শীতের পারদে পতন হলেও রাজনীতির পারদ ক্রমশই বেড়ে চলেছে। সোমবার প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র হয়ে গিয়েছিলেন ‘বঙ্কিমদা’। সংসদেই প্রতিবাদ করেছিলেন তৃণমূল সাংসদ সৌগত রায়। মঙ্গলবারও সেই রেশ অব্যাহত রইল। কোচবিহারের সভা থেকে গর্জে উঠলেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রীর ‘বঙ্কিমদা’ নিয়ে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে মমতা বলেন, ‘বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে বললেন বঙ্কিমদা। যেন মনে হচ্ছে শ্যামদা, হরিদা। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় যিনি জাতীয় সঙ্গীত রচনা করেছিলেন, তাঁকে এই টুকু সম্মান দিল না। আপনাদের তো মাথা নীচু করে নাকখত দেওয়া উচিত জনগণের কাছে। তাতেও ক্ষমা হবে না। দেশের সংস্কৃতি, ইতিহাসকে অসম্মান করেছেন।’
ছাব্বিশে বাংলা দখল করতে মরিয়া গেরুয়া শিবির। তাই নির্বাচনের দিন যত এগিয়ে আসছে ততই বাংলা ও বাঙালির মনীষীরা প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে দেশের রাজনীতিতে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, রাজা রামমোহন রায়ের পর এবার বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, বাংলার মনীষীদের হাতিয়ার করতে চাইছে গেরুয়া শিবির। আর এই বছর বঙ্কিমের ‘বন্দে মাতরম’-এর ১৫০ বছর পূর্তি। তাই সাহিত্য সম্রাট আরও বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে পদ্ম শিবিরের কাছে। বন্দে মাতরমকে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে চাইছে মোদী সরকার।
Advertisement
তবে প্রতিবারই কিছু কিছু ভুলচুক করে ফেলছেন বিজেপি নেতৃত্বরা। তাই নিয়ে কোচবিহারে মুখ্যমন্ত্রীর কণ্ঠে শোনা গেল ঝাঁঝ। বিজেপি শুধু রাজনীতিতে নয়, বাংলার মনীষীদের প্রতি ধারাবাহিক অসম্মান দেখিয়ে এগোতে চাইছে বলে জানান মমতা। মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘রামমোহনকে দেশপ্রেমী মানেন না, ক্ষুদিরামকে সন্ত্রাসবাদী বলেন, বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙেন… আর নির্বাচন এলেই সংখ্যালঘু ভোট ভাগ করার খেলা! ভোটের পর আবার শীতলকুচিতে গুলি, আর অসম থেকে বাংলার মানুষকে নোটিস পাঠান। লজ্জা করে না?’
Advertisement
কোচবিহারের সভা থেকে এদিন বিজেপির বিরুদ্ধে ভোট কেনার অভিযোগ করেন মুখ্যমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘আমি বিজেপির মতো টাকা দিয়ে ভোট কিনি না। আমি ভালবাসা দিয়ে কিনি। তাই যা দেওয়ার ভোটের আগেই দিই।’ মমতার অভিযোগ, ‘ভোটের আগে উজলার নামে নাটক, চা বাগান খোলার নাটক, নতুন করে কিছু দেওয়ার নাটক? এ সব আমরা বরদাস্ত করি না।’ বাংলার বঞ্চনা নিয়েও এদিন সরব হন মুখ্যমন্ত্রী। একশো দিনের কাজের টাকা কেন্দ্রীয় সরকার এখনও দিচ্ছে না বলে জানান মমতা।
হাইকোর্ট এবং সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশের পর এক বছর কেটে গিয়েছে। তারপর কেন্দ্রের তরফে চিঠি পাঠানো হয়েছে। সেই চিঠিতে একশো দিনের কাজ নিয়ে বেশ কিছু শর্ত চাপানো হয়েছে বলে কোচবিহারের সভা থেকে দাবি করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। কেন্দ্রের চাপানো শর্তের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমরা এই শর্ত মানি না। একশো দিনের কাজ বাংলাই করবে।’ তারপর শর্ত ‘অসম্মানজনক’ বলে আখ্যা দিয়ে কোচবিহারের জনসভা থেকে এই সংক্রান্ত কাগজ ছিঁড়ে ফেলেন তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
