• facebook
  • twitter
Sunday, 21 December, 2025

বীরাঙ্গনা আলেয়া বিবির জীবনের গল্প

আলেয়া বিবি। ১৯৭১ সালে তিনি ছিলেন মাত্র ১৪/১৫ বছর বয়সের এক কিশোরী। ১৯৭১ সালে দেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলো। একসময় সেই যুদ্ধের শিকার হলেন আলেয়া বিবি।

ফাইল চিত্র

সুরমা জাহিদ

মুক্তিযুদ্ধ আমি দেখিনি। তবুও সারাক্ষণ আমার চোখের সামনে যুদ্ধের স্মৃতি ভেসে থাকে। মনের ভেতরে নড়াচড়া করতে থাকে ১৯৭১ সালের সেই মা-বোনদের ভয়াবহ করুণ ঘটনার কথা, ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল জুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা তিন থেকে চার লাখ মা-বোনদের ছবি, যাঁরা বাংলাদেশের ইতিহাসের পাতায় বিরাট একটি অংশ জুড়ে রয়েছেন। যদিও তখন নির্দিষ্ট করে গণনা করা সম্ভব হয়নি যে, ঠিক কতজন নারী নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন। অনুমানের ওপর হিসাব করে ধারণা করা তিন থেকে চার লাখ হবে। তাঁদের মাঝে খুব অল্পসংখ্যক বীরাঙ্গনা বর্তমানে বেঁচে আছেন। যাঁরা দেশে আছেন, তাঁদের সম্পর্কে আমরা কমবেশি মোটামুটি জানি। আর যাঁরা দেশের বাহিরে আছেন, তাঁরা কোথায় আছেন, কেমন আছেন, কী অবস্থায় আছেন, তা তো জানা দূরের কথা, তাঁদের সন্ধানই আমরা জানি না। এ-ও আমাদের হয়তো জানা নেই যে, বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তান ছাড়াও অন্যান্য দেশেও আছেন সেইসব বীরমাতারা। তাঁদের কথা আপাতত থাক।

Advertisement

বাংলাদেশের কুমিল্লা জেলার অজপাড়া গ্রামের এক বীর নারী আলেয়া বিবি। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গিয়েছে তাঁর জীবন থেকে ঝলমলে রঙিন জীবনের আলো— জীবনের শুরুতেই। সেই থেকে আলেয়া বিবি অন্ধকারেই রয়ে গিয়েছেন সারা জীবন। যদিও আলোতে ফিরে আসার জন্য আলেয়া বহু চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু কোন পথে গেলে যে আলোর সন্ধান পাবেন, সেই পথ তিনি খুঁজে আর পেলেন না। খুঁজে পেলেন না বললে ভুল হবে, সেই পথ খোঁজার শক্তি, সাহস ও লোকবল কোনোটাই ছিল না তাঁর জানা।

