নারদা কাণ্ড । সিবিআই গ্রেফতার করল আইপিএস অফিসার মির্জাকে

কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার গােয়েন্দাদের হাতে গ্রেফতার হলেন বর্ধমানের প্রাক্তন পুলিশসুপার সৈয়দ মহম্মদ হােসেন মির্জা ওরফে এসএমএইচ মির্জা।

Written by SNS September 27, 2019 12:43 pm

বর্ধমানের প্রাক্তন পুলিশসুপার সৈয়দ মহম্মদ হােসেন মির্জা। (File Photo: IANS)

নারদা তদন্তে বড়সড় পদক্ষেপ সিবিআইয়ের। বৃহস্পতিবার কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার গােয়েন্দাদের হাতে গ্রেফতার হলেন বর্ধমানের প্রাক্তন পুলিশসুপার সৈয়দ মহম্মদ হােসেন মির্জা ওরফে এসএমএইচ মির্জা। এদিন ব্যাংকশাল আদালতে সিবিআইয়ের বিশেষ কক্ষে প্রাক্তন পুলিশসুপারকে পাঁচদিনের হেফাজতে রাখার আবেদন জানিয়ে তােলা হয়। সেই আবেদন মঞ্জুর করে বিচারক ওই পুলিশকর্তাকে ৩০ সেপ্টেম্বর অর্থাৎ সােমবার পর্যন্ত সিবিআই হেফাজতের নির্দেশ দিয়েছেন। আর নারদাকাণ্ডে এদিন সিবিআইয়ের এই পদক্ষেপের পরে রাজ্যজুড়ে হইচই পড়ে যায়। রাজ্যের প্রধান চার রাজনৈতিক দলই তাদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে এই ঘটনায়। মুখ খােলেন স্টিং অপারেশনের কর্তাও। যদিও মির্জাকে এক বছরেরও বেশি সময় ধরে সাসপেন্ড রেখেছে রাজ্য প্রশাসন।

প্রকাশ, সম্প্রতি সারদা এবং নারদা দুই মামলাতেই সক্রিয় হয়ে উঠেছে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা। সারদা মামলায় একদিকে যেমন পুলিশকর্তা রাজীব কুমারকে গ্রেফতারির মরিয়া চেষ্টা চলছে, তারই পাশাপাশি চলছে নারদা মামলার তদন্তও। ইতিমধ্যেই, ১৩ জন অভিযুক্তের অধিকাংশের কণ্ঠস্বরের নমুনাও সংগ্রহ করে সিবিআই। এদিন প্রাক্তন পুলিশসুপার এসএমএইচ মির্জাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডেকে পাঠানাে হয়েছিল নিজাম প্যালেসে। সিবিআইয়ের সেই ডাকে সাড়া দিয়ে এদিন সকালে নিজাম প্যালেসে সিবিআই দফতরে পৌঁছায় মির্জা। সেখানেই তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। আর এই গ্রেফতারির পরেই সিবিআইয়ের এই পদক্ষেপ নিয়ে শুরু হয়েছে নানান কাটাছেঁড়া।

সিবিআই সূত্রে খবর, ২০১৪ সালে বর্ধমানের পুলিশসুপার থাকাকালীন রাজ্যের শাসকদলের নেতাদের হয়ে টাকা নেওয়ার অভিযােগ রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। এমনকি নারদা স্টিং ফুটেজের যে ভিডিও প্রকাশ্যে এসেছিল, সেখানে টাকা নিতে দেখা গিয়েছিল মির্জাকে। ওই ভিডিও থেকেই জানা যায়, মির্জা নারদাকর্তা ম্যাথু স্যামুয়েলের কাছ থেকে ৫ লক্ষ টাকা নিয়েছিলেন। হাইকোর্টের নির্দেশে সিবিআইয়ের করা এফআইআরে ১২ নম্বরে নাম রয়েছে ওই পুলিশকর্তার। কেন তিনি ওই টাকা নিয়েছিলেন, কারও নির্দেশে টাকা নিয়েছিলেন কি, সে বিষয়ে তাঁকে আগেই জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছিল। পরে তাঁর বয়ান রেকর্ডের পাশাপাশি কণ্ঠস্বরের নমুনা সংগ্রহ করা হয়। কিন্তু প্রথমেই কেন মির্জাকে গ্রেফতার করল সিবিআই তা নিয়ে উঠছে প্রশ্ন।

