১০ টি ট্রেড ইউনিয়নের ডাকে নতুন শ্রম কোড সহ ১৭ দফা দাবির ভিত্তিতে ডাকা ভারত বনধের জেরে রাজ্য জুড়ে বিক্ষিপ্ত অশান্তি। বনধকে সফল করতে বামেদের হয়রানির চেষ্টায় নাজেহাল হন বঙ্গবাসী। একাধিক জায়গায় বনধ সমর্থকরা জোর করে অশান্তির চেষ্টা করেছে বলেও অভিযোগ উঠেছে বিভিন্ন রাজনৈতিক মহল থেকে। সকাল থেকেই শহর কলকাতা সহ রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় অশান্তির জেরে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। কার্যত বিধানসভা ভোটের পূর্বে রাজ্যে প্রায় মুছে যাওয়া বামপন্থীরা এই বনধে নিজেদের অস্তিত্ব জাহিরের চেষ্টা করেছেন বলে মনে করছে রাজনৈতিক মহল। এই বনধকে সফল করতে জোর করে বামেদের অবরোধ ও অশান্তির জেরে যাতে স্বাভাবিক জনজীবন ব্যাহত না হয়, তার জন্য জেলায় জেলায় সক্রিয় ছিল রাজ্য পুলিশ। কলকাতা পুলিশও শহরে অশান্তি রোধে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। প্রশাসনের তৎপরতায় কয়েকটি বিক্ষিপ্ত ঘটনা ছাড়া মোটের উপর শান্তিপূর্ণ ছিল রাজ্য।
অন্যদিকে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বরাবরই বনধের বিরোধিতা করে এসেছেন। এভাবে বনধ, ধর্মঘটের মাধ্যমে কলকারখানা ও অফিসে মানুষের শ্রমদিবস নষ্ট করার বিরোধিতা করে এসেছেন। তাঁর পথ অনুসরণ করে জোর করে বনধ পালনে বাধ্য করে স্বাভাবিক জনজীবন যাতে ব্যাহত করা না হয়, সেজন্য বেশ কিছু জায়গায় রাস্তায় নামে রাজ্যের শাসকদল তৃণমূলও। তাঁরা বামেদের শ্লোগানের জবাবে পাল্টা স্লোগান দেন। জোর করে মানুষকে বনধ পালনেরও বিরোধিতা করেন।
প্রসঙ্গত, বনধের পুরোনো রীতি বজায় রেখে বামপন্থী আন্দোলনকারীরা বিভিন্ন জায়গায় জোর করে ট্রেন ও বাস অবরোধ করেন। সেই অবরোধ সরাতে গেলে বিভিন্ন জায়গায় পুলিশের সঙ্গে তাঁদের ধ্বস্তাধ্বস্তি ও বচসা শুরু হয়। সবচেয়ে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় যাদবপুরের ৮বি বাস স্ট্যান্ডের কাছে। এখানে বনধ সমর্থকরা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর কুশপুতুল দাহ করেন এবং টায়ার জ্বালান। সেই জ্বলন্ত টায়ারের আগুন ছিঁটকে পাশেই ফুটপাথে থাকা দোকানে আগুন লেগে যায়। পরে পুলিশ এসে সেই আগুন নেভায়। এছাড়া অবরোধ হয় যাদবপুর স্টেশনেও।
বুধবার সকালে বনধের সমর্থকরা নিউটাউনের গৌরাঙ্গনগরে সিপিএম-এর দলীয় কার্যালয় থেকে অটো স্ট্যান্ড পর্যন্ত মিছিল করেন। টায়ার জ্বালিয়ে বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করেন। আবার বাঙুর অ্যাভেনিউ থেকে দমদমের যশোর রোড পর্যন্ত বনধের দাবিতে মিছিল করেন। সেখানে অবরোধ করেন সিপিএম-এর কর্মী সমর্থকরা। সেই অবরোধ তুলতে গেলে পুলিশের সঙ্গে ধ্বস্তাধ্বস্তি ও বচসা শুরু হয়। আবার বাম কর্মী-সমর্থকরা উত্তর ২৪ পরগনার শ্যামনগর ও ইছাপুর রেল স্টেশনের মাঝে ২২ নম্বর লেভেল ক্রসিংয়ের গেট অবরোধ করেন। প্রায় ৩০ মিনিট পর সেই অবরোধ তুলে দেয় পুলিশ।