Advertisement

অন্ধকারে পড়ে থাকা আলেয়া বিবির জীবনে ঘটে যাওয়া ১৯৭১ সালের ঘটনার বিবরণ উপস্থাপন করা হবে। হাজার বছরের ইতিহাসে বাঙালির সবচেয়ে বড় অর্জন— ১৯৭১ সালে এক সাগর-রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন। যুদ্ধ চলাকালীন নয় মাস ধরে বাঙালি কিশোরী, যুবতী, তরুণী, গৃহবধূ এমনকি পাঁচ বছরের শিশু থেকে শুরু করে ৮০ বছরের বৃদ্ধাও রেহাই পায়নি এই বর্বর পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর যৌন পাশবিক নির্যাতন থেকে। যাদের ক্যাম্পে জোর করে ধরে নিয়ে আটকে রেখেছিল তাদের উপর দফায় দফায় সারা রাতভর চলতো ধর্ষণের পর ধর্ষণ— ভোর না হওয়া পর্যন্ত। অতিরিক্ত ধর্ষণের কারণে অনেক নারী মৃত্যুবরণ করেছেন। শুধু তাই নয়, যুদ্ধশেষে ক্যাম্প থেকে অনেক বীরমাতাকেই একদম উন্মাদ-উলঙ্গ-জ্ঞানহীন-অস্বাভাবিক-পাগল অবস্থায় মুক্ত করা হয়েছে। আবার অনেক নারীকে ক্যাম্প থেকে উদ্ধার করার পর কোথায়ও আশ্রয় না পেয়ে তিনি আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন। অনেকে স্বজনদের কাছ থেকে বিতাড়িত হয়ে গভীর নির্জন পাহাড় জঙ্গলে একাকী জীবন-যাপন করেছেন। আবার অনেকেই যে যেভাবে পেরেছেন, সেভাবেই দেশ ত্যাগ করেছেন। আর যাঁরা পরিবারে ফিরে গিয়েছেন এবং আশ্রয় পেয়েছেন, তাঁরা যে কী দুর্বিষহ জীবনযাপন করেছেন, তা বলে বোঝানো সম্ভব নয়। আবার এ-ও দেখা গিয়েছে, পরিবার-স্বজনেরা আশ্রয় ঠিকই দিয়েছে কিন্তু তাঁদের সঙ্গে অত্যন্ত খারাপ ব্যবহার করা হতো। উঠতে বসতে বিভিন্নভাবে অনেক বিশ্রী বিশ্রী ভাষায় ছোট বড় সহ বাড়ির সকলে তাঁদের বকাবকি করতো। পাড়াপ্রতিবেশীরা কুপ্রস্তাব দিতো।

তাদের কুপ্রস্তাবে রাজি না হওয়ার ফলে অনেক আঘাত করে বাজে বাজে কথা বলে বকাবকি করতো। সমাজে তাঁদের কথা বলতে দেওয়া হতো না। তাঁদের সমাজ-সংসারে কোনো কাজ দেওয়া হতো না। সকলের ধারণা ছিল, তাঁরা নষ্ট, তাঁরা খারাপ মেয়েমানুষ। তাঁরা যদি কারো সঙ্গে মেশেন তবে অন্যেরাও খারাপ হয়ে যাবে, তাদেরও পাপ হবে। তাঁরা যেহেতু অপবিত্র, তাই তাঁদের সঙ্গে যারা কথা বলবে, মিশবে, তারাও অপবিত্র হয়ে যাবে। সমাজ প্রতিটি মুহূর্তে সেইসব বীরাঙ্গনাদের বুঝিয়েছে এবং মনে করিয়ে দিয়েছে যে, তোমরা সমাজে আবর্জনা এবং সেই আবর্জনা থেকে দুর্গন্ধ ছড়ায়। এভাবেই এতটা অবহেলা ও সীমাহীন কষ্ট-দুঃখ-দুর্দশা-লাঞ্ছনা-গঞ্জনার মাঝে জীবনযাপন করেছেন প্রায় প্রতিটি বীরাঙ্গনা। যখন মুখোমুখি বসে তাঁদের সাক্ষাৎকার নিতাম, তখন বুঝতে পেরেছি তাঁদের কষ্টের পরিমাণটা কত ছিল। তাঁদের ভেতরে যে জ্বালা যন্ত্রণা কুরে কুরে খাচ্ছে, তা তাঁদের কথা থেকেই বোঝা যায়। শুধু তাই নয়, এমনও অনেক নারী আছেন যাঁদের শুধু ধর্ষণই করেনি, প্রচণ্ড রকমের অমানুষিক শারীরিক নির্যাতন করেছে এবং এত বড় বড় আঘাত করেছে যে, যার ক্ষত তাঁরা এখনো বয়ে যাচ্ছেন—যা তাঁদের ওপর ঘটে যাওয়া পাক হানাদার বাহিনী কর্তৃক এই নৃশংস-লোমহর্ষক-অকল্পনীয়-অবর্ণনীয়-পাশবিক ধর্ষণের এক নীরব সাক্ষী। এমনই একজন বীরমাতার নাম আলেয়া বিবি।

