সৈয়দ হাসমত জালাল
সম্প্রতি সংসদে ‘বন্দে মাতরম’–এর ১৫০ বছর উদ্যাপন উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী কংগ্রেস ও জওহরলাল নেহরুকে আক্রমণ করে বলেন, ১৯৩৭ সালে গানটির গুরুত্বপূর্ণ স্তবকগুলি কেটে দেওয়া হয়েছিল এবং সেই সিদ্ধান্তই নাকি দেশভাগের সৃষ্টি করেছিল। পরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহও একই কথা পুনরাবৃত্তি করে জানান, গানটির ‘বিভক্ত রূপ’-ই ভারতের রাজনৈতিক বিভাজন এবং শেষ পর্যন্ত দেশভাগের মূল কারণ।
Advertisement
কিন্তু ঐতিহাসিক তথ্য, সমসাময়িক দলিল এবং স্বাধীন ভারতের সাংবিধানিক সিদ্ধান্ত— কোনোটিই এই দাবিকে সমর্থন করে না। বরং দেখা যায়, মোদী ও শাহের বক্তব্যের সঙ্গে প্রকৃত ইতিহাসের মিল নেই।
১৯৩৭ সালে ঠিক কী ঘটেছিল, তা দেখে নেওয়া যাক। কংগ্রেস ১৯৩৭ সালের নির্বাচনে বড় জয় পাওয়ার পর বিভিন্ন রাজ্যে সরকার গঠন করে। তখনই ‘বন্দে মাতরম’ নিয়ে মুসলিম লিগ আপত্তি তোলে— বিশেষত গানটির দ্বিতীয়াংশে দুর্গার আরাধনা থাকায়। রাজনৈতিক বাস্তবতা হচ্ছে— কংগ্রেসের অধীনে তখন বহু রাজ্যে হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মানুষ বসবাস করেন এবং সবার প্রতিই সমান আচরণ বজায় রাখা স্বাভাবিকভাবেই শাসকদলের দায়িত্ব ছিল। এই পরিস্থিতিতে কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি সিদ্ধান্ত নেয়, রাজনৈতিক বা সর্বজনীন জাতীয় সমাবেশে গাওয়া হবে গানটির প্রথম দুটি স্তবক। কারণ এই স্তবকদুটি ধর্মনিরপেক্ষ, এতে রয়েছে দেশের সুন্দর প্রাকৃতিক বর্ণনা ও তুলনামূলকভাবে সর্বজনীন।
Advertisement
পরের স্তবকগুলিতে স্পষ্টই দেবী দুর্গার আরাধনা রয়েছে, কিন্তু তা নিষিদ্ধ করা হয়নি, বরং সাধারণ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে গাওয়া যাবে, এমন স্পষ্ট নির্দেশ ছিল। এই সিদ্ধান্তটি কংগ্রেসের পক্ষ থেকে কোনও ‘আত্মসমর্পণ’ ছিল না, বরং বহু-ধর্মসম্পন্ন ভারতের বাস্তবতা বিবেচনা করেই নেওয়া হয়েছিল এরকম একটি সমন্বয়মূলক সিদ্ধান্ত।
১৯৩৭ সালে এই বিতর্ক ঘনীভূত হলে নেহরু ও সুভাষচন্দ্র বসু দু’জনই পরামর্শ চান রবীন্দ্রনাথের কাছে। রবীন্দ্রনাথ খুব স্পষ্ট ভাষায় বলেন, ‘বন্দে মাতরম’-এর প্রথমাংশ অত্যন্ত সুন্দর, সর্বজনীন এবং জাতীয় সমাবেশে গাওয়ায় অসুবিধা নেই। কিন্তু দ্বিতীয়াংশে দুর্গা-স্তব থাকায় তা সকল ধর্মের মানুষের মিলনমঞ্চে গাওয়ার উপযোগী নয়। তবে তিনি এও বলেন যে, গানটির সঙ্গে বিপুল সংখ্যক বিপ্লবীর আত্মত্যাগ জড়িয়ে আছে, ফলে গানটির প্রতি শ্রদ্ধা থাকা উচিত।
