• facebook
  • twitter
Friday, 5 December, 2025

১৭ জুন অম্লান দত্তের জন্মদিন ও জন্মশতবর্ষ পূর্তি

দেশের জ্বলন্ত সমস্যা সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদ দূর করতে শতবর্ষেও উপেক্ষিত অম্লান দত্ত সাংস্কৃতিক বিপ্লবের কথা বলেছেন আজীবন ! স্বপনকুমার মণ্ডলAdvertisement অশান্ত সমুদ্রের তলদেশে থাকে তার প্রশান্ত স্থিরতা । সেখানেই তার রত্নের অভিজাত আয়োজন । উত্তাল সমুদ্রের তরঙ্গ বিক্ষোভ দেখে যেমন তার রত্নাকরের প্রশান্ত প্রকৃতি জেগে ওঠে না, তেমনই জনসমুদ্রের কোলাহলে মানুষের নীরবে চলা অমূল্য মনীষার পরিচয়ও

দেশের জ্বলন্ত সমস্যা সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদ দূর করতে শতবর্ষেও উপেক্ষিত অম্লান দত্ত সাংস্কৃতিক বিপ্লবের কথা বলেছেন আজীবন !

স্বপনকুমার মণ্ডল

Advertisement

অশান্ত সমুদ্রের তলদেশে থাকে তার প্রশান্ত স্থিরতা । সেখানেই তার রত্নের অভিজাত আয়োজন । উত্তাল সমুদ্রের তরঙ্গ বিক্ষোভ দেখে যেমন তার রত্নাকরের প্রশান্ত প্রকৃতি জেগে ওঠে না, তেমনই জনসমুদ্রের কোলাহলে মানুষের নীরবে চলা অমূল্য মনীষার পরিচয়ও আত্মগোপন করে। নীরবতা যে পরিণত মননের প্রকাশ, আমাদের তা অনেক সময়েই খেয়ালে আসে না। শুধু তাই নয়, নীরবেও যে তীব্র প্রতিবাদ করা যায়, তা নিয়েও আমরা যথেষ্ট সচেতন নই, বিশ্বাসও নেই। অবশ্য যেখানে বিশ্বাসের অভাব,সেখানে যুক্তিও অকেজো । আবার আত্মবিশ্বাসের অভাব হলেই তার সিদ্ধান্তেও দোলাচলতা নেমে আসে । প্রতিরোধের বিনীত ভাষাই প্রতিবাদে মুখর হয়ে ওঠে, প্রতিশোধে তার উগ্র মূর্তি প্রত্যাঘাতে সক্রিয় হয় । সেক্ষেত্রে ছকবন্দি প্রতিবাদী বা প্রতিক্রিয়াশীল সরব ব্যক্তিত্বদের আলোর পাশে নীরবে সরব ব্যক্তিত্বের প্রভাব সেভাবে সক্রিয় হয়ে ওঠে না। অথচ প্রতিরোধ-প্রতিরোধ-প্রতিশোধের সোপানে না উঠেও মানুষের মণিকোঠায় উঠা যায়, নিজেকে জাহির না করেও আত্মিক সংযোগে জনমানসের শ্রদ্ধা লাভ করা যায়,তার পরিচয়ও কখনও কখনও মেলে ।

