমা ছড়িয়ে রয়েছে। প্রতিবছর হাজার হাজার ভক্ত প্রভু জগন্নাথকে দর্শন করবার জন্য পুরীধামে উপস্থিত। তিনি উচ্চ-নীচ, ধনী-নির্ধন সকলেরই সখা ও আশ্রয়দাতা। তাঁর সম্পর্কে বহু কাহিনী, প্রবাদ ও জনশ্রুতি তৈরি হয়েছে; তিনি দীনবন্ধু, নীচ ও পাপীর উদ্ধারকর্তা, তিনি হলেন ভক্তের ভগবান। ওড়িশার অধিবাসীরা দাবি করেন যে, বৈষ্ণব কবি জয়দেব ওড়িশার মানুষ ছিলেন এবং জগন্নাথদেবের নির্দেশেই তিনি গীতগোবিন্দ রচনা করেছিলেন।

জগন্নাথের আরেক নাম হলো পতিতপাবন; তিনি দীনদয়াল, — যে কেউ তার শরণ নিতে পারেন। তিনি ভক্তাধীন, তাঁকে পাওয়ার বা জয় করবার শ্রেষ্ঠ উপায় হল — ভক্তি। জগন্নাথদেব চিরকালই ভক্তদের প্রতি অনুকম্পাপরায়ণ, ভক্তদের প্রতি তাঁর করুণা সর্বজনবিদিত। জনশ্রুতি, গাথায় ও গানে জগন্নাথদেবের মহিমা কীর্তন করা হয়। শুধু উড়িয়া ভাষায় নয়, ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে বিভিন্ন ভাষায় জগন্নাথদেবের মহিমা কীর্তিত হয়েছে। জগন্নাথকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন কালজয়ী লোকসংস্কৃতির ধারা, নানাধরণের পালাপার্বণ এবং চিত্রকলা ও ভাস্কর্যের সৃষ্টি হয়েছে।

গবেষকরা পুরীর জগন্নাথের মন্দিরে বিশেষভাবে তান্ত্রিক প্রভাব লক্ষ্য করেছেন। জগন্নাথ মন্দিরের তান্ত্রিক শক্তি হচ্ছেন — বিমলা। সেখানে মাটির তলায় অবস্থিত একটি মন্দিরে বিমলা অধিষ্ঠিতা রয়েছেন। জগন্নাথ মন্দিরের চত্বর থেকে সিঁড়ি দিয়ে নেমে সেখানে পৌঁছাতে হয়। জগন্নাথের উপাসনাও বৈষ্ণব তন্ত্রমতে অনুষ্ঠিত হয়। তাঁর আরাধনার সময়ে পঞ্চ-ম’কারের বিকল্প হিসাবে মৎস্যের পরিবর্তে হিঙ্গুমিশ্রিত সবজি, মাংসের পরিবর্তে আদাপচেদি, মদ্যের পরিবর্তে কাংস্য-পাত্রে নারিকেলের জল, মুদ্রার পরিবর্তে কান্তি (গোধূমচূর্ণ ও শর্করা মিশ্রিত দ্রব্য) ও মৈথুনের পরিবর্তে দেবদাসীর নৃত্য ও অপরাজিতা ফুল উৎসর্গ করা হয়। আসল আমিষ দ্রব্য পুরীর মন্দিরে কখনও প্রবেশ করানো হয় না। কিন্তু বছরের একদিন সেই নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটে; সেই দিনটা হচ্ছে দুর্গাপূজার মহাষ্টমীর দিন। একমাত্র মহাষ্টমীর দিনই পুরীর মন্দিরে বিমলার ভোগ রাঁধবার জন্য মৎস্য ব্যবহার করা হয়। শুধু আধ্যাত্মিক বিকাশ নয়, জগন্নাথদেব তাঁর অপার মহিমা নিয়ে অধিষ্ঠান করেছেন ভক্তদের জীবনে ও মননে। তাঁকে উদ্দেশ্য করে নিবেদিত প্রসাদকে বলা হয় মহাপ্রসাদ। পদ্মপুরাণ, স্কন্দপুরাণ, বিষ্ণুপুরাণে জগন্নাথ দেবের মহাপ্রসাদের মাহাত্মের কথা বলা হয়েছে। এই মহাপ্রসাদের রন্ধনশৈলী, তার পরিমাণ ও নিবেদন পদ্ধতি অনন্য। জগন্নাথদেব সারা ভারতবর্ষের মানুষকে আকর্ষণ করছেন তার বিখ্যাত মহাপ্রসাদের মাধ্যমে। প্রতিদিন ৫৬ ধরণের খাবার প্রস্তুত করা হয় মহাপ্রভুর উদ্দেশ্যে যা প্রকৃতপক্ষে ঐশ্বরিক নিবেদনের নামান্তর।