অতএব গান থেকে অংশ বাদ দেওয়া কোনও ‘দ্বেষ বা বিরোধিতা’ ছিল না, বরং সাম্প্রদায়িক শান্তি ও রাজনৈতিক সংহতির কথা ভেবে নেওয়া হয়েছিল এরকম একটি ভারসাম্যপূর্ণ সিদ্ধান্ত। এইসঙ্গে মনে রাখা দরকার, ১৮৯৬ সালে ‘বন্দে মাতরম’ গানের প্রথম দুটি স্তবকে সুর দিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তা গেয়েছিলেন ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশনে। এই প্রথম রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে গাওয়া হয়েছিল এই গান। আর সেই সুর ও গান পছন্দ করেছিলেন স্বয়ং বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।
তাছাড়া দেশভাগের সঙ্গে এই গান-বিতর্কের কোনও সম্পর্কই নেই। পাকিস্তান সৃষ্টির পেছনে যে কারণগুলি ছিল, তা হলো— ব্রিটিশদের বিভাজননীতি, পৃথক নির্বাচনী ব্যবস্থা, হিন্দু-মুসলিম রাজনৈতিক সংগঠনের উদ্দেশ্যের মধ্য সংঘাত, জিন্নাহর ‘ডাইরেক্ট অ্যাকশন’ এবং র্যাডক্লিফ লাইন নির্ধারণের মতো বহুস্তরবিশিষ্ট রাজনৈতিক চক্রের মতো নানা বিষয়। বন্দে মাতরমের দুটি স্তবক রাজনৈতিক সমাবেশে না গাওয়া কোনোভাবেই এরকম জটিল ঘটনাকে কখনোই প্রভাবিত করেনি। এ নিয়ে কোনও ঐতিহাসিক দলিল নেই, কোনও রাজনৈতিক গবেষণাও এমন দাবি সমর্থন করে না।
স্বাধীনতার পর ইন্ডিয়ান কনস্টিটুয়েন্ট অ্যাসেম্বলি ১৯৫০ সালের ২৪ জানুয়ারি সিদ্ধান্ত নেয় ‘জনগণমন’ হবে ভারতের জাতীয় সঙ্গীত। ‘বন্দে মাতরম’ থাকবে জাতীয় গানের মর্যাদায় এবং এর প্রথম দুটি স্তবক রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে গাওয়া হবে। সেইসঙ্গে এই গানের ঐতিহাসিক ভূমিকার প্রতি স্বীকৃতি জানাবে রাষ্ট্র। এই সিদ্ধান্ত সর্বসম্মতিক্রমে নেওয়া হয়েছিল, নেহরুর একক সিদ্ধান্ত বা কংগ্রেসের কোনও ‘সমঝোতা’ এর মধ্যে ছিল না।
মোদীর বক্তব্য যেসব কারণে ঐতিহাসিকভাবে ভুল, সেগুলি হলো—
১. কংগ্রেস বন্দে মাতরম থেকে কোনও স্তবক বাদ দেয়নি, শুধু রাষ্ট্রীয় সমাবেশে ব্যবহারের জন্য নির্দিষ্ট অংশ বেছে নিয়েছিল।
২. ‘বন্দে মাতরম’ বিতর্ক দেশভাগের কারণ নয়, রাজনৈতিক ইতিহাসে এর কোনও প্রমাণ নেই।
৩. ১৯৩৭-এর সিদ্ধান্ত ছিল সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা কমানোর প্রয়াস, কোনও পক্ষের ‘চাপ’ বা ‘পরাজয়’ নয়।
৪. স্বাধীন ভারতের রাষ্ট্রীয় নীতি গানটির প্রথমাংশকে মর্যাদা দিয়ে কংগ্রেস নেতাদের ওই সিদ্ধান্তকেই বৈধতা দিয়েছিল।
‘বন্দে মাতরম’ ভারতের ইতিহাসে আবেগ, সাহিত্য ও স্বাধীনতা সংগ্রামের অমূল্য সম্পদ। কিন্তু এই গানকে ভিত্তি করে আজ রাজনৈতিক লাভের আশায় ইতিহাসকে বিকৃত করা হচ্ছে। দেশভাগের প্রকৃত ইতিহাসকে আড়াল করে বর্তমানে অপ্রয়োজনীয় বিভাজন সৃষ্টি করার প্রয়াস লুকিয়ে রয়েছে এর মধ্যে। মোদী ও অমিত শাহের দাবি ইতিহাসসম্মত নয়, বরং রাজনৈতিক বক্তব্য মাত্র। ইতিহাস যা বলে, তা অনেক সূক্ষ্ম, অনেক জটিল এবং সেই ইতিহাসে বন্দে মাতরমের স্থান সম্মানের, বিভেদের নয়।
Advertisement