Advertisement

এরকমই একজন অতুলনীয় মনীষা অম্লান দত্ত (১৭.০৬. ১৯২৪-১৮.০২.২০১০) । বিশ শতকের গুটিকতক মনীষার অন্যতম অনন্য ব্যক্তিত্বের আলোয় তাঁর আসল পরিচয় মননশীল মানুষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে রয়েছে । অথচ চিন্তাভাবনায় ও মতাদর্শে এবং বিশেষ করে মানবতাবাদী উদার দৃষ্টিভঙ্গিতে তাঁর মতো নীরব বিপ্লবীর পরিচয় নেই বললেই চলে। বিপ্লবী মানবেন্দ্র রায়ের আমূল মানবতাবাদের অনুগামী হিসাবে অম্লান দত্তের সঙ্গে শিবনারায়ণ রায়ের নাম উঠে আসে। সেখানেও শিবনারায়ণের সরব ব্যক্তিত্বের পাশে অম্লানের নীরবে সরব অস্তিত্ব বিস্ময় জাগায়, গভীরতর শ্রদ্ধা উদ্রেক করে। অথচ তাঁর স্বতন্ত্র কণ্ঠস্বর কোনওভাবে উচ্চকিত হয়নি, কোনও বাদ-প্রতিবাদে সক্রিয় হয়ে ওঠেনি, জাগিয়ে তোলেনি ব্যক্তিত্বের রংমশাল । অথচ তাঁর হীরকদৃঢ় অবস্থান তাঁর ব্যক্তিত্বে শুধু হীরকদ্যুতি ছড়ায়নি, যুগজীবনের আলোকদিশারি হয়ে উঠেছে । আধুনিক জীবনের সবচেয়ে মহার্ঘ প্রাপ্তি গণতন্ত্রের মধ্যেই তাঁর স্বরচিত সাংস্কৃতিক বিপ্লবের হাতছানি নতুন পথের সন্ধান দিয়েছে । সেখানে তাঁর অনন্য মনীষার আলো আজও আমাদের পাথেয়, উত্তরণের বিশল্যকরণী । অথচ তাঁকে নিয়ে চর্চার পরিসর তাঁর শতবর্ষেও অধরা মাধুরী । শুধু তাই নয়, তাঁর জীবিতকালেও তাঁর পরিচয় মেঘে ঢাকা তারা । প্রথমে সে বিষয়ে আলোকপাত জরুরি মনে হয় । কেননা অভাববোধেই অস্তিত্বের সর্বশ্রেষ্ঠ পরিচয় ।

অম্লান দত্তের পরিচিতিতে পেশাদারি মনোভাবের ছাপ স্পষ্ট। ভারতের প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ ও শিক্ষাবিদ । পরে চিন্তাবিদ ও লেখক জুড়ে দেওয়া হয় । এসবই তাঁর পোশাকি পরিচয়ের বহুরূপী প্রকাশ। অবিভক্ত বাংলার কুমিল্লার শিক্ষাশোভন বনেদি পরিবারে তাঁর জন্ম । প্রেসিডেন্সি কলেজের অর্থনীতির কৃতী ছাত্রটি যথাসময়ে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়েও সাফল্য অর্জন করে। এরপর অধ্যাপনার কর্মজীবনে একের পর এক সিঁড়ি বেয়ে ঈর্ষণীয় সফলতা তাঁকে উচ্চশিক্ষাক্ষেত্রেই উৎকর্ষমুখর ব্যক্তিত্বে শ্রদ্ধেয় করে তোলে । আশুতোষ কলেজ(১৯৪৭) থেকে পরের বছর (১৯৪৮) কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কনিষ্ঠ অধ্যাপক অচিরেই সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রোভিসি(১৯৭২-১৯৭৪ )পদে উন্নীত হন। তারপর উত্তরবঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় (১৯৭৪-১৯৭৭) থেকে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে(১৯৮০-১৯৮৪) উপাচার্যের পদে ছিলেন । মাঝে বছরখানেক (১৯৭৮-৭৯) তিনি বারাণসীর গান্ধীয়ান ইনস্টিটিউট অব স্টাডিজ-এর পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন । শুধু তাই নয়,আমন্ত্রিত হয়ে রবীন্দ্রনাথ, মহাত্মা গান্ধী, আর্থিক উন্নয়ন ও শিক্ষার সমস্যা নিয়ে দেশবিদেশে তিনি বক্তৃতা দিয়েছেন, পড়িয়েওছেন । আবার ১৯৭৯-তে রাষ্ট্রসংঘের সমাজ উন্নয়ন বিষয়ক কমিশনে ভারতের প্রতিনিধিত্ব করেছেন । ইংরেজি ও বাংলা দুই ভাষাতেই সমান পারদর্শী অম্লান দত্তের ক্ষুরধার মনীষাঋদ্ধ অসাধারণ লেখনীর পরিচয়ও অসংখ্য বইপত্রের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এছাড়া তিনি আবু সয়ীদ আইয়ুবের সঙ্গে যৌথভাবে ইংরেজি ‘Quest’ পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন । স্বাভাবিক ভাবেই তাতে তাঁর ভারতের অর্থনীতিবিদ্ হিসেবে পরিচিতি ও প্রতিষ্ঠার পথ সুগম হয়ে ওঠে । অন্যদিকে শিক্ষাবিদ হিসেবে তাঁর বনেদি আভিজাত্য ক্রমশ প্রাতিষ্ঠানিক উচ্চতা লাভ করে । সেদিক থেকে অম্লান দত্তের বহুমুখী প্রতিভার বহুমাত্রিক প্রকাশ স্বাভাবিক ও প্রত্যাশিত মনে হয়। অসংখ্য বইপত্র ও পত্রপত্রিকায় তাঁর চিন্তাভাবনার অনন্যতাই তাঁর চিন্তাবিদ ও লেখক পরিচিতিকে অতিরিক্ত যোগ্যতার ন্যায় বাড়তি সংযোজন করে তুলেছে । অথচ সেখানেই তাঁর উপেক্ষিত পরিচিতি অত্যন্ত প্রকট ।

