• facebook
  • twitter
Monday, 13 January, 2025

মেলার পার্বণ

পার্বণ মানে ‘পর্ব সম্মন্ধীয়’ বা ‘উৎসব’। পার্বণ কথাটা এসেছে ‘পর্ব’ শব্দ থেকে। পর্ব মানেও উৎসব। ‘পালপার্বণ’ মানে উৎসব দিবস। আমাদের বাংলায় গোটা শীতকালটা উৎসব মুখর। এই উৎসবের প্রধান অঙ্গ মেলা। এই সময় বঙ্গদেশে এত মেলা হয় যে, শীতকালটাকে মনে হয় মেলার পার্বণ। শীতকালের বিভিন্ন মেলার হদিস দিয়েছেন সুখেন্দু হীরা।

মুকুটমণিপুরে পরেশনাথ মেলা। (ইনসেটে) দক্ষিণ সাঁকরাইলের বড়পীর বাবার মেলা। নিজস্ব চিত্র

ছেলেবেলায় মেলা মানে বুঝতাম রথের মেলা। এই রথের মেলা বসত বেলঘরিয়া রথতলায় বি.টি. রোডের দুধারে। রথের রশি টানাতে আগ্রহ ছিল না। সে তো আমরা পাড়ায় টেনে নিতাম। কারণ প্রত্যেকের একটি করে ছোটো কাঠের রথ থাকত। কারও একতলা, কারও দোতলা, কারও তিনতলা। তাতে মেলায় কেনা মাটির ছোটো ছোটো জগন্নাথ, বলরাম, সুভদ্রা চাপিয়ে রথ টানতাম।

আমার মেলার মূল আকর্ষণ ছিল মাটির পুতুল। এজন্য মেলার এক সপ্তাহ আগে থেকে ভালো ছেলে হয়ে যেতাম। না হলে বাবা পুতুল কিনে দেবেন না! বহুদিন পর্যন্ত বাবার হাত ধরে মেলায় গিয়েছি। বাবা আমাদের বায়না মতো কিছু পুতুল কিনে দিয়ে, কিলো দুয়েক ফজলি আম ও একটা কাঁঠাল কাঁধে তুলে নিতেন। বহুদিন পর্যন্ত জানতাম না ‘রথেরমেলা’ ছাড়াও অন্যান্য মেলা হয়।

তারপর হাইস্কুল লাইফে দেখলাম আড়িয়াদহ বিন্ধ্যবাসিনী তলায় বিন্ধ্যবাসিনী মেলা। পাশেই ছিল আমাদের স্কুল। স্কুল ফেরত বা কোচিং ফেরত মাঝে মাঝে ঢু মারতাম। এই মেলা জামাই ষষ্ঠীতে শুরু হয়। কলেজ লাইফে দেখেছিলাম বিটি রোডের উপর টবিন রোডে পয়লা বৈশাখের সময় মেলা বসত। কিন্তু কোনও দিন নেমে দেখিনি। এখন আর টবিন রোডে মেলাটা বসে না। শুনেছি মেলাটা নেতাজি কলোনির মাঠে চলে গেছে।

আমাদের দেশ বাড়ি ছিল নদীয়া জেলার এক প্রান্তিক গ্রামে। সেটা ছিল উত্তর ২৪ পরগনা জেলার লাগোয়া। আমাদের প্রতিবেশী গ্রামে হত চৈত্র সংক্রান্তিতে চড়ক মেলা। এখনও হয়। সেই গ্রামটা ছিল উত্তর ২৪ পরগনা জেলার মধ্যে। সেই মেলাও দু-একবার দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। সেই মেলাতে পিঠে বড়শি বেঁধে চড়ক ঘুরত, আগের দিন রাতে হাজরা নাচ হত, অষ্টক নাচ হত। আর মেলায় ঘোরার মজা তো ছিলই।