মমতার কথায়, ‘তিন, চারদিন আগে আমাদের একটা নোটিস পাঠিয়েছে কেন্দ্রের নতুন শ্রম আইন নিয়ে। ১০০ দিনের কাজের টাকা দিতে নতুন শর্ত চাপিয়েছে। আমরা এসব শর্ত মানি না, মানব না। এটা অসম্মানের। এই আমি কাগজ ছিঁড়ে ফেলে দিলাম। এটা কেন্দ্রের কোনও নোটিস নয়, এটা আমার কাছে থাকা কাগজ।‘ তার আগেই অবশ্য মমতা বলেন, ‘একশো দিনের কাজে এখনও ৫১,৬১৭ কোটি টাকা পাইনি। তোমাদের দয়ার দরকার নেই, আমরা বিকল্প কাজ করতে জানি। আমরা আবার ক্ষমতায় আসব, নিজেরাই কর্মশ্রী প্রকল্পের আওতায় ১০০ দিনের কাজের ব্যবস্থা করব।‘
একশো দিনের কাজের প্রকল্পে ২০২১ সালের পর থেকে পশ্চিমবঙ্গের বরাদ্দ বন্ধ রেখেছে কেন্দ্রীয় সরকার। ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে রাজ্যের কোষাগার থেকে অর্থ দিয়ে মমতা ‘কর্মশ্রী’ নামে একটি বিকল্প প্রকল্প চালু করেন। সেই প্রকল্পের অধীনে রাজ্যের শ্রমিকদের নির্দিষ্ট দিনের কাজ দেওয়া হয়। কেন্দ্রের তরফে কী কী শর্ত দেওয়া হয়েছে তার কিছু অংশ একটি কাগজে লিখে এনেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। সেই কাগজ থেকে পড়ে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘ত্রৈমাসিক শ্রমবাজেট দেখাতে হবে।’ সেই কথা উল্লেখ করে মমতা বলেন, ‘বাজেট দেখানোর সময় কোথায়? এটা ডিসেম্বর মাস। ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন ঘোষণা।’
এ ছাড়াও, কেন্দ্রের দেওয়া আরও একটি শর্তের কথা উল্লেখ করে মমতা বলেন, ‘একটা গ্রামসভায় মাত্র ১০ জন কাজ পাবে, এটা হয় কখনও? একটা পরিবারেই তো ১০টা গরিব লোক থাকে।’ একশো দিনের কাজে প্রশিক্ষণের কথাও তাতে বলা হয়েছে। সে প্রসঙ্গে মমতা বলেন, ‘ট্রেনিং দিতে হবে। বলছে না হলে নাকি জমির কাজ করা যাবে না।’ তার পরেই মমতা তাঁর গলার স্বর কয়েক গুণ চড়িয়ে হাতের কাগজ দেখিয়ে বলেন, ‘এটার কোনও ভ্যালু নেই। ভ্যালুলেস কাগজ।’ মুখ্যমন্ত্রীর স্পষ্ট বার্তা, ‘আবার আমরা ক্ষমতায় আসব। আসব। কর্মশ্রীতে এ বার ৭৫ দিন কাজ হয়েছে। একশো দিনের কাজ বাংলাই করবে। চাই না তোমাদের ভিক্ষা। বাংলা নিজের পায়ে হাঁটতে জানে।’
এরপরই ভোটার তালিকায় বিশেষ নিবিড় সংশোধন প্রক্রিয়ায় সমস্যায় পড়া সাধারণ মানুষকে সাহায্যের জন্য দলের নেতাদের একসঙ্গে কাজ করার বার্তা দেন তৃণমূল নেত্রী। এসআইআইর নিয়ে মমতা বলেন, ‘বিএলএরা যেমন কাজ করছেন করবে। দলও যেন ঐক্যবদ্ধ ভাবে কাজ করে। যুদ্ধ যখন বাঁধে, সবাইকে কাঁধে কাঁধে মিলিয়ে লড়াই করতে হয়।‘এসআইআর প্রক্রিয়া অপরিকল্পিত বলে আবার সরব হন মুখ্যমন্ত্রী। কোনও ডকুমেন্টের দরকার হলে সরকার ও দল সাহায্য করবে বলেও জানান তিনি। সেই সঙ্গে বলেন,‘সরকার মে আই হেল্প ইউ ক্যাম্প করবে। প্রতি গ্রাম পঞ্চায়েতে সেই বুথ হবে। সেখান থেকে সব সাহায্য পাওয়া যাবে।‘
এরপরই দলকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে লড়াইয়ের বার্তা দিয়ে বলেন, ‘কারও কোনও সমস্যা থাকলে দলের বিএলএ-রা যেমন কাজ করছে, করবে। তেমনই দলকেও ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে। মনে রাখবেন যুদ্ধ যখন বাঁধে সবাইকে কাঁধে-কাঁধে মিলিয়ে লড়াই করতে হয়।‘ সূত্রের খবর, সোমবার কোচবিহার প্রসাশনিক সভা শেষ হওয়ার পর কোচবিহার পুরসভার চেয়ারম্যান রবীন্দ্রনাথ ঘোষের সঙ্গে কথা বলেন। তারপর অন্য নেতাদেরও ডাকেন। সেই আলোচনার পর মঙ্গলবার কোচবিহারের সভামঞ্চ থেকে ঐক্যের বার্তা দিলেন তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
Advertisement