অম্লান দত্তের মনীষার পরিচয় তাঁর মৌলিক চিন্তাভাবনায় ও স্বতন্ত্র আদর্শবোধে। পত্রপত্রিকায় নিয়মিত লেখালেখির মধ্যেই তা নানাভাবে উঠে এসেছে । সেখানে তাঁর নীরবে সরব চিন্তাভাবনার নিছক অগ্রণী চিন্তাবিদ বা চিন্তক অভিধায় তাঁকে চিহ্নিত করা সমীচীন নয় । তাতে তাঁর মননদীপ্ত লেখার আলোয় তাঁকে চেনা যায়,কিন্তু জানা যায় না। বিশ শতকের অনন্য মনীষার পরিচয়ে অম্লান দত্তের অসাধারণত্ব তাতে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। তাঁর নির্ভীক ও অবিচলিত মনের যুক্তিনিষ্ঠ মানবতাবাদী প্রকৃতি আজীবন অটুট ছিল। শুধু তাই নয়, সেখানে তাঁর একক চলনে নাছোড় প্রকৃতিই বলে দেয় তাঁর হীরকদৃঢ় ব্যক্তিত্বের মধ্যে মহামানবের বাস। রাজনৈতিক ক্ষমতাবৃত্তে জড়িয়ে না পড়লেও তাঁর মধ্যে রাজনৈতিক চেতনায় বৈপ্লবিক প্রকৃতি তাঁকে পথিকৃতের ভূমিকায় শ্রদ্ধেয় করে তোলে। সেখানে শুধু মাত্র ‘অগ্রণী চিন্তাবিদ’ বা ‘অগ্রণী চিন্তক’ বলে তাঁকে সীমাবদ্ধ করলে তাঁর আসল অস্তিত্বকেই আড়াল হয়ে যায় । তাঁর প্রবন্ধাদিই তাঁর বহুধাব্যাপ্ত মনীষার মুখপাত্র হয়ে উঠেছে । অথচ তার প্রতি বাঙালির বিমুখকতাও সমান সত্য। প্রখ্যাত সাহিত্যিক-সাংবাদিক গৌরকিশোর ঘোষ বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক আরতি সেনের সঙ্গে যৌথ সম্পাদনায় অম্লান দত্তের জীবিত কালেই তাঁর ‘প্রবন্ধ সংগ্রহ’ প্রকাশ (জানুয়ারি ১৯৯৩) করেন । ‘সম্পাদনার কথা’য় তাতে গৌরকিশোর অকপটে বইটির উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানিয়েছেন সেকথা : ‘কারণ অম্লানের কম গ্রন্থই এখন বাজারে পাওয়া যায় । যেহেতু অম্লানের রচনাদির প্রাসঙ্গিকতা সব সময়েই বর্তমান, কারণ তাঁর ভাবনা-চিন্তার ভিত্তিতে আছে আবেগহীন মৌল বিচার, অম্লানের রচনাদির সঙ্গে বাংলা ভাষার পাঠকের পরিচয় না থাকাটা সে হেতুই এক বড় ক্ষতি, এমন একটি অনুভবই আমাকে এবং আরতি সেনকে অম্লানের প্রবন্ধ সংকলনের কাজে এগিয়ে আসতে উৎসাহ দিয়েছে। স্বীকার করে নেওয়া ভাল অম্লান আমাদের দুজনেরই বন্ধু । কিন্তু এই প্রবন্ধ সংগ্রহ নিছক বন্ধুকৃত্য নয়, সেটা ছাপিয়ে আরও কিছু, সে সংবাদ এই সংগ্রহ থেকেই পাঠক পেয়ে যাবেন।’ সেদিক থেকে গৌরকিশোরের কৈফিয়তের পরতে পরতে অম্লান দত্তের লেখার প্রতি বাঙালির বিমুখতা ধরা পড়ে । অন্যদিকে অম্লান দত্তের প্রায় সমানবয়সী সুহৃদ ছিলেন গৌরকিশোর । অথচ দুজনের মতাদর্শের দুই ভিন্ন রূপ প্রকট হয়ে উঠেছে ।