আলেয়া বিবি। ১৯৭১ সালে তিনি ছিলেন মাত্র ১৪/১৫ বছর বয়সের এক কিশোরী। ১৯৭১ সালে দেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলো। একসময় সেই যুদ্ধের শিকার হলেন আলেয়া বিবি। দেশে যুদ্ধ শুরু হওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই কুমিল্লা জেলায়, তাঁর গ্রামে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ল। চারদিকে ভীতিকর অবস্থা। নিরাপদ স্থানে লুকিয়ে থাকার জন্য বাড়ির মুরুব্বিরা বারবার সতর্ক করছেন। আলেয়া বিবি দিনের বেশিরভাগ সময় ঘরের ভেতরেই লুকিয়ে থাকতেন। বাহিরে গিয়ে কোথাও যে লুকোবেন তার জায়গা নেই। গ্রামের আনাচে-কানাচে পাকিস্তানি মিলিটারিরা ছোটাছুটি করে সারাক্ষণ। মানুষ মানুষের কাছ থেকে কতক্ষণ লুকিয়ে থাকতে পারে? আলেয়াদের বাড়ির পাশ দিয়ে বড় মেইন রাস্তা। একদিন আলেয়া তাঁর কয়েকজন বান্ধবী মিলে রাস্তার একপাশে দাঁড়িয়ে গল্প করছেন। এমন সময় একদল মিলিটারি ছোটাছুটি করছে দেখে আলেয়ারা দৌড়ে একেকজন একেক দিকে চলে যান। আলেয়া সোজা বাড়ি গিয়ে তাঁদের ঘরের ভেতরে লুকিয়ে পড়েন। আলেয়া ভেবে নিয়েছেন, তিনি নিরাপদ আশ্রয়ে পৌঁছে গিয়েছেন। তিনি ভাবতেও পারেননি যে, মিলিটারিরা তাঁকে দেখে ফেলেছে।

মিলিটারিরা আলেয়ার পিছু পিছু আলেয়ার বাড়িতে গিয়ে একেবারে সোজাসুজি আলেয়া যে ঘরে লুকিয়েছেন সেই ঘরে প্রবেশ করে। ঘরের ভেতরে ঢুকেই আলেয়ার চুলের মুঠি ধরে টেনে ঘর থেকে বাহির করে এনে উঠানে ফেলে খোলা আকাশের নিচে, দিনের আলোতে প্রকাশ্যে বাড়ি ভর্তি লোকজনের সামনে টেনে হিঁচড়ে পরন থেকে কাপড় খুলে বিবস্ত্র করে পালাক্রমে ধর্ষণ করতে থাকে। বাড়ির অন্যেরা তখন ভয়ে লুকিয়ে পড়ে। এক এক করে যখন বেশ কয়েকজন আলেয়াকে ধর্ষণ করছে তখন উঠানে রক্তের বন্যা বয়ে গিয়েছে।

