বাঁকুড়ার বারুণী

বারুণী তিথি হল দোল পূর্ণিমার পর কৃষ্ণ পক্ষের ত্রয়োদশী তিথি৷ বারুণী তিথি স্নানের জন্য বিখ্যাত৷ বারুণী তিথি যদি শনিবার পড়লে, তাকে ‘মহাবারুণী’ বলে৷ আগামী শনিবার বারুণী, তাই এবারের বারুণী মহাবারুণী৷ বাঁকুড়া জেলার কয়েকটি বারুণী মেলার হদিস দিয়েছেন সুখেন্দু হীরা৷

‘বারুণী’ শব্দের আভিধানিক অর্থ বরুণ সম্বন্ধীয়৷ বরুণ জলের দেবতা৷ আবার বরুণের শক্তি অর্থাৎ স্ত্রী হলেন বারুণী৷ ইনি সমুদ্রমন্থনজাতা এবং সুরার অধিদেবতা৷ বারুণী হল শতভিষা নক্ষত্র যুক্ত চৈত্র কৃষ্ণ ত্রয়োদশী তিথি৷ সোজা হিসাবে দোল পূর্ণিমার পরের ত্রয়োদশী তিথি হল ‘মধুকৃষ্ণা ত্রয়োদশী’৷ মধু বলতে এখানে চৈত্র মাস৷

বারুণীর আর একটি অর্থ হল, জলে অবগাহনপূর্বক স্নান৷ বারুণী তিথি স্নানের জন্য বিখ্যাত৷ স্কন্দ পুরাণে আছে বারুণী তিথিতে গঙ্গা স্নান করলে একশত সূর্যগ্রহণ তুল্য স্নানের সমান পুণ্যপ্রদ৷ আবার বারুণী তিথি যদি শনিবার দিনে পডে়, তাহলে সেদিন গঙ্গাস্নান কোটি সূর্যগ্রহণকালীন স্নানের সমান ফলপ্রদ৷ এই কারনে বারুণী শনিবার পড়লে, তাকে ‘মহাবারুণী’ বলে৷ আগামী শনিবার বারুনী, তাই এবারের বারুণী মহাবারুণী৷ যদি আবার সেদিন শনিবারের সঙ্গে শুভযোগ থাকে তাহলে বলে ‘মহামহাবারুণী’৷


যাইহোক হিন্দু ধর্মে বারুণী তিথিতে স্নান পুণ্যস্নান৷ বঙ্গের যেখানে গঙ্গা নেই, সেখানে ভক্তরা নদীতে, জলাশয়ে, ঝর্ণায় স্নান করে নেয়৷ বারুণী তিথিতে সবচেয়ে বড় উৎসব হয়, উত্তর চব্বিশ পরগনা থানায় গাইঘাটা থানার ঠাকুরনগরে৷ সেখানে মতুয়া ধর্মের প্রবর্তক শ্রীশ্রী হরিচাঁদ ঠাকুরের আবির্ভাব তিথি পালন করা হয়৷ সেখানের কামনা সাগরে বারুণী স্নান সারে ভক্তরা৷ এই উপলক্ষে বিশাল মেলা বসে৷

বাঁকুড়া জেলাতেও বারুণী স্নান উপলক্ষে অনেক জায়গায় মেলা বসে৷ তার মধ্যে ছাতনা থানার শুশুনিয়ার ‘ধারামেলা’ বিখ্যাত৷ জয়পুর থানার ময়নাপুরে বারুণীর সময় মেলা বসে, কিন্ত্ত কোনও স্নান হয় না৷ এই মেলাটিকে ‘হাকন্দ মেলা’ বলে৷ ময়নাপুর ধর্মরাজের পূজাপদ্ধতির প্রবর্তক রামাইপণ্ডিতের বাসস্থান৷ স্নান না হলেও সংকীর্তন হয়৷ সংকীর্তন প্রায় সব বারুণী মেলাতে দেখা যায়৷ অনেক বারুণী মেলায় দেখা যায় লৌকিক দেবদেবীর পূজা হতে৷