১৯৭৫-এ জরুরি অবস্থার সময় গৌরকিশোর যখন তার তীব্র প্রতিবাদে মাথামুণ্ডন করে শ্রাদ্ধ করায় উগ্র হয়ে উঠেছেন,তখন অম্লান দত্ত তাঁর বিপরীতে নিরুত্তাপে থেকেছেন, ভারতের প্রকৃতিতে যে জরুরি অবস্থা অচল তা বুঝিয়ে তা থেকে বিরত হতে বলেছেন, সেই সময়টি কাজে লাগানোর কথা বলে বন্ধুদের বিয়ে করার পরামর্শ দিয়ে রসিকতাও করেছেন। এতে বন্ধুদের বিরাগভাজন হলেও নিজের সিদ্ধান্তে অবিরত অবিচল ছিলেন অম্লান । তাঁর অপ্রিয় সত্য কথনে স্বাভাবিক ভাবেই তাঁর প্রতি বিমুখতা নেমে এসেছে । তাঁর যুক্তিনিষ্ঠ নিরাবেগ ও নির্মেদ প্রবন্ধের প্রতি অনীহাও অস্বাভাবিক নয়। অথচ তিনি ইংরেজির পাশাপাশি বাংলাতেও তাঁর লেখনীকে সক্রিয় রেখেছিলেন অবিরত । একের পর এক প্রবন্ধের বই বেরিয়েছে তাঁর । ‘দেশ’, ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’ প্রভৃতি অভিজাত পত্রপত্রিকায় লিখেছেন, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বক্তব্য রেখেছেন । সেগুলি আবার বই হয়ে প্রকাশিত হয়েছে । ‘গণযুগ ও গণতন্ত্র'(১৯৬৭), ‘প্রগতির পথ'(১৯৬৮), ‘সমাজ ও ইতিহাস'(১৯৭০), ‘পল্লী ও নগর'(১৯৭৩), ‘তিন দিগন্ত'(১৯৭৮), ‘ব্যক্তি যুক্তি সমাজ'(১৯৭৮), ‘কমলা বক্তৃতা ও অন্যান্য ভাষণ'(১৯৮৪), ‘গান্ধী ও রবীন্দ্রনাথ'(১৯৮৬), ‘সমাজ সংস্কৃতি স্মৃতি'(১৯৮৭), ‘উন্নয়নের তত্ত্ব ও ভবিষ্যৎ'(১৯৮৭), ‘দ্বন্দ্ব ও উত্তরণ'(১৯৮৯), ‘শান্তির সপক্ষে'(১৯৯২), ‘বিকল্প সমাজের সন্ধানে'(১৯৯৪), ‘অন্য এক বিপ্লব'(১৯৯৯), ‘মুক্তি তোরে পেতেই হবে'(২০০২), ‘যে কথা বলিতে চাই’ ‘২০০৯’ প্রভৃতি তারই নিদর্শন । সেক্ষেত্রে তাঁকে নিছক ‘লেখক’ হিসেবে পরিচিতি প্রদানের মধ্যেই আমাদের দুর্বলতা লুকিয়ে আছে । একালে সাহিত্যিককে লেখক বলা হলেও সাহিত্যের কোনো বিশেষ শাখায় অভিহিত করতে না পেরে সামগ্রিক ভাবে লেখক বলে দায় সারাটাই সেখানে মুখ্য হয়ে ওঠে । সেখানে অম্লান দত্তের যুক্তিনিষ্ঠ তথ্যভারমুক্ত আবেগবর্জিত মননশীল চিন্তা উদ্রেকারী ভাব ও ভাষায় সম্পৃক্ত অসাধারণ প্রবন্ধগুলিও তাঁকে প্রাবন্ধিক হিসাবে সুপরিচিত দেয়নি। বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্যে তিনি উপেক্ষিত । বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে তাঁর নাম সচরাচর খুঁজে পাওয়া যায় না। সেক্ষেত্রে তাঁর লেখকসত্তাই আজ অস্বীকৃতির নামান্তর মনে হয় ।