অতিরিক্ত ধর্ষণ আলেয়া যখন সহ্য করতে পারছেন না, তখন জোরে জোরে চিৎকার করেন। আলেয়ার চিৎকার শুনে তাঁকে উদ্ধার করতে তাঁর দাদা আর চাচি ছুটে আসেন। দাদা-চাচি এসে মিলিটারিদের কাছ থেকে তাঁকে উদ্ধার করার চেষ্টা করছেন কিন্তু সেই অবস্থায় মিলিটারিরা তাঁর দাদা আর চাচিকে লক্ষ্য করে গুলি ছোঁড়ে। সঙ্গে সঙ্গে তাঁর দাদা আর চাচি মাটিতে লুটিয়ে পড়ে মারা যান। এ সময় আলেয়ার শরীরের বিভিন্ন জায়গায় সেই গুলির ছিটা লেগেছে। তখনও মিলিটারিরা আলেয়াকে ধর্ষণ চালিয়ে যাচ্ছে। একদিকে মিলিটারিরা আলেয়াকে নির্যাতন করছে আর অন্যদিকে তাঁর চোখের সামনে তাঁর দাদা-চাচি ছটফট করে মারা যাচ্ছেন। শরীরে গুলির ছিটার যন্ত্রণার সঙ্গে সঙ্গে ধর্ষণের যন্ত্রণায় ছটফট করছেন আলেয়া। এমন পরিস্থিতির মাঝেও থামেনি ওই পিশাচ পাকিস্তানী হানাদার বর্বর মিলিটারিগুলো। এমতাবস্থায় আলেয়া আরও বেশি দিশেহারা হয়ে পড়েন। তখন যে মিলিটারি ধর্ষণ করছিল, তাকে আলেয়া তাঁর গায়ের জোরে একটা থাপ্পড় মারেন। মুহূর্তের মধ্যে ছুটে এল গুলির আওয়াজ। আলেয়ার মনে হল, তাঁর বাম হাতটা তাঁর কাছ থেকে কেউ খুলে নিয়ে গিয়েছে। এরপরের ঘটনা আলেয়া আর কিছু বলতে পারেননি। দুই-তিনদিন পর যখন তাঁর হুঁশ ফিরে এল, তখন দেখেন, তিনি ভারতের আগরতলা হাসপাতালের ৩ নম্বর বেডে শুয়ে আছেন। প্রথমে তিনি তেমন কিছুই বুঝতে পারেননি। তাঁকে কেউ কিছু বলছে না। কিছুক্ষণ পর চোখ এদিক-ওদিক শুধু ঘোরাচ্ছেন। তখনও পর্যন্ত আলেয়া বুঝতে পারেননি তাঁর কী হয়েছে। আলেয়া চোখ ঘোরানোর সময় দেখেন, তাঁর বেডের এক কোণে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছেন তাঁর মা-বাবা। কেমন যেন অপরিচিত লাগছে তাঁদেরকে। খুব ব্যাকুল হয়ে তাঁদের কাছে যাওয়ার চেষ্টা করেন আলেয়া কিন্তু তিনি নড়াচড়া করতে পারছেন না। আলেয়া অনেক চেষ্টা করছেন কিন্তু নড়াচড়া করতে পারছেন না। পাশে তাঁর মা-বাবা দাঁড়িয়ে আছেন কিন্তু তাঁরাও এগিয়ে আসছেন না। শেষে ‘মা, মা’ বলে ডাকতে শুরু করলেন। তখনো তাঁর মা-বাবা নির্বাক দৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকিয়ে আছেন। কারণ, তাঁদের তো বলার কোনো ভাষা নেই যে আলেয়ার কী কী হয়েছে, তা তাঁকে বলার। সারা জীবনের জন্য আলেয়া পঙ্গু ও অচল হয়ে গিয়েছেন। মেয়ের পঙ্গুত্বের কথা জানানোর সাহস হচ্ছে না তাঁর মা-বাবার। কিন্তু আলেয়ার আগ্রহ ক্রমেই বাড়ছে, আবার তিনি কান্নাও করছেন। কান্নার ফাঁকে ফাঁকে বারবার জানতে চাচ্ছেন আর মা-বাবার এই নীরবতায় আলেয়া একসময় বেশ উত্তেজিত হয়ে যান। তখন তাঁর বাবা আস্তে আস্তে তাঁকে সান্ত্বনা দিয়ে বলছেন, মা, তোর কিছুই হয়নি। কিন্তু আলেয়া তা বিশ্বাস না করে মাকে উদ্দেশ করে জানতে চাইছেন যে, তাঁর কী হয়েছে। আলেয়ার মা তখন জোরে চিৎকার করে তাঁকে জড়িয়ে ধরে বলছেন, ‘মা, তোর সব শেষ হয়ে গিয়েছে। মেয়েদের জীবনের সবচেয়ে বড় সম্পদ তার মান-ইজ্জত, তা আর নেই তোর। মিলিটারিরা নষ্ট করে দিয়েছে। মা হয়ে তোকে আমি কী করে একথা বলি।’ মায়ের এমন কথা শুনে আর কান্না দেখে আলেয়া শোয়া থেকে উঠে বসার জন্য অনেক চেষ্টা করতে থাকেন। কিন্তু আলেয়া কিছুতেই উঠে বসতে পারছেন না। তাঁর উঠে বসার চেষ্টা দেখে তাঁর বাবা তাঁর কাছে এসে বলছেন, ‘মা-গো, হাজার চেষ্টা করলেও তুই এখন উঠে বসতে পারবি না। তোর হাত সহ সারা শরীরে গুলি লেগেছে। মিলিটারির গুলিতে তোর একটা হাত পঙ্গু হয়ে গিয়েছে। তুই শুধু জানে বেঁচে গিয়েছিস।’

