অদৃশ্য কালপুরুষ, প্রয়াত বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত

বাংলা চলচ্চিত্র জগতে এ কেবল নক্ষত্রপতনই নয়, এ যেন এক ‘কালপুরুষ’-এর অন্তর্ধান। প্রয়াত স্বনামধন্য পরিচালক বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত।

Written by SNS Kolkata | June 11, 2021 3:07 pm

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত (Photo:SNS)

বাংলা চলচ্চিত্র জগতে এ কেবল নক্ষত্রপতনই নয়, এ যেন এক ‘কালপুরুষ’-এর অন্তর্ধান। প্রয়াত স্বনামধন্য পরিচালক বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত। বেশ কিছুদিন ধরেই তিনি কিডনির সমস্যায় ভুগছিলেন। বৃহস্পতিবার সকাল ছ’টা নাগাদ, ৭৭ বছর বয়সে, স্ত্রী এবং দুই কন্যাকে রেখে চলে গেলেন চলচ্চিত্রকার বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত।

সত্যজিৎ, মৃণাল সেন, ঋত্বিক ঘটক প্রমুখ পরিচালকদের দীপ্তিময় সেলুলয়েড আকাশে বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত একেবারে স্বতন্ত্র আলােকবিন্যাসে দীপ্যমান হয়েছিলেন। খানিকটা অন্ধকারেই দিগদর্শনের আলােকবিন্দু হয়ে জ্বলে থেকেছিলেন ‘কালপুরুষ’-এর মতাে।

নিজস্ব ফর্মুলায় সেলুলয়েডের কাহিনি সাজিয়ে নিজেকে চিনিয়েছেন বিশ্ব চলচ্চিত্রের দরবারে। ভেনিস, লােকার্নো, এশিয়া প্যাসিফিক, ব্যাঙ্কক ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল ইত্যাদি। জায়গায় সমাদৃত হয়েছে বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের একাধিক ছবি।

১৯৪৪ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি পুরুলিয়ার জন্ম তার। বাবা ছিলেন পেশায় রেলওয়ের ডাক্তার। পিতার ছিল বদলির চাকরি। বারাে বছর বয়সে তাকে কলকাতায় চলে আসতে হয়। হাওড়ার দীনবন্ধু কলেজে ভর্তি হন। পড়াশুনাের পর্ব শেষ করে তিনি অধ্যাপনাকেই পেশা হিসেবে নেন।

প্রথমে বর্ধমানের শ্যামসুন্দর কলেজ তারপরে দক্ষিণ কলকাতার সিটি কলেজে অধ্যাপনা করেন। সত্তরের দশকে ক্যালকাটা ফিল্ম সােসাইটির সদস্য হওয়ার সূত্রে চার্লি চ্যাপলিন, আকিরা কুরােশােয়া, রােবার্তো রসেলিনি প্রমুখ বিশ্ব চলচ্চিত্রকারদের সিনেমা তাকে এক নতুন পথের সন্ধান ছিল। অল্পবয়স থেকেই কবিতা লিখতেন তিনি।

এরপর সেলুলয়েডের ক্যানভাসের ছবি আঁকতে শুরু করলেন লেন্সের আলােয়। ১৯৭৮ সালে তাঁর প্রথম মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি ‘দূরত্ব’ই বুঝিয়ে দিয়েছিল সমসাময়িক পরিচালকদের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন রাস্তাতেই হাঁটিতে স্বচ্ছন্দ তিনি এর ত্যাগেও তাবশ্য সময়ের কাছে ‘ নামে একটি সিনেমা বানিয়েছিলেন।

এরপর ‘নিম অন্নপূর্ণা, ‘গৃহযুদ্ধ’, ‘বাঘ বাহাদুর’, ‘চরাচর’, ‘লাল দরজা, ‘তাহাদের কথা’, ‘উত্তরা’, ‘মন্দ মেয়ের উপাখ্যান’, ‘স্বপ্নের দিন’, ‘জানালা’, ‘কালপুরুষ’, ‘টোপ’, ‘উড়ােজাহাজ’ ইত্যাদি একাধিক বিভিন্ন বাংলা ছবিতে তিনি স্বতন্ত্র ঘরানার জন্ম দিয়েছিলেন। অনেকেই বলেন, বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের ছবি কেবল আন্তর্জাতিক পুরস্কার পাওয়ার জন্যই বানানাে হয়। কিন্তু এসব যুক্তি নস্যাৎ হয়।