অন্যদিকে অম্লান দত্তের অসাধারণ মনীষা যেভাবে তাঁর প্রবন্ধে আলো ছড়িয়েছে,সেভাবে বাঙালির মনে সাড়া মেলেনি । শুধু অর্থনীতিই নয়, তার সঙ্গে সমাজ-ইতিহাস ও রাজনীতি প্রভৃতি নানা বিষয়ের সম্পর্ককে সময়ের প্রেক্ষিতে নিবিড় ভাবে লেখা যুক্তিনিষ্ঠ মূল্যায়নঋদ্ধ প্রবন্ধগুলি নিছক একাডেমিক চৌহদ্দিতে আবদ্ধ থাকে না, সাধারণ্যেও আবেদনক্ষম হয়ে ওঠে । সেখানে আর্থিক ও আত্মিক উন্নয়নে শিক্ষার ভূমিকা ও তার সমস্যাও প্রাধান্য লাভ করে । শুধু তাই নয়, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি থেকে জীবনে শিল্প-সাহিত্যের ভূমিকা প্রভৃতি নানা বিষয়ে তাঁর গভীর অন্বেষা পাঠকের ভাবের ঘরে কড়া নাড়ে । অন্যদিকে তাঁর প্রবন্ধের মধ্যেই তাঁর মানবতাবাদী মনের পরিচয় সমুজ্জ্বল হয়ে উঠেছে । মানুষের সার্বিক কল্যাণে অম্লান দত্তের মননের আলোই নতুন পথের সন্ধান দেয়, সমস্যা থেকে উত্তরণের পথ দেখায়। এভাবেই তাঁর প্রজ্ঞার আলোয় সাংস্কৃতিক বিপ্লবের কথা জেগে ওঠে। উনিশ শতকে সীমাবদ্ধ নবজাগরণে নিয়ে অম্লান দত্তের কোনোরকম বিরোধিতা নেই । কেননা ইতালির নবজাগরণও সীমাবদ্ধ । অন্যদিকে উনিশ শতকের নবজাগরণকে স্বীকার করে নিয়ে তার মূল্যবোধের পূর্ণতা রক্ষা করার স্বার্থেই অম্লান দত্ত সাংস্কৃতিক বিপ্লবের কথা বলেছেন । সেখানে নগর ও পল্লির আর্থিক ও সাংস্কৃতিক সেতুবন্ধন জরুরি মনে হয়েছিল তাঁর । ১৯৭০-এই সমাজের প্রধান ব্যাধি হিসেবে তিনি আলস্য, দুর্নীতি আর কুসংস্কারকে চিহ্নিত করেন। সমাজে কুসংস্কারের মধ্যে অস্পৃশ্যতা, বর্ণবৈষম্য,জাতিভেদ প্রথা ও সাম্প্রদায়িকতার ভয়াবহ অস্তিত্বের কথা ব্যক্ত করে মানবতার সংকটকে নিবিড় করে তোলেন। সেক্ষেত্রে সাম্যবাদী আন্দোলন বা সশস্ত্র বিপ্লব নয়,চাই সাংস্কৃতিক বিপ্লব। সত্তরের রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে তাঁর ‘সমাজ ও ইতিহাস’ (১৯৭০) বইয়ের ‘সাংস্কৃতিক বিপ্লবপ্রসঙ্গে’ প্রবন্ধ তাঁর স্পষ্ট উচ্চারণ : ‘শ্রম, বিজ্ঞান ও মানবতাবোধ,দেশ গড়বার এই মূল উপাদান । সামাজিক মুক্তির কোনো ত্বরিত ও সহজ পথ নেই ।’ সেক্ষেত্রে রামমোহন ও বিদ্যাসাগরের পরে বাংলার অসমাপ্ত সাংস্কৃতিক বিপ্লব জরুরি মনে করেছেন অম্লান দত্ত ।