বাঁকুড়া জেলার কয়েকটি বারুণী মেলার হদিস এখানে দেওয়া হল৷
শুশুনিয়ার বারুণী মেলা: শুশুনিয়া গ্রাম পঞ্চায়েত, ছাতনা থানা:
বাঙালি পাহাড় দেখা শুরু করে শুশুনিয়া পাহাড় দিয়ে৷ এজন্য শুশুনিয়া একটি জনপ্রিয় ‘টু্যরিস্ট স্পট’৷ শুশুনিয়া পাহাড় জনপ্রিয় হওয়ার প্রধান কারণ পাহাডে়র গায়ে একটি প্রস্রবণ৷ স্থানীয় বাসিন্দারা এটাকে ধারা বলে৷ বারুণী তিথিতে এই ধারায় স্নান করার হিডি়ক পডে় যায়৷ ভোরবেলা থেকে দুপুর বারোটা/একটা পর্যন্ত প্রচুর লোক সেদিন স্নান করে৷ স্নান করে মেলা দেখে বাডি় ফেরে৷

এই বারুণী স্নান উপলক্ষে একটি মেলা বসে৷ সরকারিভাবে চার দিন মেলা অনুমতি থাকলেও মেলা এক-দু’দিন বেশি থেকে যায়৷ এমনিতে শুশুনিয়া পাহাডে় ঝরনা তলায় সারা বছর মেলার পরিবেশ৷ প্রচুর পাথরের দোকান অর্থাৎ পাথর খোদাই শিল্পীদের দোকান৷ অন্যান্য হস্তশিল্পের দোকানও থাকে৷ মেলার সময় আরও দোকান আসে৷ শুশুনিয়া অফিস মোড় (যা সুভাষ মোড় নামে পরিচিতি) থেকে ঝরনা তলা পর্যন্ত প্রচুর দোকান বসে৷ এত দোকান আসে যে সারা বছর যে পাথরের দোকানদাররা থাকেন, তাঁরা তাদের পসরা তুলে দিয়ে অন্য দোকানদারদের ভাড়া দেন৷ খাবারের দোকান, মনিহারি দ্রব্যের দোকান, নাগরদোলা, মরনকূয়া কী আসে না!

এই মেলাকে অনেকে ধারামেলাও বলেন৷ মেলা আয়োজন করে শুশুনিয়া গ্রাম পঞ্চায়েত৷ এই মেলা শুরু হয়েছে আনুমানিক ২০০ বছর আগে৷ এই মেলা উপলক্ষে পাশের দুটি আদিবাসী গ্রাম কুশবনা ও রামচন্দ্রপুরে আদিবাসী যাত্রা হয়৷ শুশুনিয়া গ্রামেও মেলার সময় কোনও কোনও বছর যাত্রা হয়৷ ঝরনা তলার কাছে একটি কালীমন্দির আছে, সেখানে মেলা চলাকালীন অমাবস্যার সময় কালীপুজো হয়৷ ঝরনার সামনে একটি হরিসভা আছে৷ সেখানে বারুণীর দিন অর্থাৎ মধুকৃষ্ণ ত্রয়োদশীতে কীর্তন হয়৷ তাই এই সময় প্রচুর ভক্ত সমাগম হয়৷ সবমিলিয়ে শুশুনিয়া চত্বর কদিন লোকে লোকারণ্য থাকে৷

সান্তোর গ্রামের বারুণী: সান্তোর গ্রাম পঞ্চায়েত, ওন্দা থানা:
সান্তোর গ্রামে একটি ৬০ বিঘার বড় পুকুর আছে৷ এই পুকুরের নাম ঘুঁটিয়াপুকুর৷ কারণ পুকুর পাডে় একটি ঘুঁটিয়াবুডি়র মন্দির আছে৷ এই ঘুঁটিয়াবুডি়র বার্ষিক পূজা বারুণী তিথিতে৷ সেদিন অনেকে মানত করে পূজাপাশা করেন৷ এমনি সময়ে অনেকে পূজা দেন৷ তার আগে পুকুরের স্নান করে নেয়৷ বারণী উপলক্ষে ওই পুকুরে প্রচুর লোক স্নান করেন৷ অনেকে বিশ্বাস এই পুকুরে মাথায় ঘুঁটে নিয়ে ডুব দিলে গায়ের চুলকানি, খোশ-পাঁচড়া, ফোঁড়া ইত্যাদি ভালো হয়ে যায়৷ মাথায় ঘুঁটে নিয়ে ডুব দিতে হয় বলে মায়ের নাম ঘুঁটিয়াবুডি়৷

