• facebook
  • twitter
Wednesday, 17 December, 2025

বিদ্যার বং কানেকশন

৩০ তম কলকাতা আন্তর্জাতিক ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে এসে এক মধুর রোমন্থনে, কলকাতার ফিল্ম লাভারদের নিমজ্জিত করলেন নায়িকা।

৩০তম কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে অভিনেত্রী বিদ্যা বালন। নিজস্ব চিত্র।

বছর কুড়ি আগে এমনই এক ডিসেম্বরের শহরে মুক্তি পেয়েছিল প্রয়াত নির্দেশক গৌতম হালদারের ছবি, ‘ভালো থেকো’। নিটোল বাঙালি গল্পের নায়িকা হিসেবে কিন্তু দেখা গিয়েছিল টলটলে মায়া মাখানো মুখের একটি দক্ষিণী মেয়েকে। তাঁর নাম বিদ্যা বালন। ৩০ তম কলকাতা আন্তর্জাতিক ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে এসে এক মধুর রোমন্থনে, কলকাতার ফিল্ম লাভারদের নিমজ্জিত করলেন নায়িকা। পরনে তাঁর গৌতম ও তাঁর স্ত্রী চৈতির উপহার দেওয়া মেরুন-কালো বমকাই সিল্ক। ‘আমি মন থেকে বাঙালি। যেভাবে কলকাতা এবং বাঙালি দর্শকরা আমায় আন্তরিকভাবে স্থান দিয়েছেন তাঁদের মনে, তাতে আমি অভিভূত,’ বলতে ভোলেন না এই তামিল-কন্যা।

আসলে মালয়ালম ছবি এবং তামিল ছবি থেকে কোনও সদর্থক অফার না পেয়ে যখন বেশ হতাশ বিদ্যা, ঠিক তেমন একটা সময়ে হঠাৎই তাঁর কাছে গৌতমের কাছ থেকে আসে ‘ভালো থেকো’-র প্রস্তাব। কলকাতায় সেই সময় প্রদীপ সরকারের একটি বিজ্ঞাপন চিত্রের শুটিং করছিলেন বিদ্যা। প্রদীপের প্রোডাকশন ম্যানেজার দীনেশ রাউতই বিদ্যার নাম সুপারিশ করেন গৌতম হালদারের কাছে। ‘ভালো থেকো’ দিয়েই এরপর শুরু হয় বিদ্যার কেরিয়ারের উড়ান।

Advertisement

বিদ্যা বলেন, ‘আমি এর আগে পর্যন্ত জানতাম না স্ক্রিপ্ট কীভাবে পড়ে। গৌতমদা বাংলায় স্ক্রিপ্টটা পড়ে শোনালেন এবং অবাক কাণ্ড, ভাষাটা না জানলেও আমার বুঝতে এতটুকু অসুবিধে হল না! গৌতমদা ইহলোকে আর নেই, কিন্তু ই-মেলে ওঁর পাঠানো ছবির চিত্রনাট্য আজও আমার ইনবক্সে আছে। সত্যজিৎ রায়ের শহরে আমি বাংলা ভাষায় একটি ছবি করার সুযোগ পেয়েছি- এর চেয়ে সৌভাগ্যের আর কী হতে পারত!’

Advertisement

অভিনয়ের স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে বিদ্যা বলেন, ‘শুটিংয়ের প্রথম দিনেই ছিল সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে একটা সিন। সেখানে সৌমিত্রবাবুকে ‘জ্যাঠামশাই’ বলে আমার সম্বোধন করার কথা। সেই উচ্চারণ কিছুতেই রপ্ত হচ্ছে না দেখে, সৌমিত্রবাবু বলেছিলেন জেঠু বলো। কিন্তু আমিও হাল ছাড়ার পাত্রী নই। অনেক পরিশ্রম করে বাংলা উচ্চারণগুলো শুধরেছিলাম।’

প্রায় ১৫-১৮ দিন ধরে চলেছিল ছবির শুটিং। অভীক মুখোপাধ্যায়ের ক্যামেরা, অনুপ মুখোপাধ্যায়ের সাউন্ড। একটি বিশেষ স্মৃতি আজও ভুলতে পারেননি বিদ্যা। একটা ঝড়ের দৃশ্য গ্রহণ করার কথা ছিল গৌতমবাবুর। সেই জন্য একটা স্টর্ম মেশিন ভাড়া করে আনাও হয়েছিল লোকেশনে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়টি হল, সেটার আর প্রয়োজন পড়েনি। সেই রাতে হঠাৎই ভীষণ ঝড়-বৃষ্টি হল ফলতায়। ফলে ন্যাচারাল শটই রাখা হল ছবিতে। একেই বোধহয় বলে ম্যাজিক অফ সিনেমা!