এদিনের ধর্মঘট নিয়ে হাওড়ার ডোমজুড়েও শুরু হয় অশান্তি। বাম কর্মী-সমর্থকরা এদিন জোর করে বাস ও লরি চালকদের আটকানোর চেষ্টা করেন। এমনকি জোর করে বাস ও লরি চালকদের নামানোর চেষ্টা করলে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। শুরু হয় কড়া পদক্ষেপ। পরিস্থিতি সামাল দিতে বিশাল পুলিশ বাহিনী নামানো হয়। লাঠিচার্জ করে ছত্রভঙ্গ করা হয় আন্দোলনকারীদের। পুলিশের লাঠির আঘাতে দু’জন বাম সমর্থক আহত হয়েছেন বলে সূত্রের খবর।
অন্যদিকে, বনধকে কেন্দ্র করে হাওড়ার বালি জুটমিলের কাছে কিছু সময়ের জন্য কর্মবিরতি পালন করেন জুটমিলের বাম কর্মী-সমর্থকরা। আগাম সতর্কতা হিসেবে বালি থানার পুলিশকে সেখানে মোতায়েন করা হয়। ধর্মঘটের সমর্থনে উলুবেড়িয়ার গরুহাটা মোড়ে সিপিএম-এর কর্মী সমর্থকরাও আন্দোলনে নামেন। আবার ডোমজুড় থানার পুলিশ দুইজন সিপিএম কর্মীকে আটক করেছে বলেও খবর পাওয়া গিয়েছে।
বামপন্থী শ্রমিক সংগঠনের এই ধর্মঘটের জেরে বিক্ষিপ্ত অশান্তির সৃষ্টি হয় হুগলি জেলাতেও। এই জেলার ভদ্রেশ্বরের নর্থ জুটমিল গেটে শ্রমিকদের পিকেটিং চলে। এছাড়া বাঁশবেড়িয়ার গ্যাঞ্জেস জুটমিলেও কাজে যোগ না দিয়ে অবরোধে শামিল হন শ্রমিকরা। যদিও পরে পুলিশ এসে সেই অবরোধ তুলে দেয়।
সিপিএম সমর্থকরা পূর্ব বর্ধমানের সমুদ্রগড় রেলস্টেশনেও আপ হাওড়া-কাটোয়া লোকাল ট্রেন আটকে অবরোধ করেন। সেই অবরোধের জেরে সাময়িকভাবে আটকে যায় হাওড়াগামী ডাউন ব্যান্ডেল লোকাল ট্রেন। পরে পুলিশ এসে সেই অবরোধ তুলে দেয় বলে জানা গিয়েছে। এদিন বাম সমর্থকরা হলদিয়া রেল স্টেশনেও অবরোধ করেন।
খড়গপুর শিল্পাঞ্চলে বনধের কোনও প্রভাব পড়ল না। এখানকার কলাইকুন্ডা, রূপনারায়নপুর, গোকুলপুর সহ বিস্তীর্ণ শিল্পাঞ্চলের বিভিন্ন কলকারখানায় কাজকর্ম অন্যান্য দিনের মতোই চলেছে। শ্রমিকদের হাজিরা ছিল স্বাভাবিক। সকালে বনধ সমর্থকরা খড়গপুর শহরের এলআইসি অফিসের গেট বন্ধ করে দেন। গেটের সামনে পিকেটিং চলাকালীন পুলিশ গিয়ে ৬ জন বনধ সমর্থককে আটক করে এবং অফিসের দরজা খুলে দেয়। তবে খড়গপুর সহ অন্যান্য জায়গায় রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলি বন্ধ ছিল।
আবার সকালে দাঁতনের মনোহরপুর এবং খড়গপুর ২ নং ব্লকের লছমাপুরে জাতীয় সড়ক অবরোধ করেন বনধ সমর্থকেরা। অল্প সময়ের মধ্যেই পুলিশ বনধ সমর্থকদের সরিয়ে দেয়।
