ক’দিন আগে কোথাও পড়ছিলাম, বাঙালি নাকি স্মৃতিকাতর-প্রজাতি! তাঁদের নাকি ‘নস্টালজিকা সিনিকা’ও বলা যায়। দোষ কী! বাঙালি অতীতচারণায় অভ্যস্ত— এটা তো কোনও নতুন উপপাদ্য নয়। বাঙালির ইতিহাস, বাঙালির ভূগোল তাঁদের বারবার পিছু টানে। অতীতের আকর্ষণ ক’জন ভুলতে পারে! বাঙালি অন্তত পারে না। অর্থনীতির ছাত্র এবং প্রবাসী হয়েও সুমন ঘোষ ‘পদক্ষেপ’, ‘নোবেল চোর’, ‘কাদম্বরী’, ‘পিস হ্যাভেন’, ‘বসু পরিবার’-এর মতো উল্লেখযোগ্য ছবি উপহার দিয়েছেন বাঙালি দর্শককে। তাঁর সাম্প্রতিক সিনেমা ‘পুরাতন’! কিছুটা ডিমনেশিয়ায় আক্রান্ত এক নিঃসঙ্গ বৃদ্ধার অতীতের সুখস্মৃতি আর বর্তমানের মানসিক অস্থিরতা নিয়েই ‘পুরাতন’-এর কাহিনী। সুমন ঘোষ অবশ্য নিটোল ‘গল্প’ বলতে চাননি। তিনি ওই নিঃসঙ্গ নারীর মনের আনাচে কানাচে ঘুরতে চেয়েছেন— যেখানে বসে আছে স্মৃতির গুঁড়ো চন্দন! বর্তমানে দাঁড়িয়েও তিনি অতীতচারিণী! নিজের মাঝবয়সী মেয়ে রীতিকাকে মাঝেমাঝেই এখনও স্কুল যাওয়া কিশোরী মনে করে তার জন্য টিফিন সাজিয়ে হাত ধরে স্কুল-গাড়ির জন্য অপেক্ষা করতে চান। সম্বিত ফিরে এলে তাঁর স্মৃতির পাতা তখন শূন্য।
সুমন খুঁজে পেয়েছেন বটে একটি ভাঙাচোরা বাড়িও। টিটাগড়ের এই বাড়িটি অবশ্য বাংলা ছবির প্রিয় লোকেশন স্পট! বিপজ্জনকভাবে ভগ্নপ্রায় বাড়িটিকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে জড়িয়ে রেখেছে অগণিত প্রাচীন গাছের শিকড় মানুষের শরীরের শিরা-উপশিরার মতো। রবিকিরণ আয়াগিরির ক্যামরা যেমনভাবে ভগ্নপ্রায় বাড়ির চেহারাটি ধরেছে, তেমনি একই সূক্ষ্ণতায় ধরা পড়েছে শর্মিলা ঠাকুরের বিগ ক্লোজ আপে ক্যামেরা যখন ঘুরেছে তাঁর মুখমণ্ডলে এবং শরীরে। জড়বস্তু বাড়ির প্রাচীনতার সঙ্গে জীবন্ত এই মানুষীর বাহ্যিক চেহারার মাধ্যমেই সুমন ধরতে চেয়েছেন অন্তরের আবেগ এবং আর্তির পরিবহ।
বৃদ্ধার সঙ্গে তাঁর আশিতম জন্মদিন পালন করতে আসে রীতিকা ও নতুন জামাই রাজীব (ইন্দ্রনীল)। রাজীব আবার যেমন ওয়াইল্ড লাইফ ফটোগ্রাফার, তেমনই প্রত্নতত্ত্বের প্রতিও আগ্রহী। আর এখানেই বয়স্ক আন্টির সঙ্গে মিলে যায় চেতনার স্বর ও সুর। মেয়ে রীতিকা যখন মায়ের ডিমেনশিয়া নিয়ে উদ্বিগ্ন, রাজীবই বলে ওঠেন— ‘আন্টি যদি অতীত নিয়ে ভালো থাকেন, সুস্থ থাকেন— আমাদের অসুবিধা কোথায়! ওঁকে ওঁর মতোই থাকতে দিই না!’ বাড়ির স্টোর রুম থেকে তিনি বার করেন পুরী-দার্জিলিং বেড়ানোর অ্যালবাম, মুদি দোকানের ফর্দ, ষাট-সত্তর সালের স্বামীর ব্যাঙ্কের পাশবই এবং এই সূত্রেই জানা যায়