এদিন ভক্তরা স্নান করে, পূজা দিয়ে, মেলা ঘুরে বাডি় ফেরে৷ স্নান করতে প্রচুর জনসমাগম হয় তাই পুকুরপাডে় ও রাস্তার ধারে প্রচুর দোকানদানি বসে৷ একদিনের মেলা৷ স্নান শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রায় সকাল সাতটা নাগাদ মেলা বসে যায়৷ দুপুর পর্যন্ত স্নান চলে৷ মেলা চলে অবশ্য রাত দশটা পর্যন্ত৷ বাডি় থেকে ভক্তরা মুডি় নিয়ে আসে৷ মেলা থেকে ঘুগনি ও জিলিপি কিনে মুডি় মেখে খায়৷ স্থানীয় লোকজন বললেন মেলার বয়স আনুমানিক ১৫০ বছর৷

কালপাথর গ্রামের বারুণী: ভেদুয়াশোল গ্রাম পঞ্চায়েত, ইন্দপুর থানা৷
কালপাথর গ্রামের প্রান্তে জয়পণ্ডা নদীর ধারে, জাম ও অর্জুন গাছের নীচে ছেঁদাসিনি দেবীর থান৷ একদিন এক ‘বর’ যাত্রী সহ বিবাহ করতে চাচ্ছিলেন৷ জয়পণ্ডার ধারে এসে গেলেন আটকে৷ নদীতে প্রচুর জল৷ মনে মনে ছেঁদাসিনি ঠাকুরের কাছে প্রার্থনা করে, “মা যদি নদীর জল শুকিয়ে যায়, তোমাকে আলতা, শাডি় দেব”৷ নদীর জল শুকিয়ে গেল৷ বিয়ে করে ‘কনে’ নিয়ে এই পথেই ফিরছিলেন৷ নদীর মাঝ পর্যন্ত চলে আসেন৷ কিন্ত্ত তিনি যে মানত করেছিলেন তা গেলেন ভুলে৷ অমনি হরকা বান এসে তাঁদের ভাসিয়ে নিয়ে গেল৷ ছেঁদাসিনি মা এতটাই জাগ্রত৷ পাথরের ওপর পালকি সমেত বর কনের ছাপ আছে৷ বর্তমানে পাথর ভেঙে নিয়ে যাওয়ার দরুন শুধু পালকির ছবিটি দেখা যায়৷

ছেঁদাসিনি মায়ের বর্তমানে পূজা করেন মঞ্জু মাল৷ এই মাল পরিবার বংশ পরম্পরায় পূজা করে আসছেন৷ নিত্য পূজা হয়না৷ প্রতি সংক্রান্তিতে পূজা হয়৷ তবে কেউ যদি মানসিক শোধ করতে পূজা দিতে চান, তাহলে পূজা দিতে আসতে পারেন, যে কোনও দিন৷ কিন্ত্ত আগে থেকে বলতে হবে, কারণ পূজোর দিন পুরোহিতকে উপোস করে থাকতে হয়৷ মায়ের নৈবেদ্য দেওয়া হয় শালপাতায়৷ মায়ের জন্য লাগে ‘বড় ভোগ’ অর্থাৎ ‘দেশি মদ’ ও ‘গাজা’৷ ছাগল, হাঁস, মুরগি, পায়রা মানসিক অনুযায়ী বলি হয়৷ বলিদেয় পূজারী বা তাঁর পরিবারের লোক৷ বলি দেওয়ার সময় পূজারীর ভর আসে৷ সে সময় তিনি ভবিষ্যৎবাণী বা কোনও প্রশ্ন করলে সমাধান বলে দেন৷ তিনি এছাড়া আশীর্বাদপূত মাদুলি প্রদান করেন৷ পূজার স্নান করে এলে প্রসাদ দেন পাকা কলা৷ বিবাহ, সন্তান কামনা এসবের মানত বেশি করে লোকজন৷