অতীতে জগন্নাথকে ঘিরে একটি বিশেষ ধরনের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল তৈরি হয়েছিল। মধ্যযুগের ভারতে পথঘাট ও যাতায়াত ব্যবস্থা তেমন কিছু উন্নত ধরণের ছিল না। কিন্তু তখনও দূরদূরান্ত থেকে তীর্থযাত্রীরা জগন্নাথধামে জগন্নাথদেবকে দর্শন করার জন্য উপস্থিত হতেন। ফলে ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও শিল্পের ক্ষেত্রে ভাব বিনিময় হত। জগন্নাথ শুধু ওড়িশার মানুষকে প্রভাবিত করেননি, সমগ্র পূর্ব ভারতেই তাঁর অপরিসীম প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।

ভারতের বৃহত্তম উৎসবগুলির মধ্যে শ্রীপুরুষোত্তম ধামের রথযাত্রা উৎসব অন্যতম। প্রতিবছর আষাঢ় মাসের পুষ্যানক্ষত্র যুক্ত দ্বিতীয়া তিথিতে অনুষ্ঠিত হয় রথযাত্রা, চলে দশমী তিথি পর্যন্ত। জগন্নাথদেবের রথের নাম ‘নন্দীঘোষ’। বলরামের নীলবর্ণের রথের শীর্ষভাগে তালচিহ্নের কারণে রথের নাম হয়েছে ‘তালধ্বজ’। সুভদ্রার রথ ‘পদ্মধ্বজ’, ‘দেবীদলন’ বা ‘দেবীরথ’ নামেই রথের পরিচিতি।

বাংলার সাহিত্য ও সংস্কৃতির ওপরেও জগন্নাথ মতবাদের প্রভাব পড়েছে অপরিসীম। ওড়িশার যাজপুর, ধর্মঠাকুরের প্রাচীনতম তীর্থস্থানগুলির মধ্যে অন্যতম। অনেকে তাই জগন্নাথদেব ও ধর্মঠাকুরকে অভিন্ন বলে মনে করেন। ভারতচন্দ্র তাঁর ‘অন্নদামঙ্গল’ গ্রন্থে জগন্নাথদেবের কথা উল্লেখ করেছিলেন। বাঙালি কবি গদাধর দাস ‘জগন্নাথমঙ্গল’ কাব্য রচনা করেছিলেন। জগন্নাথ শুধু ব্রাহ্মণের দেবতা নন, আচণ্ডাল সকলের তাঁর উপরে সমান অধিকার রয়েছে। তিনি বিষ্ণুর অবতার, পতিতের পাবন, পরম অহিংসক। তাঁর দুয়ারে সর্বলোক, সর্বদেশ একাকার হয়ে গিয়েছে।

গবেষকদের মতে মধ্যযুগের জাতিভেদে জর্জরিত ভারতবর্ষে জগন্নাথ মতবাদ একটি মূর্ত প্রতিবাদে পরিণত হয়েছিল। সেখানে নানকী, কবীরী, নাথপন্থী, বৈষ্ণব, শাক্ত, শৈব সকলে গিয়ে মিলিত হয়েছিলেন। এমনকি ভিন্ন মতাবলম্বী সম্প্রদায়ের দেবতারাও জগন্নাথ মন্দির প্রাঙ্গণে স্থানলাভ করেছিলেন। সুদূর আসামেও জগন্নাথ মতবাদের প্রভাব পড়েছিল। আসামের কাছাড়, গৌহাটি প্রভৃতি জায়গায় আজও রথযাত্রা পালন করা হয়। রেঙ্গুনেও একটি প্রাচীন জগন্নাথ মন্দির রয়েছে। অতীতে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার কাছে ধামরাইতে একটি প্রাচীন জগন্নাথ মন্দির ছিল। জগন্নাথ তত্ত্বকে আশ্রয় করে প্রাচীন ও মধ্যযুগের সাধারণ মানুষ শান্তি ও আশ্রয় খুঁজেছিলেন। হাজার বছর ধরে এই মতবাদ হিন্দুদের সাহিত্য, সংস্কৃতি ও শিল্পকে সমৃদ্ধ করেছে। আর এর ফলেই জগন্নাথ মতবাদ পূর্ব ভারতের সংস্কৃতি বিনিময়ের মাধ্যম হয়েছে। এভাবেই পুরীর জগন্নাথ মন্দির ইতিহাস, আধ্যাত্মিকতা, শিল্প এবং সংস্কৃতির এক অসাধারণ সঙ্গমস্থল হয়ে ওঠে।