বিদ্যা কখনও অভিনয়ের ট্রেনিং নেননি। কিন্তু কী এক ঐশ্বরিক ক্ষমতার বশে যেন অভিনয়টা সাবলীলভাবে করে ফেলেন এই অভিনেত্রী। আরেকজন বাঙালি নির্দেশকের প্রতি কৃতজ্ঞতার অন্ত নেই বিদ্যার। তিনি হলেন প্রদীপ সরকার। ইউফোরিয়ার জন্য একটি মিউজিক ভিডিয়ো ‘কভি আনা তু মেরি গলি’ গানের শুট করছিলেন নির্দেশক। ওই ভিডিয়োতেই পলাশ সেনের সঙ্গে ছিলেন বিদ্যাও। সেখানেই বিদ্যাকে কথা দিয়ে ছিলেন প্রদীপ, কখনও তাঁর ছবিতে অবশ্যই কাস্ট করবেন বিদ্যাকে। প্রাথমিকভাবে বিদ্যা তাঁর কথাটা বিশ্বাস না করলেও, কথা রেখেছিলেন প্রদীপ। বাংলা ক্লাসিক উপন্যাসকে ভিত্তি করে ‘পরিণীতা’ ছবিটি তৈরি করবেন প্রদীপ সরকার। বিধু বিনোদ চোপড়া ছিলেন প্রযোজক। ‘ললিতার চরিত্রে বিদ্যা বালন অভিনয় করবেন শুনে প্রদীপদাকে বিনোদ বলেন, এই চেম্বুরের মেয়ে করবে বাঙালি ললিতার চরিত্র! আর তার ভরসায় আমায় অর্থ ব্যয় করতে বলছ তুমি? প্রচুর অডিশন আর ভিডিয়ো টেস্টের পর এরপর আমার ঝুলিতে এসেছিল ছবিটি। কিন্তু ওই বেঙ্গল কানেক্ট আমার রয়েই গেল শেষ পর্যন্ত! আই হ্যাভ টু মেনি বেঙ্গলিস টু থ্যাংক ইন আ লাইফ টাইম,’ হাসতে হাসতে জানান বিদ্যা।

বাঙালিদের প্রতি এই অনুরাগের জন্যই আক্ষেপ থেকে গেল বিদ্যার- সত্যজিৎ রায়ের ছবিতে অভিনয় করা হল না। মাধবী মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে নাকি তাঁর আশ্চর্য মিল, এমনটাই বলেন তাঁর অনুরাগীরা। তিনি নিজেও মাধবীকে তাঁর আদর্শ মনে করেন। ‘পিউ বোলে’ গানটা শুটিংয়ের সময় শর্মিলা ঠাকুর এসেছিলেন সেট-এ। বিদ্যা বলেন, আমার সব স্বপ্ন যেন এক এক করে সত্যি হচ্ছিল। একসময় এঁদের দেখেই আমি অভিনেত্রী হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলাম!’

‘পরিণীতা’-র পর বহুবার কলকাতায় শুটিং করেছেন বিদ্যা। আরেক বাঙালি নির্দেশক সুজয় ঘোষের ছবি ‘কাহানি’, ‘কাহানি ২’, ছাড়াও এই শহরেই শুট হয়েছে ‘তিন’, ‘বেগমজান’ এবং তাঁর অভিনীত সাম্প্রতিক ছবি ‘ভুলভুলাইয়া ৩’। এই শহর আর তার মানুষদের জন্য একটা
আবেগ সবসময় জমে থাকে বিদ্যার মনে। অপেক্ষায় থাকেন কবে আবার ডাক আসবে কোনও বাঙালি নির্দেশকের, আবার তাঁর প্রাণের শহরে শুটিং করবেন তিনি।

Advertisement