কারণ তার ছবিতেই বাউল, বাঁশিওয়ালা, কুড়িগীর, বহুরূপী এমন বহু প্রান্তিক বৃত্তির মানুষের জীবনের কাহিনী তার মুন্সিয়ানায় সিনেপ্রেমীদের কাছে হয়ে গিয়েছিল তাহালের কথা। রিয়েলিজমের রে সঙ্গে সুররিয়েলিজম-এর এক চমৎকার ফিউশান ছিল বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের ছবিতে। কারণ, বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত যে শুধু চিত্র পরিচালকই ছিলেন না, ছিলেন কবিও। জীবনানন্দের কাব্যচেতনার প্রভাব ছিল তার ওপরে। গভীর আড়ালে, কফিন কিংবা সুটকেস, রােবােটের গান, ভােম্বলের আশ্চর্য কাহিনী, শ্রেষ্ঠ কবিতা ইত্যাধি একাধিক কবিতার বইতে বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের কবিমনের পরিচয় পাওয়া যায়।

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত পরিচালিত ‘তাহাদের কথা’ সেরা চলচ্চিত্র হিসেবে জাতীয় পুরস্কার পায়। সেরা চলচ্চিত্রকার হিসেবে তিনি পুরস্কৃত হয়েছিলেন ‘উত্তরা’ এবং ‘স্বপ্নের দিন’ সিনেমার জন্য। মিঠুন চক্রবর্তী, মমতাশঙ্কর, প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়কে নতুন ভাবে চেনার শুরুয়া হয়েছিল বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের হাত ধরে। বাংলা ছাড়াও ‘অন্ধি গলি’ এবং আনােয়ার কা আজব কিসসা নামে দুটি হিন্দি ছবিও পরিচালনা করেন তিনি। দুরদর্শনে ও তাঁর একাধিক কাজ রয়েছে।

তার মৃত্যুতে বাংলা চলচ্চিত্র জগতে নামে শােকের ছায়া। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মােদি চিত্র পরিচালক বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের মৃত্যুতে শােকপ্রকাশ করে টুইট করেছেন। বুদ্ধদেব দাশগুপ্তকে একজন দার্শনিক ও কবি হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। সমবেদনা জানিয়েছেন প্রয়াত পরিচালকের পরিবারে প্রতি।

রাজ্যপাল জগদীপ ধনকড়ও লিখেছেন, বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের মৃত্যুতে সমাজের এক শ্রেণির মানুষের সঙ্গে বন্ধন ছিন্ন হল। চিত্রপরিচালক বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের মৃত্যুতে শােকবার্তা পাঠিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি লিখেছেন, ‘বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের প্রয়াণে আমি গভীর শােক প্রকাশ করছি।

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত স্পেন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড, এথেন্স আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে গােল্ডেন অ্যাওয়ার্ড, বার্লিন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে গােল্ডেন বিয়ার অ্যাওয়ার্ড, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারসহ অজস্র সম্মানে ভূষিত হয়েছেন। তার মৃত্যুতে চলচ্চিত্র জগতের অপূরণীয় ক্ষতি হল। আমি বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের পরিবার-পরিজন ও অনুরাগীদের প্রতি সমবেদনা জানাচ্ছি।

গৌতম ঘােষ, অপর্ণা সেনের মতাে পরিচালকরা বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের স্বতন্ত্রতার কথা স্বীকার করেন। প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়, ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত, সুদীপ্তা চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ অভিনেতারা বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের সঙ্গে তাদের কাজের অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেছেন। প্রায় সকলের স্মৃতিচারণাতেই উঠে এসেছে প্রকৃতির বিভিন্ন সময়ের আলাে কীভাবে তার সিনেমায় ফুটিয়ে তুলতেন বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত।

অমাবস্যার নিকষ কালাে, ভাের রাতের আলাে আঁধারি, সকালের সূর্যের ঘুম ভাঙা আলাের সিলুয়েটে বুদ্ধদেব দাশগুপ্তর শু্যটিং-এর ছিল এক অন্য অভিজ্ঞতা। আসলে তার ছবিগুলির দৃশ্যায়নে লেন্সের আলাের সঙ্গে প্রকৃতির আলাের খেলা চলত।

এবার তিনি হয়তাে হারিয়ে গেলেন, অন্য কোনও আলাের খোঁজে। রেখে গেলেন সেলুলয়েডের ভিন্ন আকাশ।