কুট্টিকাকুর কথা—যিনি ‘নকশালপন্থী’ ছিলেন এবং পুলিশের গুলিতে মারাও যান। যদিও বৃদ্ধার সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের কোনও ইঙ্গিত নেই। অতীতের সবকিছুই আছে স্মৃতি-আয়নার ভাঙা ভাঙা টুকরো হয়ে। আর সেখান থেকেই ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে চারিত্রিক দৃঢ়তা ও বৈশিষ্ট্য।
একই সঙ্গে সমান্তরালভাবে চিত্রনাট্যে এসেছে রীতিকা-রাজীবের বৈবাহিক জীবনের সম্পর্কের টানাপোড়েন। এই জায়গাটি চিত্রনাট্যে একটু বেশিই স্থান পেয়েছে। যদিও ঋতুপর্ণা এবং ইন্দ্রনীল দু’জনেই সুন্দরভাবে চরিত্রের পরতগুলো মেলে ধরেছেন ক্যামেরার সামনে সাবলীল দক্ষতায়। একজন সফল পেশাদার অফিসারের পাশাপাশি বৃদ্ধা মায়ের জন্য উদ্বিগ্ন ভাব এবং স্বামীর ‘অতীত’ নিয়ে চিন্তাক্লিষ্ট মনোভাব প্রকাশে ঋতুপর্ণা প্রবীণ শর্মিলার পাশে দাঁড়িয়ে উতরে যান বইকি! তবে অস্বীকার করা যাবে না যে শর্মিলা ঠাকুরই এই ছবির কেন্দ্রীয় চরিত্র ও প্রাণবিন্দু। দীর্ঘ ব্যবধানে তিনি অভিনয় করলেন বাংলা ছবিতে এবং প্রমাণ করে দিলেন পুরোনো মানুষ এবং অভিজ্ঞতা চিরনতুনই থাকে।
শর্মিলার চোখ-মুখের প্রতিটি প্রতিক্রিয়ায় ‘নায়ক’-এর অদিতি, ‘সীমাবদ্ধ’র টুটুল এবং ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ ছবির অপর্ণা যেন বয়স্ক চেহারায় ফিরে এলেন। শুধুমাত্র ওঁর চরিত্র-সম্পৃক্ত অভিনয় দেখার জন্যই ‘পুরাতন’ দ্বিতীয়বার দেখা যায়। একটাই আফশোস— সুমন ঘোষ যদি তাঁর চিত্রনাট্যে আরও একটু জায়গা দিতেন বৃদ্ধার নিঃসঙ্গতার বেদনাকে ধরতে। শ্রেয়া ঘোষালের গাওয়া ‘দূরে কোথায় দূরে…’ এবং ‘ঘুম ঘুম নিঝঝুম কুয়াশা’ গান দু’টির ব্যবহারও (সঙ্গীত: অলোকনন্দা দাশগুপ্ত) সুন্দর। একাবল্লি খান্না ও বৃষ্টি রায়ের অভিনয় ভালোই। আসলে ‘পুরাতন’ সুমন ঘোষের ছবি বলেই একটা মৃদু অনুযোগ— ওই পোড়ো বাড়িতে বৃদ্ধা এবং পরিচারিকা ছাড়া আর কাউকে দেখা গেল না, এমনকি, কোনও প্রতিবেশীও নয়! বৃদ্ধার একাকিত্বকে গভীরতা দিতেই কি এমন আয়োজন?