ছেঁদাসিনি মায়ের বার্ষিক পূজা চৈত্র মাসের কৃষ্ণপক্ষের ত্রয়োদশী তিথি অর্থাৎ বারুণী স্নানের দিন৷ এদিন সকালে সমস্ত ভক্তরা এসে জড়ো হয় জয়পণ্ডা নদীর ধারে৷ মাথায় ঘুঁটে রেখে নদীর জলে ডুব মারে৷ ভক্তদের বিশ্বাস মাথায় ঘুঁটে নিয়ে স্নান করলে খোসপাঁচরা, চুলকানি ভালো হয়ে যায়৷ এজন্য প্রচুর লোক এদিন স্নানে আসে৷ থানের সামনের পরিষ্কার জল কাদাগোলা হয়ে যায়৷ এজন্য এই বারুনীকে অনেকে ‘ঘুঁটে বারুণী’ বলে৷

স্নান সেরে ছেঁদাসিনি থানে পূজা দেয়৷ তারপর মেলা ঘুরে বাডি়৷ আগে মেলা হত একদিন৷ ৫০/৬০ বছর হলো মেলা পাঁচ দিনের হয়েছে৷ কারণ পাঁচ দিন ধরে চলে সংকীর্তন৷ যা পঞ্চরাত্রি বলে খ্যাত৷ আমাদের দেশের সমস্ত লৌকিক দেবদেবীর পূজা এভাবে ‘হাইজ্যাক’ হয়ে গেছে আর্য সভ্যতা তথা ব্রাহ্মণ্যবাদের দ্বারা৷ লৌকিকদেবী হলে তাকে দেবী দুর্গার রূপ বলে শাক্তপূজা শুরু করে দেয়, অথবা সেখানে সংকীর্তন ঢুকিয়ে বৈষ্ণব প্রভাব আনা হয়৷

এই সংকীর্তন বা পাঁচ দিনের মেলার প্রচলন করেছিলেনঁবিষ্ণুপদ লায়েক মহাশয়৷ তিনি পেশাগত জীবনে ছিলেন ব্যাঙ্ক কর্মী৷ পরে এই অকৃতদার ব্যাক্তি জয়পণ্ডা নদীর তীরে এসে সাধুর জীবন কাটাতেন৷ তিনি মারা যাওয়ার পর স্থানীয় তিন-চারটে গ্রামের লোকজনকে নিয়ে মেলা কমিটি গঠন করা হয় মেলার সময়৷
মেলাতে নানা খাবার দ্রব্য, হরেক মালের ‘এত’ টাকা, নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র পাওয়া যায়৷
বালিঠ্যা গ্রামের আমবারুণী: লেগোগ্রাম পঞ্চায়েত, কোতুলপুর থানা:

বালিঠ্যা গ্রামের বসন্তচণ্ডী মা ভীষণ জনপ্রিয় ও জাগ্রত৷ বালিঠ্যা সহ আশেপাশের গ্রামগুলো ‘বড়মা’ময়৷ বসন্তচণ্ডী মাতা এখানে বড়মা বলে খ্যাত৷ শুধু আশেপাশের গ্রাম নয় দূরদূরান্তের গ্রামের লোকেরা অবলা পশু, বিশেষত গরুর রোগভোগ হলে বড় মায়ের নামে মানত করে৷ এই বলে মানত করেন, বিপদমুক্তি হলে মায়ের ভোগ রান্নার জন্য কাঠ নিয়ে আসবেন৷ তাই দোসরা মাঘ ভক্তরা গরুর গাডি়তে কাঠ বোঝাই করে হাজির হন মায়ের মন্দিরে৷ দোসরা মাঘ হল বড়মায়ের “ভোগ মেলা”৷

অবলা পশুর সুস্থতার জন্য বড়মার মানত অব্যর্থ৷ গরুর যখন ন’ মাস গর্ভবতী থাকে তখন গৃহস্থ গরুর জন্য ‘গোলানি’ করিয়ে নিয়ে যায় মায়ের মন্দির থেকে৷ পাটের তৈরি গোলানিটা গরুর গলায় পরিয়ে দেয়৷ আর গরু বিয়োলে গৃহস্থ দুধ দিয়ে যায় মন্দিরে৷ বসন্তচণ্ডী মায়ের এমন একদিনও যায় না, যেদিন কোনও দুধ আসে না৷ মা প্রতিদিন ভক্তদের দেওয়া দুগ্ধে স্নান করেন৷