এই কথা বলার পর আস্তে আস্তে আলেয়ার সবকিছু মনে পড়তে থাকে। আর তাঁর ভেতরটা ধীরে ধীরে ভেঙেচুরে চুরমার হতে থাকে। নানারকমের প্রশ্ন তাঁর মনের ভেতরে দানা বাঁধতে থাকে। সমাজ, দেশ, আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী তাঁকে কি গ্রহণ করবে? যদি গ্রহণ না করে তবে কী হবে তাঁর? লোকজন কি তাঁকে কলঙ্কিনী বলবে? সারা জীবন কি তাঁর নামের আগে বা পরে কলঙ্কিনী নাম যোগ হবে? আরও ভাবতে থাকেন, সত্যি সত্যিই কি আমার একটি হাত অচল হয়ে গিয়েছে, হাতটি কি আর ভাল হবে না, সারা জীবন কি আমাকে পঙ্গু হয়ে থাকতে হবে? আলেয়ার মা-বাবার অবস্থা দেখে হঠাৎ আলেয়ার মনে হল, না, এখন যদি আমিও এমন উতলা হয়ে মা-বাবার সামনে ভেঙে পড়ি, তবে তাঁরা আরও বেশি ভেঙে পড়বেন। তাই তাঁকে শক্ত থাকতে হবে। আলেয়া তাঁর মা-বাবার সামনে স্বাভাবিক হতে চেষ্টা করছেন। কিন্তু ভেতরে ভেতরে তাঁর সবকিছুই ভেঙে খানখান হয়ে যাচ্ছে। কোনো কিছুতেই যেন আর সামাল দিতে পারছেন না নিজেকে। তাঁর ভাবনা জুড়ে রয়েছে, সামনের দিনগুলো তাঁর কীভাবে যাবে। হাসপাতালের বেডে শুয়ে শুয়ে দিন কাটছে না গ্রামের চঞ্চল কিশোরী মেয়ে আলেয়ার। হাসপাতালের বড় বড় ডাক্তার দ্বারা উন্নতমানের চিকিৎসা চলছে। চেষ্টায় কোনোরকমের ত্রুটি হচ্ছে না। কয়েকটা অপারেশন করতে হয়েছে হাতে। তাতে কোনো লাভ হল না।