সত্তরের সেই অস্থিরতা সময়ান্তরে নিঃস্ব হয়ে গেলেও সেই ব্যাধিগুলি বহাল তবিয়তে অত্যন্ত সজীব ও সক্রিয় । তার অস্তিত্ব আজও আমরা বয়ে চলেছি । অথচ অম্লান দত্তের চেতাবনি আমাদের সচেতন করেনি। অন্যদিকে তাঁর যুক্তিনিষ্ঠতা তাঁকে সংকীর্ণ করেনি,বরং সব ধরনের মত ও পথের প্রতি শ্রদ্ধেয় করে তুলেছে । সেখানে তাঁর গণতান্ত্রিক উদারতা বিস্ময়কর । মনন ও হৃদয়ের সহাবস্থানে সমস্যাপীড়িত মানুষের পরস্পর বিরোধী মতকেও তিনি সমান গুরুত্বই দেননি,সত্য বলে স্বীকার করছেন। অবশ্য দ্বন্দ্বকে মেনে নিলেও তার বৈরিতাকে প্রশ্রয় দেননি। সেখানে বিরোধী মানেই শত্রু নয়। সেক্ষেত্রে সংকট থেকে উত্তরণের সুনির্দিষ্ট কোনো পথ নেই, বিভিন্নমুখী পথেই তার সুরাহা নিজেদেরই আবিষ্কার করে মানুষ এগিয়ে চলে। আসলে অম্লানের যৌক্তিক পরম্পরার মধ্যেই যেমন অসাধারণ বিশ্লেষণ বর্তমান,তেমনি সার্বিক গণতান্ত্রিক চেতনার সংশ্লেষণও সক্রিয় । স্বাভাবিক ভাবেই উগ্র ধর্মান্ধতা থেকে সক্রিয় রাজনীতির প্রকট একদেশদর্শী চেতনায় তাঁর মতো যুক্তিনিষ্ঠ অথচ মুক্তমনা মনীষীর প্রতি বিমুখতা নেমে এসেছে । অথচ তারপরেও তাঁর সফলতা ঠুনকো হয়ে পড়েনি । তাঁর উপরে রামমোহন, রবীন্দ্রনাথ, মহাত্মা গান্ধী, মানবেন্দ্রনাথ রায়, বার্ট্রান্ড রাসেল, বিনয়কুমার সরকার, আম্বেদকর প্রমুখের প্রভাব বর্তমান । তাঁদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা তাঁর লেখনীতে ঝরে পড়েছে । অন্যদিকে তাঁর সল্টলেকের ফ্ল্যাটে রবীন্দ্রনাথ ও গান্ধীজির পাশে আরও একটি ছবি রেখেছিলেন । সেটি মুহম্মদ শহীদুল্লাহের । তাঁর মতে, মুহম্মদ শহীদুল্লাহের মতো সরল ও অসাধারণ পণ্ডিত ব্যক্তি বিরল। অথচ ধর্ম ও সামাজিকতা ত্যাগ না করে শহীদুল্লাহ ধর্ম ও জ্ঞানের সমন্বয়ে বাঙালি ও বাংলা ভাষাকে ভালোবেসে আপন করে নিয়েছিলেন। সাধারণ মানুষ তাঁকে পীরের মতো শ্রদ্ধা করতেন। অম্লান দত্তের ক্ষেত্রেও সেকথা প্রযোজ্য । তিনিও মনেপ্রাণে অসাম্প্রদায়িক ছিলেন । তাঁর ফ্ল্যাট যে মেয়েটি ঘরকন্নার কাজ করে দিয়ে যেত তার নাম জোরা,ধর্মে মুসলিম । তাঁর নিঃসঙ্গ জীবনযাপনও ছিল সরল,সাদাসিধে। সাধারণের সঙ্গে সহজে মিশতেন। নীরবে নিভৃতচারী হয়েও অম্লান দত্ত তাঁর আমূল মানবতাবাদের ব্রতে সক্রিয় ছিলেন আজীবন । প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে তসলিমা নাসরিনকে সরাসরি সমর্থন জানিয়েছেন তিনি। তার জন্য তাঁকে অশ্রদ্ধার শিকার হতে হয়নি। এতটাই তাঁর প্রতি মান্যতাবোধ বাঙালির, ভাবা যায়! সেক্ষেত্রে তাঁর মতাদর্শের প্রতি বিমুখ হলেও বাঙালি তাঁকে সম্মান ও শ্রদ্ধা করতে দ্বিধা করেনি,বরং বিশ শতকের দুই বাংলার মনীষীর গৌরবে আপন করে নিয়েছে দ্বিধাহীন চিত্তে । অথচ শতবর্ষেও তাঁর প্রতি বিস্ময়কর বিমুখতা লক্ষ করা যায়!

Advertisement