মায়ের মন্দিরের সামনে মায়ের পুকুর আছে৷ সেই পুকুরে বারুণী তিথিতে সর্বজনীন স্নান হয়৷ ভক্তরা মাথায় আম নিয়ে ডুব মারে৷ এজন্য এই বারুণীকে অনেকে ‘আমবারুনী’ বলে৷ আগে ভক্তদের বিশ্বাস ছিল মাথায় আম নিয়ে মায়ের ঘাটে ডুব মারলে বসন্ত রোগ ভালো হয়ে যায়৷ বসন্ত রোগের প্রকোপ এখন অতটা নেই, তবে স্নান করার প্রথাটা রয়ে গেছে৷

শুধু গরুর জন্য মানত নয়, নিজের সুস্থতা কামনা করেও মানত করেন ভক্তরা৷ দেহের কোনও অঙ্গে ব্যথা থাকলে তেল পড়া নিয়ে যায়৷ ব্যথা ভালো হয়ে গেলে সেই অঙ্গে ধুনা পোড়ায়৷ অর্থাৎ সেই অঙ্গের ওপর সরা রেখে তাতে আগুন ধরিয়ে ধুনা দেয়৷ বারুণী তিথিতে এই সব ভক্তরা স্নান করে ধুনা পুডি়য়ে মানসিক শোধ করেন৷

আমবারুনী উপলক্ষে মায়ের আট চালাতে ২৪ প্রহর সংকীর্তন হয়৷ এই তিন দিন ধরে চলে মেলা৷ এই মেলা দোসরা মাঘের ভোগমেলার মতো বড় না হলেও বেশ জনপ্রিয়৷ অনেক সময় কেউ মানসিক করলে সংকীর্তন এক/দুদিন বৃদ্ধি পায়৷ তখন মেলাও দু-এক দিন বেডে় যায়৷

বসন্তচণ্ডী মা আগে ছিলেন গ্রামের ভূস্বামী রায়দের ঠাকুর৷ শোনা যায় রায় বংশের সিংহরাম রায় মায়ের প্রতিষ্ঠা করেন৷ বড়মায়ের বংশ পরম্পরায় পূজা করে আসছেন চৌধুরী পরিবার৷
কৃষ্ণনগর গ্রামের বারুণী: বড়জোড়া গ্রাম পঞ্চায়েত, বড়জোড়া থানা৷

কৃষ্ণনগর গ্রামটি দামোদর নদের ধারে অবস্থিত৷ নদের ধারে আছে রণরঙ্কিনী দেবীর থান৷ মাকে ঘিরে আছে শাখা পরার সেই জনপ্রিয় কিংবদন্তী৷ দামোদরের উত্তর পাডে় দুর্গাপুরের কোকওভেন থানার অধীন নডিহা গ্রামে মুখার্জি পরিবারের এক ব্যক্তির কোনও কন্যা সন্তান ছিলনা৷ তাঁর কন্যা পরিচয় দিয়ে মা রঙ্কিনী দামোদরের ঘাটে এক শাঁখারির কাছ থেকে হাতে শাঁখা পরে৷ শুধু তাই নয় দুর্গা মন্দিরের কুলুঙ্গিতে পয়সা রাখা আছে বলে শাঁখার দামের হদিসও দিয়ে দেন৷ শাঁখারি গিয়ে সেই ব্যক্তির কাছে শাঁখার দাবি করেন৷ সেই ব্যক্তি বলেন আমার কোনও কন্যা নেই৷ কিন্ত্ত দুর্গা মন্দিরের কুলুঙ্গিতে পয়সা পাওয়া যায়৷ সেই মুদ্রা এখনও রাখা আছে৷ তারপর সেই কন্যাকে খুঁজতে দামোদরের তীরে আসা হয়৷ তখন মা রঙ্কিনী দামোদরের জল থেকে শাঁখা পরা দুহাত তুলে দেখান৷ মায়ের শিলামূর্তি৷ পাশে প্রচুর মাটির হাতি ঘোড়া৷ নদী ভাঙ্গন ও বানের জন্য মা স্বপ্নাদেশ দিয়ে গ্রামের একটু ভেতরে চলে আসেন বারুণীতলায়৷ রণরঙ্কিনী মায়ের নিত্য পূজা হয়৷ এখ্যান পরবের দিন অর্থাৎ পয়লা মাঘ মায়ের বার্ষিক পূজা৷ সেদিন গ্রামের সবাই পূজা দিতে আসে৷ যারা মানত করে তাঁরা বলি দেয়৷