তারপর মনে হয় দেখেছিলাম দোলের দিন কল্যাণী ঘোষপাড়ায় সতীমায়ের মেলা। আমাদের বাসার কাছে আর একটা মেলা হত, তা হল পয়লা জানুয়ারিতে দক্ষিণেশ্বরে কল্পতরু মেলা। তখন কল্পতরু মেলার ভিড়ের কথা শুনে কোনও দিন যায়নি। পরে অবশ্য গিয়েছি।
এছাড়া তখন কলকাতা ময়দানে অনেক মেলা বসত, গ্রন্থ মেলা, বইমেলা, শিল্প মেলা, হস্তশিল্প মেলা, চর্মশিল্প মেলা (লেক্সপো), বিদ্যাসাগর মেলা ইত্যাদি। মেলাগুলোর অনেক গুলো এখনও হয়। তবে এখন আর ময়দানে হয় না। কলকাতার চারপাশে ছড়িয়ে গেছে।
এরমধ্যে প্রিয় ছিল বইমেলা। বইমেলা যাওয়ার আগ্রহ ছিল কিশোর বয়স থেকেই। প্রথম বইমেলা যাই ক্লাস নাইনে উঠে, বাবার হাত ধরেই। প্রথমবার মেলায় গিয়ে সে কী উত্তেজনা। প্রতিটি দোকান (স্টল) যেন এক একটা লাইব্রেরি। হরেক রকমের কত বই! এই বইমেলা হত শীতের শেষ দিকে। এখনও একই সময়ে হয়।

শীতকালে মেলার মজাই আলাদা। ছেলেবেলা পর্যন্ত শীতকালে দেখা মেলা ছিল বইমেলা। আর একটা শীতকালের মেলা দেখেছিলাম গঙ্গাসাগর মেলা। যখন এই মেলা দেখেছিলাম, তখন ছেলেবেলা কেটে গিয়েছে। কিন্তু গঙ্গাসাগর মেলার কথা শুনেছিলাম ছোটবেলা থেকেই। রবীন্দ্রনাথের ‘কথা ও কাহিনী’তে পড়েছিলাম ‘দেবতার গ্রাস’ কবিতা। আর তাতে রাখালের গঙ্গাসাগরে বিসর্জনের গল্প বুক কাঁপিয়ে দিয়েছিল।
ছেলেবেলা কেটে যাওয়ার পর যখন চতুর্দিকে চোখ রাখতে শিখলাম, তখন জানতে পারলাম শীতকালেই সবচেয়ে বেশি মেলা হয়। শীতকালে মেলা হওয়ার প্রধান কারণ, শীতকালের আবহাওয়া। শীতকালে ঝড় বৃষ্টি সম্ভাবনা কম। তাই মেলা পণ্ড হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে। তার ওপর মেলার জন্য প্রয়োজনীয় জায়গা অর্থাৎ মাঠ, পথের ধার, ফাঁকা ও শুষ্ক পাওয়া যায়।

কারণ বর্ষাকালে ও বর্ষার পরে গ্রাম বাংলার পথে ঘাটে কাদা থাকে। যদিও এখন গ্রামের অধিকাংশ পথ পাকা, বাঁধানো। কিন্তু মাঠ হয় জলে ভরা, নয় চাষের ফসলে। তাই মেলা বসানোর জায়গা পাওয়া যায় না। বর্ষার পর শরৎ-হেমন্ত কাটলে মাঠ ঘাট শুকনো হয়। জমির ফসল কাটা হয়ে গেলে মাঠ ফাঁকা হয়। ফসল শূন্য ফাঁকা মাঠে গ্রাম বাংলার ছেলে-মেয়েরা গ্রামীন খেলাধুলা শুরু করে। আর এই ফাঁকা মাঠে মেলা বসতেও সুবিধা হয়। যদি চাষের মাঠ নাও হয়, সাধারণ ডাঙা জমি বা খেলাধুলার মাঠ হলেও শীতকালে জমির রস শুকিয়ে মেলা বসার উপযুক্ত হয়।

বঙ্গদেশ কৃষি বর্ষা নির্ভর। বর্ষার শেষে ও শীতের শুরুতে কৃষিজীবী বাঙালি লেগে পড়ে রোপন ও বপন করা ফসল ঘরে তুলতে। সমস্ত ফসল যখন কৃষকের গোলায় ঢুকে গেল, কৃষকের মনে তখন অপার আনন্দ। তখন চাষের কাজে সাময়িক বিরতি। তার ওপর কৃষিজ ফসল বিক্রি করে বাঙালির হাতে চলে এসেছে কিছু অর্থ। মনে আনন্দ, হাতে পয়সা, আর কী? চল এবার আনন্দে মাতি।

