সুতপন চট্টোপাধ্যায়
বাদল সরকারের ‘বাকি ইতিহাস’ নাটকের কথা তো ইতিহাস। সেই সঙ্গে ‘বহুরূপী’র প্রযোজনায় এই নাটক অনেকের স্মৃতিতে আজও উজ্জ্বল হয়ে আছে, যদিও সেই সংখ্যা ধীরে ধীর কমে আসছে। এই নাটক লেখার প্রায় ষাট বছর পর বর্তমানের এক অস্থির সময়ের সন্ধিক্ষণে ‘নোটো থিয়েটার ট্রুপ’ উপহার দিয়েছে এই নাটক। এক সাহসী প্রচেষ্টা। যাকে অস্বীকার করার উপায় নেই। কেন করেছেন সে কথা তাঁরা জানেন। আমরা দর্শকরা জানতে চাইব এটি কি সত্যি, নাকি বাকি ইতিহাস? নাট্যকার বাদল সরকার এতদিন আগে সত্যদ্রষ্টার মত লিখেছিলেন এই নাটক যা আজকেও বর্তমানের নাটক? আমি ‘বহুরূপী’র নাটক দেখতে পারিনি, প্রবাসে ছিলাম। কিন্তু নোটো দলের এই নাটক দেখেছি, সম্প্রতি ১৫ নভেম্বর রবীন্দ্র সদনে।
Advertisement
নাট্যকার বাদল সরকারের এই নাটক চারটি স্তরে খুব দক্ষতার সঙ্গে ভাগ করা আছে। মানুষের অপরাধ বোধ, জীবনে এর প্রেক্ষাপণ, মৃত্যুচেতনা এবং সর্বোপরি নাটক থেকে সম্পূর্ণ বাইরে এসে মানব জীবনের জন্ম ও মৃত্যুর প্রবল সংঘাত। যেখানে আমাদের জীবনকে জ্যামিতিক বাক্সের অর্ধচন্দ্রে ফেলে এক এক কোণ থেকে দেখতে পাই। তাই এই নাটক নিছক নাটক নয়, জীবনের এক চরম সত্যকে চিরকালীন রূপদান। তখন আর এই নাটক বাকি ইতিহাস থাকে না।
Advertisement
এই নাটকে দুটো ধরতাই দৃশ্য আছে। প্রথম দৃশ্যে কনা এক রাগী চরিত্র। আর এক ধরতাই, দুই দম্পতি এক আত্মহত্যার বাতাবরণে কাল্পনিক গল্প লেখার অনুশীলন। নাটকের মধ্যে নাটক। এর বাইরে সমস্ত নাটকে ছেয়ে আছে জীবন তিতিক্ষা, বাঁচার যুক্তি, না-বাঁচার তর্ক আর চিরকালীন বাস্তব-অতিবাস্তবের দোলাচল।
বাকি ইতিহাস উৎকন্ঠার ও আশঙ্কার ইতিহাস। কীসের উৎকন্ঠা? মৃত্যু চেতনার, তার ব্যবহারিক প্রকাশে এবং মানসিক অত্যাচারের ইতিহাসে। যা ছড়িয়ে আছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ থেকে সাম্প্রতিক মানুষের বর্তমান ইতিহাসে। একদিকে যেমন কনার মানসিক সঙ্কট, তেমনি অন্য দিকে সতীনাথের নিজেকে ছিঁড়ে ফালাফালা করা আত্মসমীক্ষা। আর এর মধ্যে সতীনাথ চারটে অমোঘ স্ট্যান্ডি এনে আমাদের সামনে দাঁড় করিয়ে দিলেন। ফুটে উঠল এক ঝটকায় অতীতের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহ মৃত্যুমিছিল। পরক্ষণে ঢুকে যাই বর্তমানের যন্ত্রণাবিদ্ধ মানুষের ইতিহাসে। মানুষ বাঁচে না, তিলে তিলে আসলে মরে। কনা চরিত্রে ময়ূরী মিত্র যেমন দক্ষ, সংযত, সাবলীল, সতীনাথ চরিত্রে অমর চট্টোপাধ্যায় তেমনি আরগুমেন্টেটেটিভ্। এই দুই চরিত্রই নাটকের মূল স্তম্ভ এবং দু’জনই অসাধাররণ অভিনয় করেছেন।
গল্পের ভিতর গল্প এবং নাটকের ভিতরে নাটকের আবহ তৈরি করতে কনা ও সতীনাথের সঙ্গে যে পার্শ্চরিত্ররা এই নাটকে আছেন তাঁদের অভিনয় সমানভাবে প্রশংসার। বাসন্তীর চরিত্রে রত্না নাথ, শরদিন্দু চরিত্রে পল্লব চক্রবর্তী অসম্ভব বিশ্বাসযোগ্য অভিনয় করেছেন। সতীনাথের বন্ধু বিজয়ের ভূমিকায় শুভজিৎ সোম দক্ষতার সঙ্গে আলো ফেলেছেন সতীনাথের জীবনের অন্ধকার অলিগলি বরাবর। সুপর্ণা সোমের অভিজাত উপস্থিতি ও ইস্কুল সেক্রেটারির ভূমিকায় অভিনয় চোখে পড়ার মতো। শরদিন্দুর কলিগ বিশ্বজিত মাইতি সুন্দর ও সাবলীল। আলোও এই নাটকের একটি প্রধান চরিত্র। তাপস ভট্টাচার্য তাঁর যথাযোগ্য মান বজায় রেখেছেন।
কেবলমাত্র দুটি ঘরের দরজা ও চারটি অসাধারণ স্ট্যান্ডি দিয়ে মঞ্চসজ্জা এই নাটকের এক অনন্য আভরণ। তার সঙ্গে উচ্চমানের ব্যাক গ্রউন্ড মিউজিক করেছেন এই নাটকের সতীনাথের চরিত্রাভিনেতা ও অন্যতম পরিচালক অমর চট্টোপাধ্যায়। এই নাটকে পোশাক ও দুই কনার চরিত্রাভিনেতা এবং অন্যতম পরিচালক ময়ূরী মিত্র। তাঁদের দক্ষ পরিচালনায় ও দলের সম্মিলিত অভিনয়ের গুণে ষাট বছর আগের লেখা বাদল সরকারের ‘বাকি ইতিহাস’ নতুন আঙ্গিকে তৈরি হয়েছে আজকের নাটক।
Advertisement