ইতিমধ্যে দেশ স্বাধীন হল। অনেকদিন হয়ে গিয়েছে। আলেয়াকে নিয়ে দেশে আসার মতন শরীর তাঁর ছিল না। থাকতে হল আরও কয়েক মাস। আলেয়া এবং তাঁর মা-বাবা দেশে আসার জন্য অস্থির। তখন আগরতলা হাসপাতালের ডাক্তার আলেয়াকে দেশে নিয়ে আসার জন্য অনুমতি দিলেন। কিন্তু দেশে এনে আগরতলা হাসপাতালের ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী তাঁকে বাড়িতে রাখা যাবে না। আগরতলা হাসপাতাল থেকে দেশে এসে বাড়িতে না গিয়ে আলেয়াকে সরাসরি কুমিল্লা সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হল। কুমিল্লা হাসপাতালে আলেয়াকে দীর্ঘদিন চিকিৎসা নিতে হয়েছে। কিন্তু তাঁর বাঁ হাতটা সারা জীবনের জন্য একেবারেই পঙ্গু হয়ে গিয়েছে। হাড়ের মাঝখান দিয়ে গুলি যাওয়ায় অনেক বড় ক্ষত হয়েছে। অনেক বড় বড় ডাক্তারের উন্নতমানের চিকিৎসাতেও কোনো ফল হয়নি। দীর্ঘ লম্বা সময় আগরতলা হাসপাতালে এবং কুমিল্লা হাসপাতালে কাটিয়ে অতঃপর ফিরে এলেন তাঁর নিজের গ্রামে, নিজের বাড়িতে। শত দুঃখের মাঝেও এটুকু আনন্দ যে, দেশ এখন স্বাধীন। মান গিয়েছে, হাত গিয়েছে, পাক হানাদার সেনাবাহিনীর বন্দুকের গুলিতে সারা শরীর ক্ষতবিক্ষত, তাতে কী, দেশ তো স্বাধীন। দেশ স্বাধীন মানে তিনিও স্বাধীন, আর দশজনের মতো করে আলেয়াও স্বাধীন দেশে সম্মানের সঙ্গে বাঁচবেন। কিন্তু না, আলেয়ার জন্য দেশ স্বাধীন হয়নি। কারণ, তাঁর মান-ইজ্জতহানি করেছে পাকিস্তানি মিলিটারিরা, তিনি কলঙ্কিনী। এখন তাঁর নাম শুধু আলেয়া বিবি না। তাঁর নামের আগে যোগ হয়েছে বীরাঙ্গনা। এখন তাঁকে বীরাঙ্গনা আলেয়া নামেই সবাই জানে। আর এই বীরাঙ্গনা শব্দটা পৃথিবীতে সবচেয়ে ঘৃণিত, নিকৃষ্ট, কুৎসিত যারা— তাদের জন্য। একটা সময় আলেয়ার জীবনের সকল স্বপ্ন, আশা, ভরসা এক এক করে ঝরে গিয়েছে তাঁর জীবন থেকে। শুধু বাড়ির নয়, তাঁর বাড়ির চারপাশের লোকজন থেকে শুরু করে আত্মীয়-স্বজন, পরিচিতজন থেকে শুরু করে সকল ছোট বড় এমনকি বৃদ্ধরাও আলেয়াকে দেখলে নানান খারাপ ইঙ্গিত করে কথাবার্তা বলতে শুরু করেছে। খারাপ খারাপ কথা বলে বকাবকি করে। সমাজও তাঁকে ভালো নজরে দেখছে না। এলাকার লোকজন তাঁকে অতিষ্ঠ করে তুলেছে। একে তো তাঁর ইজ্জতহানি করেছে পাক হানাদার মিলিটারিরা, তাঁকে সারা জীবনের জন্য পঙ্গু করে দিয়েছে, সেই জ্বালা যন্ত্রণায় জ্বলছে তাঁর জীবন, সারাক্ষণ ঘরের ভেতরে বসে কান্নাকাটি করেন। তার ওপর এলাকার মানুষের ঘৃণা তাঁর এবং তাঁর পরিবারের সকলের কাছে দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। তারপরও সহ্য করা ছাড়া আলেয়ার আর কোনো উপায় নেই।