সবাই মিলে আনন্দ করার সেরা ব্যবস্থাপনা উৎসব। শীতের শুরুতে নবান্ন, নতুন ধান উঠলে পিঠে পুলি, পৌষ সংক্রান্তিতে গঙ্গাস্নান, পয়লা মাঘে লৌকিক আরাধ্য দেবতার পূজা ইত্যাদি ইত্যাদি।

বিশেষজ্ঞরা বলেন, আগে মাঘ মাস থেকে বছর শুরু হ’ত। তাই বছরের প্রথম দিন আপামর জনগণ তাঁদের আরাধ্য দেবতার পূজা করত। এজন্য গ্রাম বাংলায় পয়লা মাঘে সবচেয়ে বেশি লৌকিক দেবতার পূজা হয়। কোনও পূজাতে যদি অনেক লোক অংশগ্রহণ করে তা হয়ে ওঠে উৎসব। আর উৎসবকে ঘিরে কোথাও কোথাও বসে যায় মেলা।

চাষের কাজে অবসর, ঘরে নতুন ফসল, হাতে ফসল বেঁচা কিছু পয়সা, মনোরম আবহাওয়া; সবমিলিয়ে বাঙালি এই সময় খেলা, মেলায় মেতে থাকে। এই সময় বাঙালি ক্রিকেট খেলে, তীর্থ করতে যায়, ঘুরতে যায়, বনভোজন করে, মহোৎসব করে, আর মেলায় মেলায় ঘুরে বেড়ায়।
গ্রামবাংলায় দেখা যায় মাঘ মাসে বেশি মেলা হতে। কারণ আগেই বলা হয়েছে গোলায় ধান, মনে স্ফূর্তি, ট্যাঁকে কড়ি। তার ওপর চাষের সময় চাষের খরচ জোগাতে, শারদীয়াতে সকলের বস্ত্রের ব্যবস্থা করতে, সাধারণ মানুষের হাত শূন্য হয়ে যায়। হেমন্তের শেষে ফসল ঘরে উঠলে মানুষের হাতে টাকা আসে। তখন তা দিয়ে সে আমোদ-প্রমোদ করার বিলাসিতা দেখাতে পারে। পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিমাঞ্চলের জঙ্গলমহলে অনেক জায়গায় দুর্গাপূজার সময় নতুন জামা কাপড় কেনেন না। তাঁরা নতুন জামা পরেন মকর সংক্রান্তির সময়।

যাইহোক, সবমিলিয়ে পৌষ ও মাঘ মাসে পশ্চিমবঙ্গে যা মেলা হয়। তা অন্য কোনও সময় আর হয় না। শুধু তাই নয় কোথাও কোথাও পৌষ মাস বা মাঘ মাস জুড়ে একমাস ধরে মেলা চলে। যেমন‌–মূলাজোড় কালীবাড়ি। শিয়ালদহ – রানাঘাট শাখার শ্যামনগর রেল স্টেশনের পশ্চিমে গঙ্গার তীরে মূলাজোড় কালীবাড়ি। এখানেই পৌষ মাস ব্যাপী কালীমেলা। মূলাজোর গ্রামের ব্রহ্মময়ী মাকে ঘিরেই এই মেলা। তাই কোনও একদিন পৌষের সকালে বা বিকালে শিয়ালদহ থেকে ট্রেন ধরে নিলেই হল। বা যে যেদিক থেকে আসবেন।

বনগাঁ সাতভাই কালীতলাতে ইছামতীর ধারে পৌষমাস জুড়ে মেলা থাকে। পৌষমাস জুড়ে মেলা থাকে বলে এটা পৌষমেলা বলে খ্যাত। এই পৌষ মেলা দেখার নাম করে সীমান্ত শহর বনগাঁ, বনগাঁর কাছে চালকি-বারাকপুর-এ বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্মভিটে, ঐতিহাসিক রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাস্তবভিটে, পারমাদান অরণ্য ঘুরে আসতে পারেন।

দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলার ভাঙ্গড় থানার অধীন শাঁকশহরে মাঘ সাস ধরে চলছে বাবনপীরের মেলা। সোনারপুর – ঘটকপুর সড়ক পথে শাঁকশহর একটি বড় গঞ্জ। শাঁকশহরে প্রচুর দোকান পাট, বাজার। এখানেই আছে বাবনপীরের মাজার। পৌষ সংক্রান্তির আগের দিন শুরু হয় ফকির আড্ডা। বাবা সম্ভবত এদিন দেহ রেখেছিলেন। মেলার বয়স আনুমানিক আড়াইশো বছর। মেলাতে বিখ্যাত পণ্য ‘কদমা’। ছোট থেকে বড় সব সাইজের কদমা পাওয়া যায়। কদমা মেলাতেই তৈরি হয়।

হাওড়া জেলার জগৎবল্লভপুর থানার অধীন মুন্সিরহাটে খরদা বামুনপাড়াতে আছে ফতে আলী পীরের মাজার। হাওড়া আমতা রুটে বাঁকড়া, ডোমজুড়, জগৎবল্লভপুরের পর মুন্সিরহাট। এখানে মাঘমাস জুড়ে মেলা বসে।

হুগলি জেলার পাণ্ডুয়াতে বসে ‘মাঘমেলা’। ব্যান্ডেল-বর্ধমান শাখার পাণ্ডুয়া স্টেশনের কাছে আছে পাণ্ডুয়া মিনার। আগে এই মিনারের চারপাশে মেলা বসত। এখন মেলাটি ডিভিসি ক্যানেলের ধারে বোসপাড়া পাণ্ডুয়া ব্রিজের কাছে বসছে। এই মেলাতে বিশাল আকৃতির গজা পাওয়া যায়। ভেঙে ভেঙে কিনতে হয়।

কোথাও আবার বসে সাপ্তাহিক মেলা। পৌষ ও মাঘ মাসের প্রতি শনি, মঙ্গল বা বৃহস্পতিবার এই সাপ্তাহিক মেলা বসে। যেমন পৌষ মাসে‌ মুর্শিদাবাদ জেলার বহরমপুর শহরের বিষ্ণুপুর কালীবাড়ি মন্দিরে ও নবগ্রাম থানার কিরীটেশ্বরী মন্দিরে প্রতি শনি-মঙ্গলবার মেলা বসে।
বীরভূমের মল্লারপুর থানার ঘোষগ্রামে পৌষ মাসের প্রতি বৃহস্পতিবার লক্ষীমেলা বসে। ঘোষগ্রামে একটি প্রাচীন লক্ষ্মী মন্দির আছে, যদিও মন্দিরটি বর্তমানের নতুন ভাবে তৈরি করা হয়েছে। মন্দিরে আছে একটি প্রাচীন দারু বিগ্রহ।

হাওড়া জেলার সাঁকরাইল থানার অধীন দক্ষিণ সাঁকরাইল গ্রামে গঙ্গার ধারে আছে বড় পীর বাবার মাজার এটি হলো সুন্নি মুসলিম ধর্ম প্রচারক আব্দুল কাদের জিলানীর নজরগাঁ। এখানে মাঘ মাসের প্রতি শনি ও মঙ্গলবার প্রচুর ভক্ত সমাগম হয়, তাই মেলা বসে। ভক্তরা এসে রান্নাবান্না করে খায়, সারাদিন কাটিয়ে সন্ধ্যায় ফিরে যায়।

বাংলায় পৌষ সংক্রান্তিতে হয় বিখ্যাত সব মেলা। যার মধ্যে বৃহত্তম হচ্ছে গঙ্গাসাগর মেলা। আরেক জনপ্রিয় মেলা বীরভূমের জয়দেবের কেন্দুলী মেলা। বাঁকুড়া জেলা সহ জঙ্গলমহলের জেলাগুলিতে এই সময় হয় তুষু মেলা। পৌষ সংক্রান্তির দিন বাঁকুড়ার খাতরা থানার পরকুল, হীরবাঁধ থানার দেউলি গ্রামে তুষু ভাসানো উপলক্ষে মেলা বসে। মুকুটমণিপুর ড্যামের ধারে এদিন পরেশনাথের মেলায় প্রচুর জনসমাগম হয়। এটিও একটি তুষুমেলা।