সূত্রের খবর, মির্জার থেকেই জট খুলতে শুরু করবে ম্যাথু স্যামুয়েলের স্টিং অপারেশনের ফুটেজের রহস্যের। তাই ফুটেজের সূত্র ধরেই এগােতে চাইছে সিবিআই আধিকারিকরা। আর সেখানেই লুকিয়ে রয়েছে মির্জার গ্রেফতারির কারণ। সিবিআই সূত্রে খবর, ফুটেজ অনুযায়ী, ম্যাথুর উল্টোদিকে বসে রয়েছেন এই সরকারি আধিকারিক। এবং ম্যাথুর সঙ্গে টাকা-পয়সা নিয়ে কথা বলার সময়েই তাঁর ফোনে এক ব্যক্তি ফোন করেন। টাকা কোথায় পাঠানাে হবে, ওই ব্যক্তিই মির্জাকে নির্দেশ দেন। এবং ওই ফোনটি পাওয়ার পর মির্জা কাকে বা কাদেরকে ফোন করেছিলেন টাকা নিয়ে যাওয়ার জন্য? কিন্তু এদিনের জেরায় সেসব প্রশ্নের উত্তর দেননি মির্জা। তাঁর কথাতেও একাধিক অসঙ্গতি মিলেছিল। তাই তাঁকে নিজেদের হেফাজতে নিয়ে এসব প্রশ্নের উত্তর পেতে চান সিবিআই আধিকারিকরা।

উল্লেখ্য, নারদাকাণ্ডে মােট ১৩ জন অভিযুক্ত। তাদের মধ্যে মির্জাই একমাত্র সরকারি আধিকারিক। এবং ফুটেজ অনুযায়ী, তিনিই টাকা কোথায় পাঠানাে হবে, তা নির্দেশ দিয়েছিলেন। তাই তাঁর থেকেই এই ফুটেজ রহস্যের জট খুলতে চাইছেন তদন্তকারীরা। সূত্রের খবর, তালিকায় থাকা অভিযুক্তদের মধ্যে একজন অভিযুক্তের সঙ্গে মুখােমুখি বসানাে হবে মির্জাকে। মুখােমুখি বসিয়ে চলবে জেরা। পিটিশনে এমনটাই জানিয়েছে সিবিআই।

এদিন সিবিআইয়ের আইনজীবী দীনেশ কুমার বলেন, মির্জার বক্তব্যে প্রচুর অসঙ্গতি রয়েছে। বহু তথ্য তিনি গােপন করছেন। এফআইআরে নাম থাকা অন্য এক অভিযুক্তের সঙ্গে মুখােমুখি জেরা তিনি এড়ানাের চেষ্টা করছেন। সেই কারণেই তাঁকে হেফাজতে নিয়ে জেরা করা প্রয়ােজন। অন্যদিকে মির্জার আইনজীবী সায়ন দে পাল্টা সওয়াল করেন, ‘মির্জাকে ৯ বার সিবিআই জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডেকেছিল। প্রত্যেক বারই তিনি এসেছিলেন। সিবিআইকে আগাগােড়া সহযােগিতা করেছেন। তিনি একজন শীর্ষ পুলিশ আধিকারিক। পালিয়ে যাবেন, এমন সম্ভাবনাও নেই। তা হলে হঠাৎ গ্রেফতার করার প্রয়ােজন পড়ল কেন?’

প্রসঙ্গক্রমে, গােটা ঘটনার শুরু হয় ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনের আগে প্রকাশ্যে আসা নারদের এক স্টিং ফুটেজ থেকে। ম্যাথু স্যামুয়েলের এই স্টিং অপারেশন নিয়ে রীতিমত তােলপাড় শুরু হয় রাজ্য ও জাতীয় রাজনীতিতে। তারপরে হাইকোর্টের নির্দেশে তদন্তে নামে সিবিআই। সেই সময় নারদা নিউজের প্রধান ম্যাথু স্যামুয়েল দাবি করেন, টাকার বিনিময়ে ‘রাজনৈতিক রক্ষাকবচ’ ও ‘সুবিধা’ পাইয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন রাজ্যের শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেসের একাধিক নেতা ও মন্ত্রীরা।

অভিযােগ, নারদা ভিডিয়ােয় টাকা নিতে দেখা গিয়েছে, মির্জাসহ প্রয়াত তৃণমূল নেতা ও কলকাতার ডেপুটি মেয়র ইকবাল আহমেদ, প্রাক্তন পরিবহণ মন্ত্রী মদন মিত্র, অপরূপা পােদ্দার ও অন্য নেতাদের। অভিযােগ, ওই টাকার বিনিময়ে ম্যাথু স্যামুয়েলের কাল্পনিক সংস্থা ইমপেক্স’কে বেআইনিভাবে সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন তাঁরা। এসএমএইচ মির্জাকে সেই ফুটেজে ম্যাথু স্যামুয়েলকে তৃণমূলের তথা প্রশাসনের শীর্ষ আধিকারিকদের সঙ্গে যােগাযােগ করিয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিতে দেখা যায়। যদিও সেই ফুটেজের সত্যতা নিয়ে এখনও সন্দেহ আছে। তবে এদিন মির্জার গ্রেফতারির পরেই এই স্টিং অপারেশনের কর্তা ম্যাথু স্যামুয়েল নিজের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন।