দিন দিন আলেয়ার জীবনে শুধুই অন্ধকার নেমে আসতে থাকে। বদ্ধ ঘরের ভেতরে বসে বসে আলেয়া শুধু একটা কথাই মনের ভেতর নাড়াচাড়া করতে থাকেন, কী অপরাধ ছিল তাঁর, কেন তাঁর জীবনে এত বড় অভিশাপ নেমে এল, কী তাঁর অপরাধ? এই অভিশপ্ত জীবন যে কত ভারী, তা বহন করা কারো পক্ষে সম্ভব নয়। এমন হাজারো চিন্তাভাবনা তাঁর মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। আবার অন্যদিকে ঘর থেকে বাহির হলেই শুনতে হচ্ছে প্রতিটি মুহূর্তে নানারকমের খারাপ খারাপ কথা। এমন এক কঠিন ভয়াবহ মুহূর্তের মাঝ দিয়ে দিন অতিবাহিত হচ্ছে আলেয়ার। আলেয়া আস্তে আস্তে লোকালয় থেকে দূরে সরে আসতে থাকেন, নিজেকে নিজের অজান্তেই গৃহবন্দি করে ফেলেন, খুব বেশি প্রয়োজন না থাকলে বাইরে বের হন না। এমনকি কারো সঙ্গে কোনো কথাও বলেন না, খুব বেশি প্রয়োজন হলে হ্যাঁ-না বলে শেষ করে দিচ্ছেন। নিজে থেকে তো কিছুই বলেন না। আস্তে আস্তে মানসিক বিপর্যয়ে চলে যান। দিন দিন আলেয়ার এমন বিপর্যয় তাঁর মা-বাবা মেনে নিতে পারছেন না, আবার কোনোকিছু করতেও পারছেন না। তাঁর মা-বাবা গ্রামের মুরুব্বিদের দ্বারে দ্বারে গিয়ে হাতে পায়ে ধরে মেয়ের একটা গতি করে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। গ্রামের মুরুব্বি দুই একটা চেষ্টা করছেন। কিন্তু তেমন কেউ এগিয়ে আসছে না, বরং উল্টে লোকজন আরও বলে, ‘কারো বাড়িতে কোনো বিয়ে বা কোনো অনুষ্ঠানে আলেয়াদের বাড়ির কাউকে দাওয়াত দেওয়া হলে তাদের আগে থেকে বলে দেওয়া হতো, আলেয়াকে যেন না নিয়ে যাওয়া হয়। কারণ, শুভ কাজে আলেয়া উপস্থিত হলে সেই শুভ কাজের সব কিছুই অশুভ হয়ে যাবে। মোট কথা, স্বাধীন বাংলাদেশে সমাজের চোখে তখন আলেয়া কতটা ‘খারাপ’— এ থেকে এটি সহজেই অনুমান করা যায়। যতই দিন যাচ্ছে ততই আলেয়ার মানসিক অবস্থা খারাপ হচ্ছে। তখন গ্রামের কয়েকজন মুরুব্বি এগিয়ে আসছেন সহযোগিতার জন্য। তাঁরা একসঙ্গে বসে ঠিক করেন, আলেয়ার বিয়ে দিতে হবে, এছাড়া তাঁকে বাঁচানো সম্ভব না। আলেয়ার শরীর যদি আরও বেশি খারাপ হয়ে যায়, তখন তাঁকে কে দেখাশোনা করবে? মা-বাবা তো আর চিরদিন বেঁচে থাকে না। তাঁরা পাত্র দেখতে থাকেন। পাত্র আসছে, মেয়ে পছন্দ হচ্ছে, সব ঠিকঠাক। কিন্তু যখনই ১৯৭১-এ তাঁর উপর ঘটে যাওয়া পাক হানাদার বাহিনী কর্তৃক পৈশাচিক নির্যাতনের ঘটনা শোনে, তখন কেউ তাঁকে বিয়ে করতে রাজি হয় না, বিয়ে ভেঙে দিয়ে চলে যায়।