সিটু সহ দশটি শ্রমিক সংগঠনের ডাকা ধর্মঘটকে কেন্দ্র করে বুধবার উত্তেজনা ছড়ায় আসানসোল সিটি বাস স্ট্যান্ডে। এদিন সকাল থেকেই বনধের সমর্থনে বাম শ্রমিক সংগঠন সিটু একটি মিছিল বের করে আসানসোল সিটি বাসস্ট্যান্ডে। অপরদিকে সকাল থেকেই তৃণমূলের শ্রমিক সংগঠন আইএনটিটিইউসি-র কর্মী সমর্থকরা বাসের চাকা সচল রাখতে সিটি বাসস্ট্যান্ডে জমায়েত শুরু করেন। সকালে আসানসোল থেকে কলকাতাগামী একটি বাস যখন সিটি বাস স্ট্যান্ড থেকে বের হচ্ছিল, সেই সময় সিটু সমর্থকরা বাসটি আটকানোর চেষ্টা করেন। সঙ্গে সঙ্গে বাধা দেন তৃণমূল সমর্থিত আইএনটিটিইউসি’র সমর্থকরা। শুরু হয় তুমুল উত্তেজনা। পরে আসানসোল দক্ষিণ থানার পুলিশ ঘটনাস্থলে এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে এবং বাসটি কলকাতার উদ্দেশ্যে রওনা হয়।
বীরভূমের সিউড়িসহ জেলার বিভিন্ন জায়গায় বামেদের ডাকা ধর্মঘটের মিশ্র প্রভাব পড়ে। বামেদের পক্ষ থেকে দিনের শুরুতেই এই ধর্মঘটকে সফল করার চেষ্টা চালানো হয়। তবুও সকাল থেকেই সিউড়ি বাস স্ট্যান্ড থেকে যাতায়াত করে সরকারি ও বেসরকারি বাস, টোটো-অটো সহ বিভিন্ন যানবাহন। তবে বেশ কিছু বেসরকারি বাস যাতায়াত বন্ধ ছিল।
বাঁকুড়াতেও এই বনধের খন্ডচিত্র লক্ষ্য করা যায়। বেশ কিছু সময়ের জন্য গোবিন্দনগর বাসস্ট্যান্ড থেকে বাস চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এই রুটের বাস মালিকরা বাস চালানোর নির্দেশ দিলেও কর্মীরা কাজে যোগ দেননি।
বুধবার দক্ষিণবঙ্গের মতো উত্তরবঙ্গেও বনধের খন্ডচিত্র লক্ষ্য করা যায়। দক্ষিণ দিনাজপুরের বালুরঘাট সরকারি বাস স্ট্যান্ডের সামনে পিকেটিং করা হয়। পুলিশের পক্ষ থেকে মাইকিং করে রাস্তা অবরোধ বেআইনি বলে ঘোষণা করা হয়। এখানে এক অবরোধকারীকে টেনে-হিঁচড়ে তুলে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ উঠেছে পুলিশের বিরুদ্ধে। হাতে গোনা কয়েকটি বাস বাদে সকাল থেকেই বালুরঘাটের অধিকাংশ বেসরকারি বাস বন্ধ রয়েছে।
বামেদের ডাকা বনধকে ঘিরে উত্তেজনা ছড়ায় মালদায়। একাধিক গাড়িতে লাঠির আঘাত, তার পাশাপাশি পুলিশকে ঘিরে বিক্ষোভ দেখতে লক্ষ্য করা যায়। তবে বামেদের শ্লোগানের জবাবে পাল্টা স্লোগান দেয় তৃণমূলের শ্রমিক সংগঠনও।
সকাল থেকে বনধে মিশ্র সাড়া জলপাইগুড়ি জেলায়। ধূপগুড়ি, জলপাইগুড়ি সহ জেলার বিভিন্ন জায়গায় বনধের সমর্থনে সাত সকালেই রাস্তায় নেমে পড়েন বনধ সমর্থকরা। বুধবার সকালে ধূপগুড়ি শহরে বনধের সমর্থনে মিছিল বের করেন বনধ সমর্থকরা। লাল পতাকা হাতে বনধ সমর্থকদের ধূপগুড়ি শহরের বিভিন্ন দোকান বন্ধ করতে দেখা যায়। ধূপগুড়ির পাশাপাশি জলপাইগুড়িতেও রাস্তায় নামেন বাম কর্মী-সমর্থকরা। তবে অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে জলপাইগুড়িতে যথেষ্ট তৎপর ছিল পুলিশ। বেশ কয়েকজন বনধ সমর্থককে পুলিশ আটক করে বলে খবর পাওয়া যায়।