নারদা টেপ ফঁসের ৩ বছর পর সিবিআইয়ের পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়ে ম্যাথু এক সংবাদসংস্থাকে জানায়, ‘এটা খুব ভালাে খবর। যে স্টিং অপারেশন আমি করেছিলাম, তার ফল মিলতে শুরু করেছে। লড়াই সবে শুরু হয়েছে। এই ধরনের দুর্নীতিতে জড়িত আমলাদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ করা দরকার। সেই প্রক্রিয়া শুরু হওয়ায় ইতিবাচক বার্তা দিল সিবিআই। সকলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।’

এদিন নারদা স্টিংকে রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র বলে আখ্যা দেওয়া হয়েছিল। সেকথা স্মরণ করিয়ে স্যামুয়েল বলেন, ‘আজ খুশির দিন। ২০১৬ সালে মার্চে স্টিংয়ের টেপ প্রকাশ করেছিলাম। তখন বলা হয়েছিল, রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র, কেউ ওঁর পিছনে আছে। বাংলার পুলিশই পিছনে পড়ে গিয়েছিল। এটা কঠোর পরিশ্রমের ফল। রাজনৈতিক প্রতিহিংসা হলে আজ এই দিনটা আসত না। আইপিএস অফিসারকে গ্রেফতার করেছে সিবিআই। বাংলার বড় বড় রাজনীতিকদের সঙ্গে দেখা করিয়ে দিয়েছিলেন উনি।’

এদিন মির্জার এই গ্রেফতারির পরে সিপিএম নেতা তথা আইনজীবী বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য বলেন, ‘আইনি পদ্ধতিতে এটাই সঠিক প্রক্রিয়া। দুর্নীতি উন্মােচনের স্বার্থে সব অভিযুক্তকেই গ্রেফতার করা প্রয়ােজন। আগেই করা উচিত ছিল। কেন করা হয়নি, সেটাই প্রশ্ন।’

একই প্রশ্ন তােলেন বাম পরিষদীয় দলের নেতা সুজন চক্রবর্তী। তিনি বলেন, প্রকাশ্যে এরা টাকা খেয়েছে সবাই দেখেছে। তৃণমূল দলের হয়ে আর মুখ্যমন্ত্রীর হয়ে যারা টাকা তােলে, তারা আইপিএস নয়, আইপিএসের কলঙ্ক। মুখ্যমন্ত্রীর প্রশ্রয়ে এসব চলেছে। এখন মুখ্যমন্ত্রী বলতে চাইছে, যাকে পারিস তাকে ধর কিন্তু পিসি-ভাইপােকে নিয়ে টানাটানি কোরাে না।

প্রদেশ কংগ্রেসও কড়া প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। রাজ্য বিজেপির সভাপতি দিলীপ ঘােষ এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘এত বছর লেগে গেল! আরও আগে হলে মানুষের বিশ্বাস বাড়ত। সত্য উদঘাটন হােক তাড়াতাড়ি। এই পুলিশকর্তা নাকি বলেছিলেন, পার্টির জন্য টাকা তুলে দিতে হয়! ভাবা যায়। এ রাজ্যে যে ধরনের দুর্নীতি হয়েছে, মানুষের টাকা গিয়েছে— দোষীরা সকলে সাজা পাক।’

দিলীপ ঘােষের সহকর্মী এই মামলায় অন্যতম মুখ মুকুল রায় এদিন মির্জার গ্রেফতারির বিষয়ে জানান, তদন্তের সাপেক্ষে সিবিআই যেটা প্রয়ােজন মনে করবে সেটা করবে। আর যাদের ডাকবে তাদের সহযােগিতা করা উচিত। ঘটনাক্রমে ধৃত পুলিশকর্তা মুকুল রায়ের ঘনিষ্ঠ হিসেবেই তৎকালীন সময়ে পরিচিত ছিলেন। এদিন তিনি বলেন, তাঁর কাছে বর্ধমানে ব্যবসার জন্য কিছু লােক এসেছিল, তিনি তাদের বর্ধমানে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। এদিন মির্জার গ্রেফতারি নিয়ে জিজ্ঞাসা করা হলে কোনও জবাব দিতে চাননি তৃণমূলের মহাসচিব তথা রাজ্যের মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়। তিনি কেবল বলেন, ‘কে কোথায় গ্রেফতার হল, তা নিয়ে কি আমার মন্তব্য করা সাজে।’

 

আরো পড়ুন । আমি খুশি, বললেন নারদাকর্তা ম্যাথু স্যামুয়েল