অনেকে আবার বলছে, শুধু যদি পঙ্গু থাকতো তাতে কোনো না কোনোভাবে মেনে নেওয়া যেতো কিন্তু ভিনদেশি সৈন্য দ্বারা যার ইজ্জতহানি হয়েছে, দশজনে জানে, তাঁকে নিয়ে সংসার করা যায় না। আরও অনেক খারাপ ভাষায় গালি দিয়ে চলে যেতো। যুদ্ধ শেষ হয়েছে প্রায় ৭/৮ বছর হয়েছে, কিন্তু বিয়ে হচ্ছে না। এই চিন্তায় তাঁর মা-বাবা অসুস্থ হয়ে যাচ্ছেন। আলেয়া সহ তাঁর বাবা এবং মুরুব্বিরা— যাঁরা আলেয়ার মঙ্গল চান, তাঁরা একেবারে হতাশ হয়ে পড়েছেন। অনেকে আশা ছেড়ে দিয়ে বলাবলি করছেন, মেয়েটার কোনো গতি হল না। তাঁর নিরাপদ একটা আশ্রয় দরকার। কাজ করে যে খাবে তারও কোনো পথ নেই। যুদ্ধের সাত বছর পর ১৯৭৮ সালে আলেয়ার জন্য একটি বিয়ের প্রস্তাব এল। তখন তাঁর বাড়ির লোকজন সহ যে সকল মুরুব্বি তাঁর বিয়ে নিয়ে চিন্তাভাবনা করছেন, তাঁরা সকলে একসঙ্গে বসে আলোচনা করে ঠিক করেন, আগে আলেয়ার সব ঘটনা ছেলেকে জানানো হবে, পরে যদি ছেলে রাজি হয় তখন মেয়ে দেখাশোনা-কথাবার্তা হবে এবং তাই করা হল। আগে পাত্রকে আলেয়ার সম্পর্কে সবকিছু বলা হল। সব শুনে পাত্র সকলের সামনে কিছু কথা বলেন। ‘যখন আলেয়ার সব কথা জানতে পারি, তখন অনেক চিন্তাভাবনা করে মনে মনে ঠিক করি, আমি তাঁকেই বিয়ে করবো। যখন আমি আমার সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে দিয়েছি, তখন থেকেই আমার গ্রামের লোক, বাড়ির লোক, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধব সবাই আলেয়াকে বিয়ে করতে নিষেধ করছে। তারা বলেছে যে, আলেয়া পাকিস্তানী হানাদার মিলিটারি দ্বারা নির্যাতনের শিকার। উপরন্তু সে পঙ্গু, তার একটা হাত নেই, সংসারের সব কাজ করতে পারবে না। এসব কথা শুনে আমি তাদের বলেছি যে, সে তো তার নিজের ইচ্ছায় ইজ্জত নষ্ট করেনি। জোর করে তাকে নষ্ট করা হয়েছে। জোর করে যদি কেউ কাউকে নষ্ট করে, তাতে সে নষ্ট হয় না’— জানান আলেয়ার স্বামী ইউনুছ মিয়া৷ আলেয়ার স্বামী ইউনুছ মিয়া আরও বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ বিষয়টা ১৯৭১ সালে আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি। তাই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করিনি। এজন্য আমার ভেতরে একটা অপরাধবোধ কাজ করছিল। আমি কেন যুদ্ধে যেতে পারিনি— নিজেই নিজেকে বহুবার এ প্রশ্ন করেছি। আর মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যতই ভেবেছি, ততই মনের ভেতরে একটা অশান্তি, একটা অপরাধবোধ কাজ করেছে। ভাবতে থাকি, কী করে এই অপরাধবোধ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। ভাবতে ভাবতে একসময় মনে হলো, আমি একজন বীরাঙ্গনাকে বিয়ে করবো। যখনই আলেয়ার কথা জানতে পারি, তখনই আমি ঠিক করি, আলেয়াকেই আমি বিয়ে করবো।’ প্রত্যন্ত গ্রামের বীরাঙ্গনা আলেয়া বিবি ও তাঁর স্বামী ইউনুছ মিয়ার জীবনের গল্প শুনতে শুনতে আমাদের মনের মধ্যে বিষণ্নতা আর আনন্দ একসঙ্গে খেলা করে। এই দম্পতির গল্প আমাদের অন্তর ছুঁয়ে যায়।

(লেখক মুক্তিযুদ্ধ গবেষক ও প্রাবন্ধিক)

Advertisement