বারুণী তিথিতে গ্রামের সবাই বারুণীতলায় এসে দামোদর নদে স্নান করে মাকে পূজা দেয়৷ এই দিন গ্রামের সবাই নিরামিষ খায়৷ আশেপাশের গ্রাম থেকেও স্নান করতে আসে৷ পাশে ভৈরব তলায় আছে নিত্যানন্দ সিদ্ধ আশ্রম৷ সেখানে তিনদিন ধরে হয় কীর্তন ও বাউল গান৷ প্রচুর সাধু সমাবেশ হয়৷ সাধুদের জন্য আখড়া করে দেওয়া হয়৷ অতিথি বাউল শিল্পীরাও আসেন৷ শেষদিন ধুলট৷ নর নারায়ণ সেবা প্রতিদিন৷
এই উপলক্ষে আশ্রম চত্বরে তিন দিন মেলা বসে৷ আগে মেলা রঙ্কিনী থানের কাছে খোলা জায়গায় হত৷ ঝড়বৃষ্টির কারণে স্থান পরিবর্তন করা হয়েছে৷ আগে মেলা একদিনের হত৷ নিত্যানন্দ সিদ্ধ আশ্রম স্থাপিত হয় ১৩৭৬ বঙ্গাব্দে৷ তারপর থেকে মেলা তিন দিনের হয়ে গেছে৷ মেলায় খাবারের দোকান, খেলনাপাতির দোকান, মনিহারি দোকান, নাগরদোলা ইত্যাদি আসে৷ কৃষ্ণনগর গ্রামে এটাই সবচেয়ে বড় উৎসব৷
ডিহর গ্রামের বারুণী: উলিয়াড়া গ্রাম পঞ্চায়েতে বিষ্ণুপুর থানা৷

ডিহরের ষাঁডে়শ্বর মন্দির খুব প্রাচীন৷ ঐতিহাসিকরা বলেন ১৩৪৬ খ্রিস্টাব্দে মল্লরাজ পৃথ্বী মল্ল এই মন্দির নির্মাণ করেন৷ মন্দিরে চৈত্র সংক্রান্তের সময় গাজন হয় ধুমধাম করে৷ শ্রাবণ মাসে প্রতি সোমবার জল ঢালার ধুম পডে় যায়৷ মকর সংক্রান্তি দিন বিশেষ পূজা হয়৷

আসলে এখানে দুটি মন্দির আছে শৈলেস্বর ও ষাঁডে়শ্বর৷ শৈলেশ্বর মন্দিরে সংরক্ষণের কাজ হচ্ছে বলে শুধু এখন ষাঁডে়শ্বর বাবার মাথায় জল ঢালা হয়৷ দুটি মন্দির একই সময় নির্মিত৷ দুটি মন্দিরে চূড়া নেই৷ অনেকে বলেন চূড়া প্রথম থেকে ছিল না৷ জনশ্রুতি রাতারাতি মন্দির তৈরি করতে গিয়ে মন্দির নির্মাণ অর্ধ সমাপ্ত রয়ে গেছে৷ আবার অনেকে বলেন ল্যাটোরাইট পাথরের নির্মিত রেখ দেউল মন্দির দুটি ভেঙে পডে়ছে৷ ভারতীয় পুরাতত্ত্ব পরিষদ ছাদ বাঁধিয়ে দিয়েছে৷

মন্দিরের কাছে দারকেশ্বর নদ৷ বারুণী তিথিতে লোকজন এখানে স্নান করে শিব মন্দিরে পূজা দেয়৷ মন্দিরের কাছে আছে একটা আটচালা৷ সেখানে এদিন থেকে শুরু হয় সংকীর্তন পাঁচ দিনের জন্য৷ এই পাঁচদিন মেলা বসে৷ তবে এই বছর (২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ) তিন দিন হবে গাজনের জন্য৷ আনুমানিক ৭০ থেকে ৮০ বছরের পুরনো মেলা৷ মেলাতে মিষ্টি, মিষ্টান্ন, স্টেশনারি খেলার জিনিস, মনোহারী জিনিস ইত্যাদি বিক্রি হয়৷ মেলা পরিচালনা ডিহর ষাঁডে়শ্বর তরুণ সংঘ করে৷ মেলার বিশেষ আকর্ষণ মাটির ছবি হয় এবং জ্যান্ত মানুষের ছবি হয়৷